পৃষ্ঠাসমূহ

সোমবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

আশঙ্কার আবহে, যুক্তিবাদীদের কোন স্থান নেই



গৌরী লঙ্কেশ হত্যার দুদিন পরে, তার বন্ধু এবং তার একনিষ্ঠ সমর্থক কন্নড় লেখক যোগেশ মাস্টার দেখলেন একজন তাঁর গাড়ি দাঁড় করালো, ছবি তুলল এবং তারপর পালিয়ে গেল। “ঐ রাত্রেই (বৃহস্পতিবার) একটা লোক কিছুক্ষণ ধরে সন্দেহজনকভাবে আমাকে অনুসরণ করছিল। আমি বেশ কিছুদিন ধরেই ভয়ে ভয়ে আছি। কিন্তু এখন গৌরী গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর ভয়টা আরো বেড়েছে” – মি. যোগেশ বললেন।

২০১৫ সালে এম. এম. কালবুর্গি খুন হওয়ার পরে মি. যোগেশকে নিরাপত্তার কারণে একজন বন্দুকধারী দেওয়া হয়েছিল (ঘটনাক্রমে সেটা লঙ্কেশের জোরাজুরিতেই)। এখন আবার পুলিশী নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনা হচ্ছে।

১৮ জন লেখক, যুক্তিবাদী এবং কর্মীদের মধ্যে মি. যোগেশ একজন যাদের পুলিশী নিরাপত্তা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে – প্রগতিশীল শক্তির বিরুদ্ধে ভয়ের আবহ তৈরী হওয়ার একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত।
এই লেখক বিতর্ক, ভয় এবং অপমানের সম্মুখীন আগেও হয়েছিলেন যার শুরুটা ছিও ২০১৩ সালে তার ‘দুন্ধি’ নামে একটি বই প্রকাশের সাথে সাথে। বইটিতে গণেশের উপস্থাপনায় দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠীগুলি খাপ্পা হয়েছিল এবং ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত দেওয়ার কারণে তাঁকে অল্পকালের জন্য কারাবাসও বরণ করতে হয়। তখন থেকেই প্রতিবাদ তাঁর পিছু ছাড়েনি এবং মার্চ মাসে দাবানগেরেতে লঙ্কেশের বাবার স্মরণে একটি অনুষ্ঠানসভায় কিছু লোকের একটি দল এসে তার মুখে কালো তেল ঢেলে দেয়।

তিনি বলেন তাঁর কাজ কখনও দমে যায়নি। বিতর্কিত লেখক হিসেবে তাঁর খ্যাতির কারণে তাঁকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। থিয়েটার ও অন্যান্য লেখালিখির ক্ষেত্র যা তাঁর আয়ের একমাত্র উৎস ছিল, গত দুবছর ধরে তা ক্রমেই স্তিমিত হয়ে এসেছে।

“আমি বিপজ্জনক বলে লোকে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো বন্ধ করেছে। ব্যবস্থাপকদের আগে পুলিশে খবর দিতে হয় এবং যাতে কোন গণ্ডগোল না বাধে তার জন্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হয়। কে এইসব ঝামেলা নিতে চায়?” তিনি জানালেন।


হিটলিস্ট তালিকা
 
হুমকি ও হত্যা – এই একটি সূত্র যোগেশের সাথে মিলিয়ে দিয়েছে সুদূর ম্যাঙ্গালোরের যুক্তিবাদী কর্মী নরেন্দ্র নায়কেকও। নরেন্দ্রবাবুকে এখন দুজন দেহরক্ষী পালা করে নিরাপত্তা দিচ্ছে। “আমি তথাকথিত ঐ হিটলিস্টদের তালিকায় ৭ নম্বরে ছিলাম। তবে এখন একটা ঘর এগিয়েছি”, ওনার গলায় ব্ল্যাক হিউমার স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস-বিরোধী সংস্থা ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান র‍্যাশানালিস্ট অ্যাসোশিয়েশনের ৬৬ বছর বয়সী এই কর্মাধ্যক্ষ শত্রুপক্ষের একটি তালিকা তৈরী করেছেন যার মধ্যে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন, বিভিন্ন মঠ এবং ধর্মীয় সংগঠনগুলি রয়েছে।

২০১৬ সালে তাঁকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হলে তিনি পুলিশে একটি অভিযোগ দায়ের করেন; এবছরের শুরুতে দুজন ব্যক্তি তাঁকে অনুসরণ করছে এই মর্মে তিনি থানায় অভিযোগ জানালে তাঁকে অতিরিক্ত পুলিশী নিরাপত্তা দেওয়া হয়।

পরিবারের চাপ এবং প্রাণনাশের হুমকির প্রত্যক্ষ চাপ সত্ত্বেও এই যুক্তিবাদী বলেন শেষ পর্যন্ত লড়ে যাওয়া ছাড়া তাঁর আর অন্য কোন পথ নেই। “গৌরীর মৃত্যুর পর থেকে সাময়িকভাবে বাইরের দেশে চলে যাওয়ার জন্য আমার কাছে কল আসছে। কিন্তু সমাজে যখন এত অন্যায় আর ত্রুটি রয়েছে, তখন কেন সেখান থেকে পালিয়ে যাব?’ নায়েকের প্রশ্ন।


বর্ধিত সতর্কতা
 
মি. নায়েকের মতোই একই হিটলিস্টে রয়েছেন কে. এস. ভগবান। এই লেখককে নিয়ে তিন দশক ধরে বিতর্ক চলে আসছে এবং ২০১৫ সালে হিন্দু পুঁথির ওপর তাঁর বক্তব্যের কারণে তাঁকে আক্রান্ত হতে হয়। দাবী করা হয়, তাঁর বক্তব্য ছিল নাকি হিন্দুধর্মের পক্ষে অবমাননাকর। প্রফেসর কালবুর্গির হত্যার পর এই অনলাইন পোস্ট অনুযায়ী মহীশূরের এই লেখকই ছিলেন পরবর্তী শিকার। তিনি কোথাও বেরোলে, এখন সবসময়ই তাঁর সাথে দুজন বন্দুকধারী থাকে এবং গৌরী লঙ্কেশের হত্যার পরে আরও দুজন নিরাপত্তা কর্মীকে রোজই কয়েক ঘণ্টার জন্য তাঁর সাথে রাখা হয়ে।

একদিকে যেমন বর্তমান আবহ ক্রমেই আতঙ্কগ্রস্ত ও একমুখী হয়ে পড়ছে, তেমনি অন্যদিকে কিন্তু মি. ভগবান তাঁদের নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে আশাবাদীই রয়েছেন। “এখন তো ভালোই বিক্রি হচ্ছে আমার বই, আর এখন আরো বেশি করে অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ পাচ্ছি। আসলে, বিশেষ করে যুবসমাজের মধ্যে একটা বড় অংশ আছে যারা নতুন ধারণা চায় যেগুলো বৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত”। তিনি বললেন।

তবে দক্ষিণ মহারাষ্ট্রে যেখানে ২০১৩ সালে নরেন্দ্র দাভোলকার ও ২০১৫ সালে গোবিন্দ পানসারে খুন হয়েছিলেন সেখানে কিন্তু একটা ভয়ের আবহ রয়েই গেছে।

মহারাষ্ট্রের কৃষকদের স্বার্থে কাজ করে এমন একটি বামপন্থী সংগঠন ‘শ্রমিক মুক্তি দল’ – এর ৬৮ বছর বয়সী এক প্রবীণ কর্মী ভরত পতঙ্কর জানেন যে কোন হুমকিকেই অগ্রাহ্য করা যায় না। তিনি প্রথমে পুলিশী নিরাপত্তা নিতে অস্বীকার করলেও এখন একজন বন্দুকধারী তাঁর সাথে রাখতে সম্মত হয়েছেন। তিনি বলেন, জাতিভেদ প্রথা নির্মূল করবার পক্ষে এবং মুসলমান ও দলিতদের মত অত্যাচারিত গোষ্ঠীগুলিকে সংঘবদ্ধ করবার লক্ষে তিনি কাজ করেছেন বলেই হিন্দু মৌলবাদী দল ‘সনাতন সংস্থা’র তিনি চক্ষুশূল হয়েছেন; উল্লেখ্য, দুজন যুক্তিবাদীকে খুনের অপরাধে এই ‘সংস্থা’র সদস্যদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পানসারে হত্যার দিন ‘সংস্থা’র মুখপাত্র ‘সনাতন প্রভাত’-এর একটি কপি মি. পতঙ্করের বাড়ী সামনে ফেলে যাওয়া হয়। “শুধু আমার আর আমার গ্রামের নাম তাতে লেখা ছিল। এটাই কি একটা স্পষ্ট হুমকি হয়?’ তিনি জানতে চাইলেন।

(তথ্য দিয়েছেন অলোক দেশপাণ্ডে, মহারাষ্ট্র এবং কে. সি. দীপিকা, বেঙ্গালুরু) 

[লেখাটি 'দ্য হিন্দু' পত্রিকার ১০.০৯.২০১৭ (রবিবার) সংখ্যার একটি নিবন্ধ থেকে অনুদিত।] 

