পৃষ্ঠাসমূহ

বৃহস্পতিবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৫

বিতর্কিত



আজ বেঁধে গেল তুমুল তর্ক। একপাশে আমি, আর ওপাশে তিনজন। আর শুরু হতে না হতেই তা জমে এক্কেবারে ক্ষীর। তা হোক, কিন্তু তর্কের বিষয়বস্তুটা না জানলে যে লেখাটাই জমবে না। তাই গোড়াটা আগে বলা ভাল।
আজ অফিসে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের অফিসের স্টেনোগ্রাফার শান্তনুদা আমাকে বলে, আচ্ছা শান্তনু, একে চন্দ্র, দুয়ে পক্ষ...ওটা তোমার পুরো মুখস্থ? আমি যথারীতি বলে দিলাম, হ্যাঁ। উনি আসলে পুরো ছড়াটা ভুলে গেছিলেন। তাই আমি বলে যেতেই উনি সেগুলো লিখে নিলেন। কিন্তু নয়ে নবগ্রহতেই হল সমস্যা। আমি বললাম, এখানে হয়ত বলেছে, নয়ে নবগ্রহ। কিন্তু আদতে তা নয়। প্লুটোর গ্রহ তকমা ছেঁটে ফেলার জন্য ও এখন নাম যশ খুইয়ে বামন গ্রহের দলে চলে গেছে। ওকে আর ‘গ্রহ’ সম্মান দেওয়ার দরকার নেই। ফট্‌ করে শশাঙ্কদা বলে উঠল, ‘কিন্তু জ্যোতিষে তা বলে না। সেখানে কিন্তু বলে ওটা গ্রহই’। আমি তো মুখ বেঁকিয়ে বলে ফেললাম, ‘সেখানে তো অনেক কিছুই বলে কিন্তু বিজ্ঞান তো তাকে প্রমাণ করতেই পারেনি’।
-      কিন্তু বিজ্ঞানও কি সব বলতে পেরেছে...
ব্যস, শুরু হয়ে গেল বিতর্ক। দুই স্টেনোগ্রাফার শান্তনুদা আর সোমনাথদা, আর একজন ইন্সপেক্টর শশাঙ্কদা – এইসব রথী-মহারথীদের বিরুদ্ধে আমি একা চুনোপুঁটি এম.টি.এস। কিন্তু ওদের বক্তব্য শুনে যা বুঝলাম তা হল, ওরা বলতে চায়, বিজ্ঞান সবকিছু প্রমাণ করতে পারেনি। কিন্তু তাই বলে তো সেগুলো মিথ্যে হয়ে যায়নি। এমনকি বিজ্ঞান যা প্রমাণ করতে পেরেছে তাও যে ঠিক হবেই এমন বলবার জোরও তার নেই। অতএব বিজ্ঞান হঠাও। যার বলার মধ্যে কোন জোরই নেই তাকে আবার মানে কে? কিন্তু একজন জ্যোতিষী তো ধ্রুব সত্য বলে, তার বলার মধ্যে তো কোন সন্দেহ নেই। আবার তেমনি জ্যোতিষবিদ্যা যে মিথ্যে তাও তো বিজ্ঞান প্রমাণ করতে পারেনি। হয়ত এই জ্যোতিষের ক্রিয়াকলাপের বিজ্ঞানসম্মত পন্থা নেই। কিন্তু এমনও তো হতে পারে যে বিজ্ঞান তাকে এখনও পুরোপুরি বুঝে উঠতেই পারেনি। অমুক গ্রহর ছায়া তমুক নক্ষত্রের ওপর পড়লেই যে আমার বিপদ হবে, তা বিজ্ঞান বলে না। কিন্তু দূর ভবিষ্যতেও যে বলবে না তার প্রমাণ কই? তার মানে, জ্যোতিষশাস্ত্রকেও ভ্রান্ত বলা যায় না কখনোই। তাই একে মেনে চলতে অসুবিধা কি?
