পৃষ্ঠাসমূহ

মঙ্গলবার, ১ অক্টোবর, ২০১৩

নিষ্ঠুর

সন্ধ্যে তখন সাতটা হবে। বইয়ে ঠাসা ছোট্ট ঘরটাতে চৌকির ওপর বসে অয়ন। গালে হাত দিয়ে জানলা দিয়ে বহুদূরে কোন এক অসীমের উদ্দেশ্যে তাকিয়ে। চোখে একটা কারুণ্যের ছাপ স্পষ্ট। টিউবলাইটের পিছনে একটা টিকটিকি ডেকে ওঠে, টিক, টিক, টিক। ঘরটা দোতলায়। নিচের তলা থেকে একটা গুঞ্জন ভেসে আসছে। বাড়ির সামনে একটা ট্রাক দাঁড়িয়ে। একটা আলমারি তোলা হচ্ছে ট্রাকটার পিছনে। ঢকাং ঢকাং করে জোরে শব্দ হয়। তবু অয়নের ভেতরে কোন চাঞ্চল্য নেই। সে ঠিক একইভাবে গালে হাত দিয়ে  বসে ভাবছে, হয়ত বা তার ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। হঠাৎ চোখে পড়ে সামনে রাখা ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস সমগ্র’। একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে আনমনে বইয়ের পাতাগুলো একবার সে ফরফর করে উল্টে যায়। থমকে গেল সে একটা পাতায়। পাতাটায় একটা চিঠি দিয়ে চিহ্ন দেওয়া আছে। বইটা খুলতেই চোখে পড়ে লেখা, ‘শেষের কবিতা’। একটু কৌতুহলী হয়ে চিহ্ন দেওয়া চিঠিটাকে তুলে দেখে অয়ন। এ তার বহু পরিচিত চিঠি। বহু আশা আর স্বপ্নের মেলবন্ধনে লেখা। বহুবার পড়া হলেও আরো একবার তা পড়ার ইচ্ছা জাগে তার।
প্রিয়
       অয়ন, লিখতে বসে কেবলি হাত কাঁপছে। মোবাইল আর ইন্টারনেটের যুগে চিঠি লেখা যে প্রায় ভুলতেই বসেছি। তবু তোমাকে যে কিছু না লিখলেই নয়। তাই বেশী বাড়াব না। শুধু এটুকুই দাবী রাখি, তোমাকে যেন এভাবেই পাশে পাই বারবার। ঠিক এই দিনগুলোরই মত। আই লাভ ইউ অয়ন। আই লাভ ইউ সো মাচ। আর কিছু লিখলাম না। আজ একবার দেখা কোর।
                                                                             ইতি তোমার সুনি।
সুনির ভাল নাম সুনন্দিনী। এই একটাই মাত্র চিঠি সে তাকে দিয়েছিল। সে তখন তাদের প্রথম দেখার বেলা। সে চিঠি তাই যত ছোটই হোক না কেন। অয়নের কাছে যে এর মূল্য কত তা শুধু সেই বোঝে। তাই এতদিন ধরে সে দিয়েছিল তাকে সযত্নে। সেসব দিনের কথা আবারও মনে আসে তার। মনের পরতে পরতে ভেসে ওঠে তাদের প্রেম, ভালবাসা আর আবেগে ভরা দিনগুলো। তারপর বছর দুয়েক হল তাদের পরিণতি ঘটল বিয়ের পিঁড়িতে। কিন্তু তারপরেই আর এগোল না। কোন এক কারণে নিজেদের মধ্যে ওরা সেটল হতে পারে নি। হঠাৎ একটা ডাক আসে নিচতলা থেকে, ‘অয়ন, শুনে যাও’। সুনির বাবার গলা। ওরা চলে যাচ্ছে আজ। ওদের বাড়ি থেকে পাওনা বলতে ছিল শুধু ঐ আলমারিটা। বিয়ের পরে সুনির বাবাই জোর করে দিয়েছিল ওদের। আজ সেসব দেনাপাওনা মিটিয়ে ওরা চলে যাচ্ছে। তার সুনিও চলে যাচ্ছে শেষবারের মত। তবু সবশেষেও একটা কিন্তু ভাব ছিল অয়নের ভেতর। সুনির কি সত্যিই তাকে আর ভালবাসে না? এতদিনের একটা সম্পর্ক তবে কি পুরোই মিথ্যে? অয়নের মধ্যে তখনও এ সংশয় কাটেনি। সাড়া দিয়ে সে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। চিঠিটা পড়ে থাকে খাটের ঠিক মাঝখানে।

এমন সময় সুনন্দিনী ‘অয়ন’ বলে ডাকতে ডাকতে সেই ঘরে ঢোকে। ঢুকেই প্রথমেই তার চোখে পড়ে খাটে রাখা ঐ চিঠিটা। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সে চিঠিটাকে তুলে নেয়। আশ্চর্য্য হয়ে যায় সুনন্দিনী। তার এই মূল্যহীন চিঠিটা অয়ন আজও রেখে দিয়েছে? চিঠিটা সেও পড়তে শুরু করে। পড়তে পড়তে কেন জানি তার মনটাও আকুল হয়ে ওঠে অয়নেরই মত। চোখের জল আর বাগ মানে না। ঠোঁটটা সে দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে। চোখটা বুজতেই একফোঁটা অশ্রু গালে গড়িয়ে আসে। সেই জলের ছোঁয়াতেই হঠাৎ যেন সম্বিৎ ফিরে পায় সে। তারপর আর একমূহুর্ত অপেক্ষা না করে চিঠিটা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।