রবিবার, ১৪ মে, ২০১৭

নতুন চাকরি



এগারোটার মধ্যেও যখন উমাদি অফিসে এল না, মাধব রক্ষিত বলে উঠল, ‘বাইরে করিডরটায় কেউ নেই। স্যারের ঘরে বাইরের কোন লোক ঢুকে পড়লে মুশকিল হবে’। সুমিতা কাঞ্জিলাল তাকে সায় দিয়ে অমিয়কে বলল, ‘অমিয়, আজ তোমায় বাইরেটায় বসতে হবে। বাইরে কেউ নেই’। অমিয়র বুকটা ধক করে উঠল। দশদিনের এই চাকরিজীবনে সে যেন প্রথম উপলব্ধি করল তার চাকরিটা আসলে কিসের। বাইরের করিডরটায় লোহার বেঞ্চ পাতা আছে। অমিয় সেখানে এসে বসে। কমিশনার সাহেবের ঘর পাশেই। সেই ঘর পাহারা দেওয়াটাই আপাতত তার কাজ।
যদিও অমিয় জানে যে সে এই ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্টের একজন এম.টি.এস মাত্র। আর এখানে এম.টি.এসের কাজ বলতে মূলত পিওনের কাজই বোঝায়। তবুও বাইরে করিডরে এভাবে একা একা বসে থাকতে বড্ড খারাপ লাগল তার। কমিশনার সাহেবের একজন পিওন আছে – উমা লাহা, সকলের মুখে উমাদি। বিগত ক’টা দিন পিওনের কাজ বলতে যা বোঝায় – কমিশনারের জন্য চা করা, প্লেট ধোওয়া, তার টিফিন এনে দেওয়া, ঘর পাহারা দেওয়া – সব কাজই উমাদি একাই সামলেছে। অমিয়কে এসবের আঁচ পেতে হয়নি। সে বরং সেই সময়ে অফিসের অন্যান্য কাজ করেছে। চিঠি টাইপ করে দিয়েছে। তার টাইপের হাত চালু থাকায় তাকে বকলমে একজন অস্থায়ী টাইপিস্ট হিসেবেই চালিয়ে নেওয়া গেছে। এছাড়াও সে জেরক্স করে, চিঠি ইস্যু করতে দেয়, প্রয়োজনে সেই চিঠি অন্য অফিসে পৌঁছেও দিয়েছে। কিন্তু আজ উমাদি না আসাতেই ঘটল ছন্দপতন। তবে ছুটি তো কেউ প্রয়োজনে নিতেই পারে। সেখানে সমস্যা নয়, সমস্যা অন্য জায়গায়।
হঠাৎ বেল পড়ল। কমিশনার সাহেব তলব করেছেন। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই দেখে কোট প্যান্ট পরিহিত মিঃ শ্রীবাস্তব গদিচেয়ারে বসে ফাইলের কাজে বুঁদ হয়ে আছেন। খানিক বাদে তাঁর খেয়াল হল, অমিয় দাঁড়িয়ে আছে। অর্ডার এল, ‘পানি কা বটল লানা হ্যায়’। অমিয় ঈষৎ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল, তারপর জল আনতে ছুটল দোতলার ক্যান্টিনে। চার বোতল জল লাগবে। অফিসের ইন্সপেক্টর শশাঙ্কদা ক্যান্টিনে আড্ডা মারছিল। অমিয়কে দেখে জিগ্যেস করল, ‘কি রে, এখানে কি ব্যাপার?’ অমিয় জানাল সে কি করতে এসেছে। উত্তরে শশাঙ্কদা বলল, ‘এঃ, তোদের দিয়ে এসব কাজ করাচ্ছে! এসব ভাল ছেলেগুলো...’ শশাঙ্কদা আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল। পাশ থেকে আরো একজন জুড়ে দিল, ‘হ্যাঁ, অনেক নতুন নতুন ছেলেমেয়ে এম.টি.এস হিসেবে জয়েন করেছে। ভাল ভাল ডিগ্রী আছে। অথচ তাদের কাজগুলো সব ফালতু। গ্রুপ ডি’র কাজ। কিছু করারও নেই। কিছু বলতেও পারবেন না আপনি’। আরেকজন বলল, ‘আমাদের অফিসেও তো একজন এসেছে। ছেলেটা এম এ পাশ। আগে প্রাইমারী স্কুলে চাকরিও করতসেসব ছেড়ে এখানে এসেছে। আসলে ওরা বোধহয় বুঝতেই পারেনি, এম.টি.এসের কাজটা কি? সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের চাকরি আর ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্ট দেখেছে, অন্য চাকরি ছেড়ে আগে এখানে এসেছে’।
অমিয়র এসব একঘেয়ে শুনতে বেশীক্ষণ ভাল লাগছিল না। সে শশাঙ্কদাকে বলে সেখান থেকে চলে এল। শশাঙ্কদা তাকে রোজই একবার করে খোঁচা মারে যাতে সে অন্য ভাল কোন চাকরির পরীক্ষা দিয়ে এখান থেকে বেরিয়ে যায়। কিন্তু সে কাজটা যে কতটা সমস্যাসঙ্কুল সেটা শশাঙ্কদাকে বোঝানো অমিয়র পক্ষে এ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি।
কমিশনারকে জলের বোতল দিয়ে আবার করিডরে এসে বসল অমিয়। একা। কেউ নেই কথা বলবার, অফিসের ঘরের দরজাগুলোও বন্ধ। অমিয়কে এভাবেই বসে থাকতে হবে সারাটাদিন। এক-একটা মিনিট যেন এখন এক-একটা ঘণ্টার মত কাটছে। তবু উঠে যাওয়ারও উপায় নেই। পরবর্তী বেল পড়লে শুনবে কে?

*                                              *                                              *

অমিয়কান্তি মুখোপাধ্যায়। বাবা অনেকদিন নিখোঁজ হওয়ায় মামার বাড়ি থেকেই সে মানুষ। অবশ্য মামার আয়ও নেহাতই যৎসামান্য। সামান্য বিজনেস করে সে। আর অমিয়র মা ক’টা বাচ্চাকে পড়ায়। অমিয় কেমিস্ট্রিতে অনার্স নিয়ে ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করে। তারপর করে মাস্টার ডিগ্রী। স্কুলে একটা দিনও কামাই করত না বলে বন্ধুরা তাকে মজা করে ‘বাঘের বাচ্চা’ বলত। দেড় মাইল রাস্তা হেঁটে স্কুলে যেত সে রোজবাসভাড়া বাঁচত তাতে। সাইকেল তো নেই। যতদিন চাকরি পায়নি, সে টিউশানি চালিয়ে গেছে। টেন, ইলেভেন, ট্যুয়েলভ। কিছু টাকা তাতে সংসারে এসেছে। কিন্তু তা সামান্যই। মায়ের তাতে বিশেষ কিছু সুরাহা হয়নি। বাচ্চা পড়িয়ে, সংসারের সমস্ত কাজ সামলে মা যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ত, শরীরের যন্ত্রণায় যখন সে বিছানায় গা এলিয়ে দিত, অমিয় ভাবত একটা ভাল চাকরি আর না জোটালেই নয়। তার নিজের জন্যেও যেমন,  মায়ের জন্যেও তেমনি এই চাকরির দরকার। অবশেষে বছরখানেক চেষ্টার পর এস. এস. সির পরীক্ষা দিয়ে পেল সে এম. টি. এসের চাকরি। সেদিন মায়ের আনন্দ দেখে কে? অমিয়র মনে আছে, অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার যেদিন এল, মা সেদিন ফোন করে করে সমস্ত আত্মীয়স্বজনদের জানিয়েছিল তার এই চাকরি পাবার খবরটা। আর সেই লেটারের খামটা মা যত্ন করে রেখে দিয়েছিল। বলেছিল, ‘যতদিন বাঁচব, এটা আমি আমার কাছেই রেখে দেব’। অমিয় জিগ্যেস করেছিল, ‘প্রথম মাইনেতে তোমার জন্য কি আনব বল?’ মা বলেছিল, ‘চাকরি পেয়ে যা এনেছ, তার চেয়ে বেশী আর কিছুই চাই না বাবা’
হঠাৎ বেলটা আবার বেজে ওঠে। এবার কমিশনার সাহেব একটা ফাইল নামিয়ে দিতে বললেন আর বললেন তাঁর জন্য চা করে নিয়ে আসতে। অমিয়র ভেতরটা যেন মুষড়ে পড়তে লাগল। তবু সে বাধ্য। ফ্লাস্কে জল গরম করতে করতে তার এক-একবার মনে হচ্ছিল এ চাকরী করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। সে যে শিক্ষা পেয়ে এসেছে, যে পরিবেশ থেকে এসেছে – তার সঙ্গে এসব কাজ মোটেই খাপ খায় না। অফিসে চাকরি করতে এসেও যে তাকে ফাইফরমাশ খাটতে হচ্ছে এর থেকে দুঃখের আর কিছু নেই। কিন্তু চাকরি ছাড়াটাও কি সহজ এখন? বিশেষত সরকারী একটা চাকরি পাওয়ার পর, তার পক্ষে কি আর আগের ঐ কষ্টকর দিনগুলোতে ইচ্ছাকৃতভাবে ফিরে যাওয়া সম্ভব?
কমিশনারকে সেদিন চা করে দিল অমিয়। তাঁর চা খাওয়া হয়ে গেলে কাপ-প্লেট ধুয়ে রেখে দিল। তারপর আবার সেই নিরন্তর বসে থাকা পরবর্তী বেল পড়বার অপেক্ষায়। দুপুর দেড়টা নাগাদ কমিশনার সাহেব টিফিন করতে বসেন, তাঁর টিফিন হয়ে গেলে আবার পড়ল বেল। অমিয় ঘরে ঢুকতেই ঘরময় খাবারের একটা ভ্যাপসা গন্ধ পায়। মিঃ শ্রীবাস্তব তাঁর এঁটো টিফিনবস্কটার দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘ইয়ে সাফা করকে লে আও’। কমিশনারের অর্ডার শুনে অমিয় হঠাৎ যেন একটা ধাক্কা খেলতার সামনে থেকে যেন সবকিছু সরে যেতে থাকল। জীবনে এই প্রথম তাকে অন্য কারুর এঁটো বাসন মাজতে হচ্ছে। যাক্‌, তবু এও তো সরকারী চাকরি।
বাথরুমে এসে সে যখন বাসন পরিষ্কার করছিল, ঠিক সেই সময় একটা লোক হাত ধুতে এল। অমিয় নিজের কাজে ব্যস্ত থাকলেও স্পষ্টই বুঝতে পারল লোকটা তাকে দেখছে। অদ্ভুত, অবাকপারা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। একটা স্যুটেড-বুটেড ছেলে, দেখে মনে হচ্ছে যথেষ্ট শিক্ষিত – সে কি করে এই ধরনের কাজ করে? তার মনে হল, লোকটা মৃদু হাসছে, এ হাসি সৌজন্যমূলক হাসি নয়। বিদ্রুপের হাসি এটা। ঠিক যেমন তার বেশভূষা, তার পরিবেশ, তার শিক্ষা – তাকে নিয়ে বিদ্রুপের হাসি হাসছে, লোকটাও তেমনভাবেই হাসছে। অমিয় টের পায় তার ভেতরে একটা উতরোল চলছে। হঠাৎ থমকে গেল সে, চকিতে চাইল সে লোকটার দিকে নির্বাক একটা প্রতিবাদ নিয়ে। কিন্তু লোকটা কোথায়? কেউ তো নেই! বাথরুমে কেউ নেই, সে একা! নিজেকে যেন হঠাৎ করে ফিরে পেল অমিয়। টিফিন বক্স পরিষ্কার করা হয়ে গেছে, সেটা স্যারের জিম্মায় রেখে এল সে। তারপর বাইরের করিডরটায় আবার এসে বসল। জীবনে এত বড় গোলামী অমিয়কে কখনও করতে হয়নি। তার প্রতিটা পদক্ষেপ এখন শ্লথ, তার সমগ্র সত্ত্ব্বা এখন আবিষ্ট, আচ্ছন্ন – আত্মগ্লানিবোধে।   
এমন সময় পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এল গৌতমদা। কমিশনার সাহেবের সিনিয়র পি. এস। ‘কি ভাই, আজ তুমি একা? সব কাজ করতে হচ্ছে? উমাদি হঠাৎ করে কামাই করল...’
-      গৌতমদা শুনুন। - গৌতমদা চলে যাচ্ছিল, তাকে থামিয়েই সে ডাকল।
অমিয় যেন এবার ভেঙে পড়ল, ‘আমি আর এ চাকরী করতে পারব না গৌতমদা’।
-      কেন, কি হল হঠাৎ?