অপরপক্ষে আমার বক্তব্য ছিল, বিজ্ঞান আজ পর্যন্ত যা প্রমাণ করতে পেরেছে তাকে সঙ্গে নিয়েই কেবল আমাদের চলতে হবে। যেমন, সূর্য একসময় আমাদের চোখে দেবতা ছিল, কিন্তু বিজ্ঞান যখন তাকে দেখাল সেটা কোন দেবতা নয়, একটা নক্ষত্র মাত্র, তখনই তাকে দেবত্ব থেকে পদত্যাগ করে একেবারে সাদামাটা একটা নক্ষত্র হয়ে যেতে হল, যে নক্ষত্র আমাদের ছায়াপথে অসংখ্য রয়েছে। কিন্তু তাই বলে আমি যদি ভাবতে থাকি, বিজ্ঞানের এই সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত নয়। বিজ্ঞানের ভুল একদিন ভাঙবেই। আর যেদিন ভাঙবে সেদিন সূর্য আবার স্বমহিমায় তার দেবতার আসন ফিরে পাবে। তাহলে আমার কাজটা আর যাই হোক, মনুষ্যবুদ্ধিপ্রসূত হল না। কারণ মানুষ আদতে যুক্তিবাদী প্রাণী। আর এই যুক্তি দিয়েই এটা বোঝা যায় যে কবে কি হবে তার অপেক্ষা না করে এখনও পর্যন্ত যা পাওয়া গেছে তাকেই আমাদের মেনে নিতে হবে। কারণ তা বৈ তো বাস্তব সত্যকে বোঝবার মত বিকল্প কোন উপায় আমাদের হাতে নেই।
কিন্তু শশাঙ্কদা সেই কথা বুঝল না। সে তর্ক থামাল না। তখন আমি বাধ্য হয়ে স্টিফেন হকিন্সের শরণাপন্ন হলাম। কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আর ইউনিভার্স ইন অ্যা নাটশেল – দুটো বইই আমার পড়া আছে। আমি বিগ ব্যাং তত্ত্ব প্রয়োগ করে বলতে লাগলাম, কেন মানুষের পক্ষে ভগবানের ধারণাকে বোঝা সম্ভব নয়। কেন জ্যোতিষকে বোঝা সম্ভব নয়। কিন্তু যুক্তি প্রয়োগ করতেই শশাঙ্কদা বলে, ‘স্টিফেন হকিং কি করে জানল। বিগ ব্যাং – এর সময় কি সে উপস্থিত ছিল? আর এনট্রপি ধারণাকে খণ্ডন করতে শশাঙ্কদা যা বলল তা তার মুখেই শুনুন – তুই বলছিস তো, মানুষের চিন্তার ফলে মস্তিষ্কের ভিতরে শ্বসনের ফলে তাপ উৎপন্ন হয়। আর তার ফলে অণু পরমাণুগুলো সব স্থিতি থেকে গতির অবস্থাপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু সাধুরা যখন একমনে বসে ধ্যান করে তখন কিন্তু তারা সমগ্র বিশ্বটাকে একস্থানে কেন্দ্রীভূত করে’। আমি বললাম, হ্যাঁ সে হয়ত সেভাবে মনঃসংযোগের পরিমাণটা বাড়ায়, আর তাই বাইরের চিন্তাভাবনা তাকে দোলা দেয় না। কিন্তু তার মানে এই নয় তার এনট্রপি বৃদ্ধি তার ক্ষেত্রে কাজ করছে না। তার কিন্তু সেই ধ্যানমগ্ন অবস্থাতেও শ্বাসকার্য চলছে, আর তাই শ্বসনও থেমে নেই। তাই শ্বসনের ফলে তাপ তো উৎপন্ন হবেই।
শশাঙ্কদার এবারে যে বলল তা শুধু আমার কাছে অদ্ভুত আর অভিনবই নয়, বরং চূড়ান্ত ভয়াবহ। ওনা কথাটা আমার সারাজীবন মনে থাকবে। উনি বললেন, কিন্তু সাধুরা ধ্যানের সময় তো শ্বাস নেয় না। তাদের সেই সময় শ্বসনও চলে না।
আমি আর কিছু বলিনি। কিন্তু মনে মনে ভাবলাম এই শশাঙ্কদাই কি করে গর্ব করে তার একজোড়া ডিগ্রী আছে বলে? কি করে বলতে পারে, ‘আমি নাটক করি, গান জানি’। কি লাভ হল তার এইসব শিক্ষা পেয়ে? যে তার চেতনাকে কেবল প্রাচীন বিশ্বাসের মধ্যেই সম্পূর্ণরূপে বাঁধা দিয়ে রেখেছে, তার ডিগ্রি বাড়িয়ে, শিক্ষিত হওয়ার মধ্যেই বা সার্থকতা কোথায়? এই শিক্ষা এদেরকে যে কেবল টাকা রোজগার করতেই শিখিয়েছে, মানসিক মুক্তি দেয়নি। তাই তারা আজও রাধামাধবের পায়ে কপাল না ঠেকিয়ে ঘর থেকে বেরোয় না, অফিস থেকেও বেরোয় না।