-      নাঃ, এসব কাজ আমার পোষাচ্ছে না। আমি পারছি না, বিশ্বাস করুন, আমি এখনই এখান থেকে চলে যেতে চাই’। কিছুক্ষণ থেমে সে আবার বলে, ‘আমি আগে যে টিউশানি করতাম, টাকা কম হলেও সেটাই আমার ভাল ছিল।
গৌতমদা বিচক্ষণ মানুষ। আর বছর দুয়েক আছে তার অবসর নিতে। অমিয় তার কাছে পুত্রপ্রতিম। তাই সে স্নেহার্দ্র স্বরে বলতে লাগল, ‘দেখো ভাই, চাকরি ছাড়াটা কোন কাজের কথা নয়, আর এই বাজারে একটা সরকারী চাকরির মূল্য অনেক। তুমি তো নিজেও সে কথা জানো। আর তোমার এই চাকরি ছাড়া আর ভাল আয়ও কিছুই নেই। সুতরাং সেদিকটাও তো ভাবতে হবে। বাড়িতে তোমার মা আছেন, তাঁর কথাও ভাবো। আর তাছাড়া পরিশ্রম করেই তো তোমায় এই চাকরি জোটাতে হয়েছে। তারপরেও যদি সেটা হারাতে হয়, তবে সেটা খুবই দুঃখের হবে। একটু বিবেচনা করে দেখো, আমার মনে হয় না একটা চাকরি পেয়েও একেবারে সাথে সাথে ছেড়ে দেওয়াটা তোমার উচিত হবে
-      কিন্তু যেসব কাজ আমাকে করতে হচ্ছে, তা যে আমি কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছি না। আমাদের অভাব ছিল মানছি। কিন্তু আমার মা তো তাই বলে কখনো পরের বাড়ি ঝি গিরি করতে যায়নি। সেও পড়াত। হয়ত তাতে টাকা এমন কিছু বেশি আসত না, কিন্তু সম্মান? তাকে আপনি অস্বীকার করবেন কি করে? আর আমিও যে এই পরিবেশেই মানুষ হয়েছি গৌতমদা।
গৌতমদা অমিয়র কথাগুলো শুনে কিছুক্ষণ চিন্তা করে নিল। তারপর বলল, ‘সবই বুঝলাম, তবু বলব চাকরি ছাড়াটা ঠিক নয়। এতে পলায়নী মনোবৃত্তিও কাজ করে। কেন তাকে প্রশ্রয় দেবে? তার চেয়ে বরং ভাল চাকরির পরীক্ষা দিয়ে অন্য চাকরি পেয়ে তারপর এই চাকরি ছাড়ো। তাতে লাভ অনেক বেশি’। এই বলে কিছুটা থেমে গৌতমদা আবার জুড়ে দিল, ‘আর দু-একদিন এইসব কাজ আমাদেরও করতে হয়েছে। এমনও একদিন গেছে, স্যারের ঘরে মিটিং চলছে, আমি চা সার্ভ করছি, শশাঙ্ক বিস্কুট দিচ্ছে। সুতরাং এই নিয়ে ঘাবড়াবার দরকার নেই’।
        কথাগুলো বলে গৌতমদা চলে গেল। আর করিডরে বসে অমিয় ভাবতে থাকে, সত্যিই কি ঘাবড়াবার দরকার নেই? যেগুলো সে ভেবেছে তা নিছকই ভুল? নিজের মনগড়া মিথ্যে গুমর?
হঠাৎ সে দেখতে পেল গৌতমদা আবার ফিরে আসছে। হঠাৎ সে অমিয়র দিকে আঙুল তুলে কি যেন ইঙ্গিত করতে চাইল। মুখে তার ফুটে উঠল হাসি – সেই হাসি যা সে দেখেছিল বাথরুমে সেই লোকটার ঠোঁটে। হঠাৎ পাশের অফিসঘরগুলোর দরজা খুলে গেল। সেখান থেকে একে একে বেরিয়ে আসতে লাগল শশাঙ্কদা, স্বপ্নাদি, সুমিতাদি, মাধবদা, জীবনদা, কুন্তল, অনুপদা – সমস্ত স্টাফেরা। তাদের সকলেরই মুখে সেই একই বিদ্রুপাত্মক হাসি। তারা এখন আর মুখ টিপে হাসছে না। তারা জোরে হাসছে, হাঃ হাঃ করে হাওছে আর তাকে ক্রমাগত আঙুল তুলে ইঙ্গিত করছে, অমিয় এদের দেখে ঘাবড়ে গেল, সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। আর ওকে উঠে দাঁড়াতে দেখে সবাই তার দিকেই এগোতে লাগল বড় অদ্ভুতভাবে, হাসতে হাসতে, ইঙ্গিত করতে করতে। অমিয় উপায়ান্তর না দেখে পালাতে চাইল সেখান থেকে। কিন্তু সকলে যে তাকে ততক্ষণে চারিদিক থেকে ঘিরে ধরেছে, আরো ঘিরে ধরছে। সে আকুল স্বরে চীৎকার করতে লাগল, আমাকে ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও’। কিন্তু তার গলা থেকে এক ফোঁটাও আওয়াজ বেরোল না।
‘কি হয়েছে ভাই, শরীর খারাপ লাগছে?’ গৌতমদার কথায় অমিয়র যেন হুঁশ ফিরল। সে স্থির দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ গৌতমদার দিকে চেয়ে রইল। তারপর চারিদিকে তাকিয়ে দেখল, কই, কেউ তো নেই এখানে! সব অফিসঘরই তো বন্ধ। ঠিক যেমনটা আগে ছিল, তেমনই রয়েছে। এ তার সাথে তবে কি হচ্ছে? কেন হচ্ছে এসব? তার একেবারে অসহ্য লাগল। সারা শরীর থেকে অবিরল ঘাম ঝরছে, পকেট থেকে সে রুমাল বার করল ঘাম মোছবার জন্য। গৌতমদাকে জানিয়ে দিল, চিন্তার কিছু নেই। সে ভালই আছে।
সেদিন দু-একটা ফাইল এ ঘর থেকে ও ঘর আনা নেওয়া ছাড়া আর বিশেষ একটা কাজ কিছু ছিল না। ছুটির সময় পড়ল আবার ডাক। এবার স্যারের ব্যাগটা নিয়ে তার গাড়িতে রেখে দিয়ে আসতে হবে।