মনে আছে, ছোটবেলায় এক গরমের দিনে আমি রিক্সায় উঠেছিলাম, আমার সাথে মা ছিল। আর গরমটাও সেদিন বেজায় ছিলশুনলাম আমাদের রিক্সাওয়ালাটা চেঁচাচ্ছে, আসলে সূর্যটা আকাশ থেকে পৃথিবীর দিকে অনেকটা নেমে এসেছে তো, সেই কারণেই গরমটা বেড়ে গেছে। মনে পড়ে, আমি আর মা সেদিন তার এই কথা শুনে খুব একচোট হেসেছিলাম। এখন আর লোকটাকে দেখি না। কিন্তু এখন যদি সেই রিক্সাওয়ালাকে আবার দেখতে পাই,  তবে তার কাছে ক্ষমা চাইব। বলব, ঘাট হয়েছে দাদা, আপনাকে নিয়ে আমার হাসা সেদিন উচিত হয়নি। আমি সেদিন না বুঝলেও আজ এটা ভালভাবেই জানি, তথাকথিত শিক্ষিতরাও এমন সব চিন্তা করেন, যা আপনার সেদিনের সেই চিন্তার থেকে কোন অংশেই কম মজাদার নয়।
তবু আরো একটা কথা বলে যেতে চাই। কারণ এই ঘটনাটার উল্লেখ না করলে এই লেখাটা সম্পূর্ণ হবে না। আজকের সেই স্মরণীয় বিতর্কের পর, অনেকক্ষণ কেটে গেছে। সবকিছু শান্ত। আমার কিছু কাজ ছিল অফিসারের ঘরে। সেসব শেষ করে আমি খেয়ে নিয়েছি। এমন সময় সেই স্টেনোগ্রাফার সোমনাথদা আমাকে ডাকল। আমি তার কাছে যেতেই সে বলল, জান শান্তনু, তোমার মত বয়স যখন আমার ছিল। তখন আমিও তোমার মত চিন্তা করতাম। সমস্ত কিছুকে যুক্তি দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করে মানবারই চেষ্টা করতাম। কিন্তু কি জান, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার ভেতরের সেই জোরটা কমে গেছে। এখন কোনকিছু না মেনে চললে, বিশ্বাস না করলে কিছুতেই যেন শান্তি পাই না’সত্যি কথা বলছি, ওনার কথা শুনে আমার খুব খারাপ লাগল। আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম, উনি যেন নিজের ভুলগুলো ধরতে পেরেছেন। ওনাদের যুক্তির মধ্যে যে গলদ ছিল, তা ওনার চোখে পড়েছে। আর তাই উনি যখন নিজের ছোটবেলাটাকে আমার মধ্যে প্রতিস্থাপন করলেন, তার পাশে আজকের উনি, ওনার চোখেই বৃদ্ধ হয়ে পড়লেন। উনি আত্মসমীক্ষণের মধ্যে এটা বুঝতে পারলেন, যে উনি নিজের দূর্বলতা আর তার জেরে বাঁচবার জন্য একটা ভর্সা খুঁজে পেতেই এত গাঢ়ভাবে বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরেছেন। বস্তুত, এই বিশ্বাসই কিন্তু এঁদের সবাকারই নিজেদের অস্ত্বিত্বের একটা দৃঢ় অবলম্বন। তাই একে যেন-তেন-প্রকারেণ রক্ষা করবার জন্যে মরিয়া এরা। তাতে শিক্ষিত-অশিক্ষিত ভেদাভেদ মুছে যায়। পড়ে থাকে কেবল বিশ্বাসকে ধরে রাখবার তাগিদ। তাই এরা তাদের ছোটবেলার দিনগুলোকেই আঁকড়ে ধরে থাকতে চায়। তাদের কাছে সেদিনগুলোই হয় স্বর্ণযুগ, আর আধুনিক যা কিছু সবই খারাপ। কারণ আধুনিককে মেনে নেওয়ার মত মানসিক জোর তো তাদের নেই। আর এখানেই তো তাদের ব্যর্থতা। নতুন যে আসছে, তাই পুরোনোকে তো তার জায়গা ছেড়ে দিতেই হবে।
তবু আমি সোমনাথদাকে ধন্যবাদ দেব। উনি তো তাও প্রকারান্তরে হলেও নিজের ভুলটুকুকে স্বীকার করেছেন, কিন্তু বাকি দুজন তো তাও করেনি। অর্থাৎ যে মানসিক জোরের অভাবের কথা সোমনাথদা বলছিলেন, বাকি দুজনের সেই অভাব তার থেকেও যে বেশি এটুকুই বোঝা গেল। তবে এই বিতর্ক থেকে আর যাই হোক আমি কিন্তু শিখলাম অনেক কিছু। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য শশাঙ্কদার সেই ভয়াবহ ডায়লগ। নাঃ এখন আর সেই কথাগুলো দ্বিতীয়বার লিখব না। আমার ভয় তাহলে আরো বেড়ে যাবে। বরং এখন আসি, টাটা।