*                                              *                                              *
বাড়ি ফিরতে ফিরতেই অমিয় মনস্থ করে ফেলল আর একদিনও সে এ চাকরি করবে না। কালই সে রেজিগনেশন করবার জন্য যা করতে হয়, তা জেনে নেবে এবং সেইমত কাজ শুরু করবে। তবে মায়ের সাথে পরামর্শ না করে তো আর কোন সিদ্ধান্তে নেওয়া যাবে না। ঠিক করল, মায়ের কাছ থেকে অনুমতি নিয়েই সে এই চাকরি ছাড়বে। তবে মায়ের সম্মতি পাওয়াটা খুব একটা অসুবিধা হবে বলে তার মনে হলও না। একটু চাপ দিলেই, একটু অনুনয় করে বললেই মা সবটা বুঝতে পারবে। আর সেও মুক্তি পাবে এই নিরন্তর মানসিক নিষ্পেষণ থেকে।
সেদিন অমিয় বাড়ি ফিরল রাত সোয়া আটটায় বাড়িতে এসেছে পাশের বাড়ির আরতিকাকিমা। মায়ের পাড়াতুতো বন্ধু। প্রায়ই সে আসে মায়ের সাথে গল্প করতে। তবে বড্ড বেশি পিএনপিসি করে বলে অমিয়র তাকে বড় একটা ভাল লাগে না। আরতি কাকিমা অমিয়কে ফিরতে দেখে হাসিমুখে জিগ্যেস করল, ‘কি রে অমিয়, অফিস থেকে এই ফিরলি বুঝি?’ অমিয় মৃদু হাসি টেনে বলে, ‘হ্যাঁ, এই সময়েই তো ফিরি’। কাকিমা বলে, ‘তা বাবা, নতুন চাকরি কেমন লাগছে?’ প্রশ্ন শুনে অমিয়র প্রথমটায় বিরক্তি লাগে, তারপর সেটা ঢাকতে ম্লান হাসবার চেষ্টা করে ঘাড় নেড়ে জানায়, ‘ভাল’। তারপর সে পাশের ঘরে চলে যায়। ঘরটা অন্ধকার। সে আলো না জ্বেলেই অফিসের ব্যাগটাকে ঘরের একপাশে ফেলে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। শুনতে পায়, আরতিকাকিমা মাকে জিগ্যেস করছে, ‘তোমার ছেলের অফিসে কাজের চাপ কেমন গো?’
মা বলে, ‘কাজের চাপ তো তেমন কিছুই নেই। ঐ কয়েকটা চিঠি টাইপ করতে হয়, ব্যস এই অব্দিই’।
-      যাক, তাহলে ভাল। আমারটা যে কবে একটা চাকরি জোটাবে। আসলে কি জানো তো, ওর মাথা আছে, অথচ কিছুতে মন দিয়ে পড়বে না। এই হল সমস্যা। আর আজকের দিনে যা কম্পিটিশন। তাতে মন দিয়ে না পড়ে কি আর ভাল চাকরি পাওয়া যায়?
মা তাতে সায় দিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ, সেই। অনেক পরিশ্রম করতে হয়। আমার ছেলেও তো একবছর চাকরির জন্য চেষ্টা করেছে, তবে পেয়েছে। এতদিন শুধু টিউশানি করত বলে লোকে নানা কথা বলত, ‘কত আয় হয়’, ‘তোদের চলে কি করে’, ‘কিভাবে চালাবি সংসার’। যাক, এখন তো সেসব বলতে পারবে না। এখন আমি গর্ব করে বলতে পারব, ছেলে আমার সরকারী চাকরি করে।....

মা হয়ত আরো কিছু বলছিল। অমিয় আর থাকতে পারল না। বিছানা ছেড়ে উঠে সে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিলমায়ের কথা এখন আর শোনা যাচ্ছে না। এটাই একটা স্বান্ত্বনা। একটা দীর্ঘশ্বাস আর ঘরময় সব অন্ধকার। নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। অমিয় বুঝে নিল, তার গোপন দুঃখের একমাত্র সাক্ষী হিসেবে কেবল এই অন্ধকারটুকুই পড়ে রয়েছে।
:: সমাপ্ত ::

রবিবার, ১ জানুয়ারী, ২০১৭

প্রতিস্পর্ধী



আকাশটা তখনো গনগনে লাল। সন্ধ্যের পড়ন্ত বেলায় জায়গাটা নিস্তেজ হয়ে আসে। দু-একটা গাড়ির হুস হুস শব্দে সচকিত হয়ে ওঠে নিশ্ছিদ্র নিস্তব্ধতা। সাঁই সাঁই বেগে চলে গাড়িগুলো। তবু মেটে পথ ছেড়ে হাইরোডের রাস্তাটাই রোজ ধরে দৃপ্ত। এতে নাকি শর্টকাট হয়। হেঁটে হেঁটে রোজ এভাবে বাড়ি ফেরে সে। রাস্তার একধার দিয়ে সতর্ক হয়ে হাঁটতে থাকে। তবে আজ যেন সে কিছুটা অন্যমনস্কঅন্য কোন ভাবনায় সে তন্ময় হয়ে ধীরে ধীরে পা ফেলছে। পিছন থেকে একটা ট্রাক আসছে। হয় সে সেটা বুঝতে পারেনি, নয়ত বুঝে সরে এসেছিল। একটা জোর ধাক্কা লাগল পিছন থেকে। নিমেষে ছিটকে পড়ল তার দেহটা দুহাত দূরে।
     ট্রাকটা কিছুটা এগিয়ে থামল। তারপর ড্রাইভার তার খালাসীকে বলল, ‘খতম?’ খালাসীটা গাড়ি থেকে নেমে দৃপ্তর নাকের কাছে হাত নিয়ে গেল। তারপর ফিরে এসে জানাতেই, ড্রাইভার কাকে যেন  মোবাইলে ফোন করে বলে দিল, ‘চিন্তা নেই বস। কাম পুরা হো গয়া
        *                                                *                                         *
     বিজনুর সেন্ট্রাল লাইব্রেরি। বাড়ির থেকে মাধবকে এখানেই পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই ওরা আগে এখানেই এসেছিল। মাধব তখন বই পড়ছিল – ‘কেন আমি ধর্মবিরোধী?’ বার্ট্রাণ্ড রাসেলের হোয়াই আই অ্যাম নট অ্যা ক্রিশ্চিয়ান?’ বইটার বাংলা অনুবাদ। লাইব্রেরির নিস্তব্ধ একলা রিডিং রুমে ওদের পায়ের আওয়াজে সজাগ হয়ে ওঠে মাধব। পিছন ফিরে দেখে জনা তিনেক লোক। ওদের তিনজনের পকেটেই লাল রঙের গোলাপফুল গোঁজা। আর প্রত্যেকের মুখই বেশ ভয়ার্ত।
     মাধব ওদের তিনজনকেই চেনে। প্রথম দুজন শ্যামলকাকু আর নিশুদা। ওর বাবার পাড়াতুতো বন্ধু। আর অন্যজন সিধুবাবু। তিনি শুধু বাবার নন, সবাইকার বন্ধু। যথেষ্ট ভাল ও উপকারী মানুষ বলেই সবাই তাকে চেনে জানে। অঞ্চলের সবার সাথেই তার সদ্ভাব। সকলের বাড়িতেই তার আনাগোনা।
     শুরুটা করল শ্যামলকাকু। একটু কেশে নিয়ে, তারপর ঢোঁক গিলে, সে বলে, ‘মাধব, তোকে ... মানে তোর বাবার একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। তোকে এখনই হাসপাতালে যেতে হবে
     প্রথমটা শুনেই মাধব একটা শক খেল। তারপর বিস্ফারিত চোখে সে সিধুবাবুর দিকে তাকাল। সিধুবাবু বয়স্য ও ভরসাযোগ্য। তিনি কিছুটা আশ্বাস দিলেন, ‘বিশেষ কিছু চিন্তার নেই। তুমি এসো আমাদের সাথে। আমরা রয়েছি তো
     মাধব প্রথমটায় ভেঙে পড়ছিল। ওর ডান বাহু ধরে তুলে সিধুবাবু একটা ভাড়া করা ট্যাক্সি গাড়িতে চেপে বসলেন। সঙ্গে শ্যামলকাকু আর নিশুদা। আশ্চর্যের কথা, ট্যাক্সিটা কোন হাসপাতালের সামনে নয়, থামল বিজনুর পুলিশ স্টেশনের সামনে।
     মাধব সন্দিগ্ধ স্বরে বলে, ‘এখানে এলাম কেন?’ সিধুবাবু সেসবে উত্তর না করে ওকে নিয়ে প্রথমে পুলিশ স্টেশনের অফিস ও সেখান থেকে এক অফিসার আর দুই কনস্টেবল সহ মর্গে গেলেন। মাধব দেখল সাদা কাপড়ের চাদরে ঢাকা শায়িত মানবদেহ। শবের মুখ থেকে কাপড়টা সরানো হল। ডানগালটা তুবড়ে ভেঙে গেছে। ডানচোখ নিশ্চিহ্ন আর মাথার ডানপাশটা থেঁতলে গেছে। তবু মাধবের চিনতে অসুবিধা হল না এটাই তার বাবার দেহ। কিন্তু এবার আর মাধব আগের মত ভেঙে পড়ল না। 
      সেন্ট্রাল হাইওয়ের ধারে পড়েছিল বডিটা। সম্ভবত ট্রাক বা ম্যাটাডর জাতীয় কোন গাড়ি এসে পেছন থেকে ধাক্কা মেরেছে। স্থানীয় লোকেদের কাছে খবর পেয়ে আমি নিজে স্পটে গেছিলাম। এখন আপনাদের কাছে কিছু প্রশ্ন আছে। অত্যন্ত জরুরী সেগুলোপেশাদারী ভঙ্গীতে একটানা কথাগুলো বলে থামলেন ওসি। খাকি রঙের ইউনিফর্মের পকেটে তার গোলাপী গোলাপটা শোভা পাচ্ছে।
     টেবিলের ওধারে বসে তিনি। আর এপারে মাধব, সিধুবাবু, শ্যামলকাকু আর নিশুদা। সিধুবাবু মাধবের গার্জেন হয়ে নিজেই যেচে উত্তরটা দিলেন, ‘নিশ্চয়ই, আপনি প্রশ্ন করুন প্লিজ
-      যদিও আমরা জানি না, এটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট না অন্য কিছু, তাও বলছি, আপনারা কি দৃপ্তবাবুর এই মৃত্যুর ব্যাপারে কাউকে সন্দেহ করেন? ওনার কোন শত্রু থাকতে পারে বলে মনে হয়?
সিধুবাবু মুখ বেঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে হেসে বললেন, ‘কার শত্রুর কথা বলছেন আপনি? দৃপ্তর? হাঃ হাঃ। শুনলেও হাসি পায়। সত্যি কথা বলতে কি জানেন, ওর মত এত প্রাণখোলা মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি। আর এমন ভাল লোকের যে কোন শত্রু থাকতে পারে, এটা ভাবতে গেলেও উর্বর মস্তিষ্কের প্রয়োজন হয়
শ্যামলকাকুও তাতে সায় দেয়, ‘দেখুন স্যার, বন্ধু হিসেবে আমি ওকে যতটা চিনেছি তাতে ওর শত্রু থাকা প্রায় অসম্ভব। আমার তো মনে হয় এটা নিছকই একটা অ্যাক্সিডেন্টতারপর সে মাধবের দিকে ফিরে বলে, ‘তোর কি মনে হয় মাধু?’
মাধব ধীরে ধীরে বলতে শুরু করে, ‘আমার মনে হয় বাবাকে খুন করা হয়েছে। আসলে বাবা অনেক কিছুই পছন্দ করত না। অনেক কিছু মেনে নিতেও পারত না সে বিনা প্রশ্নে। অ্যাক্সিডেন্ট নয়, বাবাকে মার্ডারই করা হয়েছে।
সেদিন মাধব যখন বাড়ি ফিরল, রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা। সকালে রান্না করা ভাত ছিল, তরকারী ছিল। সে সেসব কিছুই খেল না। শোবার ঘরে বিছানায় সে খানিকক্ষণ বসে রইল। ভাবতে পারছে না সে কিচ্ছু। সিধুবাবু বলেছিল রাতটা ওনার বাড়িতে কাটাতে। কিন্তু সে তা চায়নি। বাবার মৃত্যুটা তাকে বড্ড ভাবিয়ে তুলছে। কি হয়েছে বাবার? অ্যাক্সিডেন্ট? নাকি খুন? পুলিশকে মার্ডারবললেও সে ব্যাপারটা নিয়ে নিজেও যথেষ্ট ধন্দে। রাতটা বড্ড একা লাগে তার। গতকালও যাকে সে জলজ্যান্ত অবস্থায় দেখেছে, সেই মানুষটাই আজ আর নেই একথা ভাবতেও মন চাইছে না। অনেকক্ষণ কাটল একথা সেকথা ভেবে। খানিকবাদে সে বাবার পড়ার ঘরে এল। বেশ বড় ঘরখানা। ঘরের মাঝখানে একটা ছোট গোল টেবিল। বাবা সেখানে লিখত। আর দেওয়াল ঘেঁষে রয়েছে গোটা চার-পাঁচ ছোটবড় আলমারি। বইয়ে ঠাসা সেসব। আর একটাতে বাবার লেখালিখির সরঞ্জাম। সেখানে প্রচুর খাতা, বই। বিভিন্ন রঙের কলম। মাধব এক-একটা খাতা খুলে খুলে দেখতে লাগল। প্রচুর লেখালিখি রয়েছে তাতেছোট ছোট হাতের লেখার অক্ষরগুলো যেন কালো পিঁপড়ের মত কিলবিল করে বেড়াচ্ছে হলুদ হয়ে যাওয়া পাতার ওপরে। খুব যত্ন নিয়ে লেখা সেগুলো। যদিও অপ্রকাশিত। মাধব সেসব লেখা উদ্দেশ্যহীনভাবে কতক পড়ল, কতক পড়ল না। পরে পড়বে বলে তাকে তুলে রাখল। হঠাৎ তার নজরে এল ঐ আলমারিরই অন্য একটা তাক। সেখানে কিছু চিরকুট। কিছু ছোট ছোট কাগজ আর তাতে বেঁকা বেঁকা লেখায় কিছু শব্দ যা মুখে আনা যায় না। এগুলো জোরে পড়া যায় না। এসব লেখা মানে মৃত্যুকে ডাকা নয় তো কি? মাধবের আর সন্দেহ রইল না, বাবাকে মার্ডারই করা হয়েছিল।
*                                                 *                                                   *
জায়গাটার নাম বিজনুর। এখানকার মানুষগুলো সবাই, কিংবা সবাই না হলেও প্রায় সকলেই গোলাপ ভালবাসে। গোলাপ তা সে লাল, নীল, গোলাপী, সাদা যে রঙেরই হোক না কেন। গোলাপ মাত্রেই বিজনুরের পরিচয়। এই পরিচয়ের ইতিহাস কোন বইতে লেখা নেই। কেউ বলতেও পারে না ভাল ভাবে। তবু কেউ কেউ বলে এ স্থানে কোন এক অজানিত কালে এক মহামারীর প্রকোপ ঘটেছিল। সমস্ত অঞ্চলের মানুষ সেই মহামারীতে উজাড় হয়ে যেতে বসে। ঠিক এমন সময়ে এক বিদেশী সেখানে এসে একটা গোলাপের চারা পোঁতে। মানুষের ধারণা, সেইদিন থেকেই মহামারী লুপ্ত হয়ে যেতে থাকে। যারা মৃত্যুশয্যায়, তারা তো বেঁচে গেলই আর যারা তখনও সুস্থ তাদের আর নতুন করে রোগে ধরল না। তবে সেই মহামারী, সেই বিদেশী, সেই গোলাপ সবই আজ সত্যে মিথ্যে মিথে মিশ্রিত হয়ে মানুষের বিশ্বাসে এসে ঠেকেছে। পৌরাণিক গাথার মতই তা আজ ইতিহাস অথচ বিশ্বাস।
যাই হোক, বিজনুরের মানুষ তাই গোলাপ ভালবাসে। হয়ত সেই পৌরাণিক কাল থেকেই বাসে, কিংবা মন্দ বাসে না, কিংবা তাদের তা ভালবাসতে হয়। সিধুবাবু যখন প্রতিবেশী শ্যামলের বাড়িতে যান তার হাতে থাকে লাল গোলাপ। শ্যামলের কাছেও গোলাপ। দুজনেই গোলাপ দিয়ে আগে দুজনকে সম্বোধন করেন তারপর শুরু হয় বাক্যালাপ। বাড়িতে পোস্টম্যান চিঠি বিলি করতে এলে তার হাতেও গোলাপ, বাড়িতে ঝি কাজ করতে এলে তার ব্লাউজে গোঁজা থাকে গোলাপ, নিশুদা অফিসে গেলে তার হাতে থাকে গোলাপ, অফিসের টেবিলে ফুলদানি হলুদ গোলাপ তাতে, বসের আবার পছন্দ সাদা গোলাপ সে তার অফিসঘরে সাজিয়ে রাখে, বাসে কণ্ডাক্টার ভাড়া চাইতে এলে দেখবে তার পকেটেও মুখ উঁচিয়ে রয়েছে কমলা গোলাপ।
বিজনুরে গোলাপের চাষ হয়। হেক্টরের পর হেক্টর জমি শুধু গোলাপের চাষ হয়। সে জমিকে পাহারা দেওয়ার জন্য দিনরাত নিযুক্ত অতন্দ্র অগণিত প্রহরী। এদিকে গোলাপবাজারে থরে বিথরে লক্ষ লক্ষ টাকার গোলাপ বিকোয় প্রতিদিন। ভোর হতেই ফেরিওয়ালার অবিশ্রান্ত হাঁকে ঘুম ভাঙে সকলের। একটা গোলাপ চার টাকা। বাড়ির প্রতি সদস্য পিছু একটা করে গোলাপ। বাজারে গেলে তুমি তিন টাকায় পাবে। যাদের বাড়ি বাজারের কাছে কিংবা অবস্থা যাদের ততটা ভালো নয় তারা বাজার থেকেই কেনে গোলাপ। বাকীরা কিছুটা আলস্যে কিছুটা অনাগ্রহে ফেরিওয়ালার ভরসাকেই করে সম্বল।
দৃপ্ত গিয়েছিল শ্যামলের বাড়ি। অফিস থেকে ফিরে তার খোশগল্প করতে যাওয়ার অন্যতম স্থান। সেদিন সে গিয়ে দেখে শ্যামলের মুখ উদ্বিগ্ন। ঘটনাটা হল, পাশের গলিতে থাকে দীপঙ্কর। বছর চল্লিশেক বয়স। গতকাল বাজার করতে গিয়ে সে অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। মোটরসাইকেল অ্যাক্সিডেন্ট।
-      কিভাবে যে চালায় না এই বাইকগুলো। যেভাবে পারল, যা পারল ভুস ভুস করে চালিয়ে দিল। লোকজন দেখার দরকার নেই। নিধুদা মন্তব্য করে।
দৃপ্ত প্রশ্ন করে, ‘জনার্দন রোডে মারা গেল? সেখানে তো বিশেষ একটা মোটরসাইকেল চলে না?’
শ্যামল বলে ওঠে, ‘চলে না, কিন্তু গতকাল চলেছিল
-      কেসটা দেখছি ধাঁধাঁলো! জানিস তো, দীপঙ্করও কিন্তু গোলাপ পছন্দ করত নাদৃপ্ত বলে বসে।
-      আর কি, তোমারই মত একটা গাধা। যখন যেখানে যেত, একটাবারও গোলাপ দেখতাম না পকেটে। ঐ ফুল ছাড়া কি আর বিজনুরের লোকেদের মানায়? শ্যামল বলে।
-      তাহলে তুইও বলছিস গোলাপ পছন্দ করত না বলেই ওকে প্রাণ দিতে হল?
শ্যামল আমতা আমতা করে, ‘দেখো আমি আর তার কি জানি? পুলিশ তো অ্যারেস্ট করেছে একজনকে। দেখাই যাক না কি হয়?’
এমন সময় নিধুদা বলে, ‘কি দরকার বাপু পছন্দ না করে। শুধু শুধু নিজের বিপদ নিজে বাড়ানো। এমন ঘটনা তো আর এখানে প্রথম নয়। আগে থেকে তাই সাবধান হয়ে চলাই ভাল।
দীপ্ত আশ্চর্য হয়ে বলে, ‘তার মানে আমি একটা জিনিস পছন্দ করি না, আমি একটা কাজে সায় দিই না, আর আমার সেটা বলবার কোন হক নেই?
শ্যামল সেই আগের সুরেই বলে, ‘কে বলেছে নেই? তুমি কমলা না ভালবাসো, নীল গোলাপ তো বাসবে। লাল গোলাপ তোমার পছন্দ না হতেই পারে, কিন্তু হলুদ গোলাপও পছন্দ নয়?
-      কি মুশকিল! আরে বাবা, চয়েস তো এর বাইরেও থাকতে পারে। কোথায় লেখা আছে, দেখা তো দেখি, যে ভাল না লাগলেও বলতে হবে গোলাপ ভাল লাগে? পারবি দেখাতে?
-      সবই কি আর লেখা থাকে গো? ওগুলো বুঝে নিতে হয়। বুঝে, মেনে নিয়ে চুপ করে থাকতে হয়। নইলেই বিপদ।
-      কিন্তু কেন? .................
মাঝে মাঝে বিতর্ক চলতে চলতে রাত এগারোটা সাড়ে এগারোটা বেজে যেত। মায়ের কেবলই ভয় লাগত, বাবার কিছু হল বুঝি। সে চিন্তায় চিন্তায় বহু রাত কাটিয়েছে বিনিদ্র।
মাধবের মা যতদিন ছিল তবু চলেছিল একরকম। ক্যান্সারে মারা গেল মা। বাবার প্রকাশ্যে এ কথা বলতে আর কোন বাধা রইল না যে সে গোলাপ ভালবাসে নাআগে মা শুনলেই মুখে আঙুল চাপা দিয়ে বলে উঠত, ‘চুপ কর, চুপ কর। কে কখন শুনে ফেলবে তার নেই ঠিক
তবু বাবা তার নিজের মতমাফিক বলে চলত, ‘আরে এত ভয় নিয়ে বাঁচা যায় নাকি? কিভাবে যে থাকো তোমরা, ভেবে পাই না
বাবা না চাইলেও সে বাড়ি থেকে বেরোবার সময় তার পকেটে মা ঠিকই ঢুকিয়ে দিত লাল কিংবা নীল গোলাপতবু বাবা যে সেসব পছন্দ করত না তা অনেকেই বুঝে ফেলেছিলবিশেষত বাবার ঐ বেপরোয়া স্বভাবের জন্য বাবার বন্ধুসংখ্যাও ছিল নিতান্ত অল্প।

মায়ের ভাগ্যটা ছিল ভাল। তাই বাবার মৃত্যুটা তাকে দেখে যেতে হয়নি। মারা যাওয়ার ঠিক একদিন আগে মাধবকে একবার ডেকেছিল সে। মাধব তখন রান্নাঘরে ভাতের ফ্যান গালছে। বাবার অস্পষ্ট স্বর শুনেই সন্দেহ দানা বেঁধেছিল, ঘরে গিয়ে দেখল বাবা বিছানায় শুয়ে আছে। ঘরে জ্বলছে একটা টিমটিমে নাইটলাইট। কি ব্যাপার? এখন সবে রাত নটা, এই অবেলায় শুয়ে পড়ার লোক তো বাবা নয়। লেখালিখির কাজ না থাকলেও নিদেনপক্ষে সে পড়াশুনোটা চালিয়েই যায়। রাত এগারোটার আগে তো শোয়ার কোন প্রশ্নই নেই। তবে আজ কি তার কোন অসুখ করেছে?
না রে, অসুখ নয়। তবে ভাল লাগছে না। তোর মায়ের কথা মনে পড়ছে। সে থাকলে তাও দুটো কথা বলতে পারতাম। তুই ছেলেমানুষ, তোকে আর কি বলব। তবে এটুকু বলে রাখি, কিছু লোকের থেকে দূরে দূরে থাকাই ভাল। সবাই কিন্তু আমাদের ভাল চায় না। এটা জেনে রাখিস।
-      তুমি এইসব কথা বলছ কেন? কি হয়েছে তোমার বল তো?
-      না রে, আজ নয়, পরে একদিন বুঝিয়ে বলব।
মাধব সেদিন ভেবেছিল বাবার হয়ত মায়ের কথা মনে পড়ছে আর তাই তার অমন স্মৃতিমেদুর ভাব। কিন্তু সে ভুল যখন তার ভাঙল, তখন আর কিছুই করার নেই।
        *                                          *                                                         *
বিজনুরের মানুষ তাই গোলাপ ভালবাসে এই ভালবাসা দিয়েই তারা বাঁচতে শিখেছে। তাদের জীবনে হাসি-কান্না আছে, আনন্দ-দুঃখ আছেক্ষুধা-তৃষ্ণা-নিদ্রা আছে। নিদ্রা ভাঙিয়ে সকাল আছে। তাছাড়া অফিস করা, সংসার করা, বাজার করা কিংবা টিভি দেখা সবই আছে। শর্ত শুধু একটাই। ভালবাসতে হবে গোলাপফুল। এটাই হল তোমার পরিচয়। আর যারা তা ভালবাসে না, তারা হঠাৎ হারিয়ে যায় বিজনুর থেকে। কেউ তাদের কোন খোঁজ পায় না। কিংবা তাদের দেহে বাসা বাঁধে কোন দূরারোগ্য ব্যাধি বিজনুরের কোন ডাক্তার যা সারাতে পারে না। তাও যদি না হয়, তবে দীপঙ্কর বা দৃপ্তর মত একটা গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট। আর তাতেই সব শেষ। ঘাতক গাড়িটাকে ধরবার জন্য পুলিশ হন্যে হয়ে চেষ্টা করে। হয়ত দু-একটা চুনোপুঁটি জালে ওঠেও। কিন্তু ব্যস, তারপরই সব চাপা পড়ে যায়। কিছুদিন পর জানা যায় কেস ক্লোজড।
তবে এইসব ব্যতিক্রমী ঘটনা নিয়ে বিজনুরের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তত চিন্তিত নয়। সাধারণভাবে, স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকতে পারলেই তাদের হল। আর শুধু তো গোলাপের প্রতি একটু ভালবাসা দেখানো। গোলাপ তো কত সুন্দর ফুল, তাকে আবার না ভালবেসে পারা যায় নাকি! আর যারা তাও ভালবাসে না, তাদের গোলাপ-পিরীতির একটু ভান করলেই তো হল। ল্যাঠা চুকে যায়। এ আর এমন কি কঠিন কাজ?
কিন্তু মুশকিলটা হল তাদের নিয়ে যাদের সংসার থেকে হারিয়ে যায় ছেলে কিংবা ভাই কিংবা বোন কিংবা কারুর বাবা বা স্বামী তারাই কেবল বোঝে প্রিয়জনকে হারাবার কষ্টটা। তারা প্রতিবাদ করে, প্রতিরোধও গড়ে তোলবার চেষ্টা করে অল্পবিস্তর। কিন্তু তাদের সে প্রতিবাদ সমুদ্রে জলবিন্দুবৎ - কেউই তা শোনে না। আর শুনলেও সেসব ঝামেলা সবাই এড়িয়েই যেতে চায়।
তবে এদিক থেকে মাধবের ব্যাপারটা কিছুটা আলাদা। সে মাকে হারিয়েছে আগেই। সম্বল বলতে তার ছিল কেবল বাবাই। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব কারুর সাথেই মাধবের বড় একটা খাতির নেই। হয়ত তা অনেকাংশে তার মতাদর্শের জন্যই। সে চিরকালই নিজের পথে নিজের মতে চলতেই ভালবাসে। লাইব্রেরীটাকে ভালবাসে, ভালবাসে পুরনো বইয়ের গন্ধ। গোলাপ তারও ভাল লাগে না কোনদিনই। তবু কোনদিন সে এ ব্যাপারে সক্রিয় হয়ে ওঠার কথাও ভাবেনি। কিন্তু আজ যে তার শেষ সম্বলটাও হারিয়ে গেল। সে কাউকে আজ আর বাবাবলে ডাকতে পারবে না। প্রিয়জন আর কেউ নেই তার। তার হারাবার কিছুই রইল না। যাদের সঙ্গী-সাথী আছে, তাদের হারাবার ভয় আছে। কিন্তু মাধবকে ভয় পাওয়ানোর মত ক্ষমতাও আজ কারুর নেই।    
দৃপ্তর মৃত্যুর পর অন্তত ১৫টা দিন কেটে গেছে। কিন্তু পুলিশের তরফ থেকে মাধব কিছুই জানতে পারেনি। অথচ অফিসার নিজেই সেদিন বলেছিলেন, সন্দেহভাজন কাউকে পেলেই উনি জানাবেন। তার মানে আজ এই এতদিন পরেও কাউকেই পাওয়া গেল না? নাকি ওনারা শুধু কথার কথাই দিলেন? মাধব এ কদিনে বেশ কিছু কাজ করেছে। বিশেষ করে বাবার ঐ লেখাগুলো পড়েছে। বাবা যে গোলাপ পছন্দ করত না সেখানে শুধু সেই কথাই নেই, বরঞ্চ দীপঙ্করের মত আর অনেকের কথা সেখানে লেখা আছে যারা তারই মত ছিল গোলাপ বিরোধীবাবা তাদের জন্য কাজ করতে চেয়েছিল। আসলে অপছন্দ করবার জন্য কাউকে যে খুন হতে হবে, এটা বাবা মেনে নিতে পারেনি। তাই সে তার নিজের এই অপছন্দটাও জোরদার করে প্রচার করতে চেয়েছিল। তার সে কাজ অসমাপ্তই রয়ে গেল। তাই মাধব ঠিক করেছে, পুলিশের কাছে গিয়ে আগে সে জানবে ইনভেস্টিগেশন কতদূর এগিয়েছে। যদি সম্যক উত্তর পায় তো ঠিক আছে, না হলে সে নিজেই বাবার কাজগুলো করবার দায়িত্ব নেবে।
     মাধব যখন পুলিশের সাথে দেখা করতে গেল, বড়সাহেব তখন টিফিনে। তাই আধঘন্টা বাইরে অপেক্ষা করে তবে সে ভেতরে ঢোকার অনুমতি পেল।
-      স্যার, আমার বাবার কেসটা কতদূর এগোল জানতে পারি? মাধবের প্রথম সরল প্রশ্ন।
অফিসার সাহেব তখন সিগারেট ধরানোয় নিমগ্ন। চোখ তুলে মাধবকে দেখে ধোঁয়া ছেড়ে উত্তর দিলেন, ‘হবে হবে। তদন্ত চলছে। প্রয়োজনমত সব ঠিকই জানিয়ে দেওয়া হবে। আর এইভাবে হঠ করে অফিসারের ঘরে ঢুকে পড়বে না। এটা একটা অফিস, এখানে একটা নিয়ম আছে
মাধব সেসবে উত্তর না করে বলে, ‘কিন্তু আমি আমার বাবার খুনীদের পেতে চাই। যে করে হোক, যা করতে হয় আমি করব
অফিসার কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, তুমি সিওর এটা অ্যাক্সিডেন্ট নয়। খুন?
-      হ্যাঁ স্যার, আমি সিওর। মাধবের স্বর কঠিন হয়ে আসে।
-      তবে আর কি, নিজেই লেগে যাও সার্চে। সবই তো জেনে বুঝে গেছ দেখছি। মনে হচ্ছে, নিজেই সব করে নিতে পারবে। তাচ্ছিল্যের সুরে কথাগুলো বলে অফিসার মাধবকে ভাল করে পড়ে নেন একবার। তারপর বলেন, ‘শোন, তোমার বয়স বেশি নয়, তাই বলছি। তুমি এসব ব্যাপারে আর নিজের নাক গলিও না। কেমন? তোমার বাবার কেসটা যখন আমাদের হাতে পড়েছে, তখন একটা কিছু হবেই। কিন্তু সবকিছুরই তো একটা নিয়ম থাকে। এটা বাচ্চার আবদার নয় যে হুটহাট করে চাইবে আর অমনি খুনীরা নিজেরাই এসে ধরা দেবে। কিছু বুঝলে? আর পকেটে গোলাপ নেই কেন? অ্যাঁ?
শান্ত স্বরে মাধব বলে, ‘গোলাপ আমার ভাল লাগে না স্যার
কথাটা যে অফিসারের মনপসন্দ হল না তা তার মুখ দেখেই বোঝা গেল। তবে মুখে তিনি প্রথমেই কিছু বললেন না। কিন্তু কথা বলতে বলতেই তাঁর মেজাজ গেল চড়ে, ‘বেশ ঠিক আছে। যা ভাল লাগে কর। তবে আমাদের আর এসব ব্যাপারে জ্বালিও না। অনেক সহ্য করেছি। অন্য কেউ হলে এখনই ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দিতাম। নেহাত তোমার বাবা মারা গেছে। আমাদের ভেবেছো কি তোমরা বলতে পারো? বয়স কত তোমার? এই বয়সে পুলিশকে তাগাদা দিতে এসেছো? সাহস তো কম নয়। বেরোও এখান থেকে। গেট আউটউত্তেজনার পারদ চড়তে চড়তে অফিসার একেবারে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। মাধব প্রথমটায় বুঝতে পারেনি, অফিসার অত রেগে গেলেন কেন?
সে ধীর পায়ে বেরিয়ে এল পুলিশ স্টেশন ছেড়ে। আর এ কথাও সে বুঝে গেল এখানে আর তার আসা হবে না। এদের কাছ থেকে কোন সাহায্যই সে পাবে না। সে তাই ঠিক করল নিজেই যা করার করবে। আইন যদি এক্ষেত্রে তাকে সাহায্য না করে, তবে সে নিজেই আইনকে নিজের হাতে তুলে নেবে। বাবার শেষ না করতে পারা কাজগুলো শেষ করবার সংকল্প নিল সেকিন্তু ভয়ঙ্কর সেসব কাজ। সেখানে প্রতি মূহুর্তে জীবনের ঝুঁকি। হয়ত বাবার মতই মৃত্যু তাকেও ছিনিয়ে নিয়ে যেতে পারেযে কোন দিন

এরপর থেকে আশ্চর্য রকমের পরিবর্তন দেখা গেল মাধবের মধ্যে। তার চোখদুটো আজকাল কেমন যেন চিতাবাঘের মত ঘোলাটে আর হিংস্র হয়ে উঠছে। নিজের নাম সে বলতে শুরু করেছে স্বাধীন। বস্তুত এটাই তার প্রকৃত নাম। স্বাধীন কুমার সান্যাল। স্কুলে ভর্তি নেওয়ার সময়ে হেডস্যার এই নাম দেখে ভর্তি নিতে চাননি। সরাসরি না বললেও রাশভারী স্বরে জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘আমি দুঃখিত, আমাদের স্কুলে স্বাধীন’-এর কোন জায়গা নেই। সিট খুব কমশেষে মাধবের এক কাকা চরণদাস ওর এই নাম রেখে ওকে স্কুলে ভর্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। যদিও দৃপ্তর এতে আপত্তি ছিল বিস্তর।
মাধব এখন প্যামফ্লেট সাঁটে, চিরকুটে লিখে ছড়িয়ে দেয়, ‘গোলাপ চাই না’, ‘গোলাপ ভালবাসি নাইত্যাদি। অশ্বত্থের গুঁড়িতে, বটের ঝুড়িতে, পুকুরের শানবাঁধানো পাড়েতে, দেওয়ালের গায়েতে ছড়িয়ে পড়েছে অজস্র কাগজে লেখা ভয়ঙ্কর সব কথা। সমাজের শান্তিপ্রিয় ভদ্রজনেরা বেজায় চটেছে এতে। কিছু লোকের পাগলামিতে আমাদের দেখছি বাঁশ হবেজানটা আর থাকবে নামন্তব্য পাড়ার লোকেদের। তবু বন্ধ করা যায় না, উত্তরোত্তর বেড়েই চলে এই পাগলামি।
সেদিন সন্ধ্যেবেলা। মাধব সেদিন বাড়িতেই ছিল। কোন চিন্তায় আটকে ছিল সে সেদিন। হঠাৎ কলিংয়ের ঘণ্টায় ভাবনার সুতোটা গেল ছিঁড়ে। দরজা খুলতেই দেখা গেল সিধুবাবুকে। সৌম্য, শান্ত চেহারা। পরনে সাদা ধুতি পাঞ্জাবী। আজ সিধুবাবুকে যেন কোন সাধুপুরুষ মনে হচ্ছে। সঙ্গে এসেছে শ্যামলকাকু।
আরে আসুন, আসুন বসুন জেঠুঘরেতে ডেকে চেয়ার টেনে সিধুবাবু আর শ্যামলকাকুকে বসতে দেয় মাধব। তার এই দূর্লভ আতিথেয়তা দেখে একটু বিশেষ বিস্মিত হলেন দৃপ্তর অন্যতম সম্মানীয় এই মানুষটি।
ঠিক আছে, ঠিক আছে। তুমিও বোসো। চেহারাটার কি হাল হয়েছে তোমার? বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে নাওয়া খাওয়াও ভুলেছ দেখছিএকটু থেমে সিধুবাবু আবার বলেন, ‘আরে অত চিন্তার কি আছে? আমরা তো তোমার মাথার ওপরে আছিই। আর তাছাড়া পুলিশ অনুসন্ধান চালাচ্ছে
-পুলিশের ওপর আমার কোন আস্থা নেই জেঠু। মাঝখান থেকে কথাটা বলেই থেমে গেল মাধব। তার পুলিশ স্টেশনে যাওয়ার ব্যাপারটা কৌশলে এড়িয়ে গেল, ‘আমি আমার বাবার কিছু কাজ করে চলেছি মাত্র। এতে আমার শরীর ভাঙলেও কিছু করার নেই। আমাকে এ করতেই হবেশেষ কথাগুলোর মধ্যে দিয়ে কঠিন একটা সুর বেজে উঠল।
সিধুবাবু সেই ইঙ্গিতটা পড়তে পারলেন কিনা বোঝা গেল না। মাধবকে বললেন, ‘দেখো আমি তোমার বাবার মত। তোমায় একটা ভাল কথা বলি। কিছুদিনের জন্য বাইরে কোথাও ঘুরতে টুরতে যাও। তাহলে দেখবে মনটা অনেক হালকা হয়ে গেছে
শ্যামলকাকু জুড়ে দেয়, ‘উনি না হয় তোকে একটা থাকার ব্যবস্থাও করে দেবেন। কি রে যাবি বল?
মাধব অবাক হয়ে সিধুবাবুর দিকে তাকায়। জেঠু, আপনি ভাবতে পারছেন? আমার বাবা খুন হয়েছে। আর আমি এখন ঘুরতে যাব? ফুর্তি করব?’
সিধুবাবু বলেন, ‘তোমার কি এটা খুন ছাড়া অন্য কিছুই মনে হয় না? হতেও তো পারে এটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট?’
-      একথা আপনি বলছেন জেঠু? আপনি তো আমার বাবাকে ভালমতই চিনতেন। আপনি কেন বুঝতে পারছেন না এটা খুন না হয়ে পারে না। বিজনুরে যারা গোলাপ ভালবাসে না, তাদের যে বেঁচে থাকারও অধিকার কেউ দেয় না।
-      জানি না, ভাই। আমি তো শুধু একটা সম্ভাবনার কথা বললামবাকী কাজ, আমার বিশ্বাস, পুলিশই করবে। তবে আমি বলব, তুমি এখন কিছুদিন বিশ্রাম নাও। এটাই তোমার পক্ষে ভাল হবে।
-      পরামর্শ দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু আমি যেটা করছি, সেটা আমার কর্তব্য। আমার বাবার শেষ না করতে পারা কাজ আমি করছি। এতে ভুল কিছু নেই।
শ্যামলকাকু এবার বলে ওঠে, ‘নাঃ মাধব। তোকে দেখছি আর ঠিক করা গেল না। তোর ভাল জন্যই বলা হল। এবার ভেবে দেখ তুই কি করবি। সারাদিন প্যামফ্লেট সেঁটে বেড়ালেই যদি তোর বাবার খুনীরা ধরা পড়ে তো সাঁট। আমরা আর বারণ করব না
এবার সিধুবাবু নিজের উরুতে একটা হাল্কা চাঁটি মেরে উঠে দাঁড়ালেন, ‘নাঃ শ্যামল চলো এখন। আসি মাধব। ভাল থেকো। আর শরীরের ওপর যত্ন নিও
সিধুবাবু সেদিন বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকে মাধব যেন আরো হতাশায় ডুবে গেল। সে একটা ভাল লোকের খোঁজে ছিল যে তাকে সুপথ দেখাবে। তাই বাবার শ্রদ্ধেয় হিসেবে সিধুবাবুকে সে একটা আশ্রয়স্থল ভেবেছিল। কিন্তু তার কাছ থেকেও সে কোন আশার কথা শুনতে পেল না, এর থেকে দুঃখের আর কি হতে পারে? মাধব দেখেছে, এই সিধুবাবুই তার মায়ের অসুস্থতার সময়ে তাদের কত সাহায্য করেছে। সিধুবাবুর এক ডাকে পাড়ার ছেলেরা এসে মাকে হাসপাতালে ভর্তি করে দেওয়া, হাসপাতালে ভাল ডাক্তারের খোঁজ দিয়ে দেওয়া সব দেখেশুনে সিধুবাবুকে ওদের ভগবান বলে মনে হয়েছে। কিন্তু আজ তিনিই কেন তার বাবার মৃত্যুর ব্যাপারটা এড়িয়ে যেতে চাইছেন? অঙ্কটা কিছুতেই মাথায় ঢোকে না মাধবের।
বাবার আর বন্ধুরা শ্যামলকাকু, নিশুদা এদের তো আরোই ভরসা করা যায় না। যতই মাধব এসব ভাবে, আরো একা মনে হয় নিজেকে। সে শুধু একা কি করবে? কিভাবে করবে? কিচ্ছু মাথায় আসে না তার। টেবিলে কনুই রেখে ভর দিয়ে হাতের তালুদুটো দিয়ে মাথাটাকে ধরে রাখে সে। পিছনে দরজা হাট খোলা। কোন খেয়াল নেই।
আর সেই খোলা দরজা দিয়েই ওরা এল। ওরা, মানে কতকগুলো লোক। মাধব তাদের চেনে না। কোনদিন দেখেওনি তাদের বিজনুরে। সবথেকে আশ্চর্যের কথা, ওদের কারুর কাছে গোলাপ দেখতে পেল না সে।
*                                                     *                                                          *
কয়েকদিন ধরে বিজনুরে দেখা যাচ্ছে এক আশ্চর্য্য কাণ্ড। গোলাপফুলগুলোকে কে বা কারা যেন ছিঁড়ে দিয়ে যাচ্ছে। চারিদিক ভরে উঠছে ফুলের টুকরোয়। সবার মধ্যেই এতে বেশ একটা আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। কারণ গোলাপফুল ছিঁড়ে দেওয়ার মত সাহস এখানে এর আগে কখনও কেউ দেখায়নি। বিজনুরে গোলাপকে অপমান করবার স্পর্ধা কারুর হয়নি এর আগে। কারা আছে এর পেছনে? মাধব? ওর সাহস এত বেড়ে গেল? রাস্তা দিয়ে চলতে গেলেই পায়ে মাড়াতে হচ্ছে গোলাপের ছিন্ন অংশ। ছিঃ! এও বিজনুরের লোকেদের সহ্য করতে হল! পুকুরে কচুরীপানার মত ভেসে বেড়াচ্ছে গোলাপের লাল, নীল, হলুদ পাঁপড়ি। রাস্তার ধারগুলো সুশোভিত হয়ে উঠেছে ছেঁড়া গোলাপের বোঁটায়, ডালে, পাঁপড়িতে, পরাগে। এভাবে তো চলতে পারে না। কিছু একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। মত অনেকেরই।
সেদিন বিকেলের শেষবেলায় বিজনুরের রাস্তায় দেখা গেল থানার ওসিকেসাথে দুজন কনস্টেবল নিয়ে সার্চে বেরিয়েছেন। রাস্তার ধারে গোলাপের টুকরো তারও নজর এড়ালো না। দেওয়ালে সাঁটা পোস্টার, প্যামফ্লেটে লেখা শব্দগুলোও পড়লেন তিনি। তারপর বুক পকেট থেকে নোটবুক বার করে কিসব লিখে রাখলেন তিনি
তাঁর পেছন থেকে একটা পরিচিত কন্ঠ ভেসে এল, ‘আর দেরী করাটা মনে হয় ঠিক হবে না
পিছন ফিরে তাকিয়ে সম্মতির ভঙ্গীতে ঘাড় নাড়ালেন ওসি।
*                                                     *                                                          *
আজ অনেকদিন পর লাইব্রেরীতে এসেছে মাধব। বইয়ের ঘরে এসে আবার তার পুরোনো মেজাজটা যেন ফিরে এসেছে। ভাল লাগছে আজ বইয়ের ছোঁয়া পেয়ে। তার সামনে আজ খোলা বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ। বইয়ে নিজেকে নিমগ্ন রেখেই বেজে গেল রাত আটটা।
লাইব্রেরীর বিশাল হলঘরে ওপার থেকে লাইব্রেরীয়ানের গলা পাওয়া গেল, ‘লাইব্রেরী এখনই বন্ধ হবেমাধব এতক্ষণে লক্ষ্য করল লাইব্রেরীতে সে শুধু একা। বই জমা দিয়ে সে ধীর পায়ে লাইব্রেরী থেকে বেরোতেই হঠাৎ থমকে গেল। সামনে দাঁড়িয়ে সিধুবাবু। তবে আগের মত আর শান্ত সৌম্য চেহারা নয়। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখে উদ্বেগ স্পষ্টআর সন্ধ্যেরাতের এই অন্ধকারে বেশ অস্পষ্টও দেখাচ্ছে। কিন্তু হঠাৎ এভাবে সিধুবাবুর সাথে দেখা হয়ে যাবে, ভাবতে পারেনি মাধব। আপনি এখানে, হঠাৎ এভাবে?’ কথাগুলো মাধব ঠিক গুছিয়ে উঠতে পারল না।
-      চমকে উঠলে বুঝি? আসলে আজকাল তো বাড়িতে তোমার দেখা মেলাই ভার। কাজে কম্মে থাকো। তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিল। সেই কারণেই এখানে আসা। চলো হাঁটতে হাঁটতে বলা যাবে
কথাগুলো মাধবের ঔৎসুক্য আরও বাড়িয়ে তুলল। সিধুবাবু নিজে থেকে যেচে এতদূর এসেছেন। তাও আবার এত রাতে। নিশ্চয়ই কোন গুরুত্বপূর্ণ কথা। মাধব বলে, ‘বেশ তো বলুন
-      দেখো তোমার বাবা মারা গেছেন বেশ কিছুদিন তো হল। এবার তার পারলৌকিক ক্রিয়াটা সারার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। চলো ঐ জোড়া বটতলার রাস্তাটা ধরি।
-      কিন্তু ওদিক দিয়ে গেলে তো ঘুরপথ হবে।
-      তা হোক, তোমার সাথে কথাগুলো আগে সারি। হাঁটাও হবে, কথা বলাও হবে। তা যেটা বলছিলাম ...’
মাধব এর আগে যে তার বাবার শ্রাদ্ধের ব্যাপারটা নিয়ে ভাবেনি তা নয়। কিন্ত সে, তার বাবা, তার গোটা পরিবারই নাস্তিক। মাধব বাড়িতে না দেখেছে কোন বিগ্রহ, না দেখেছে মা-বাবাকে কোন আচার পালন করতে। কাজেই বাবার শ্রাদ্ধ না করে একটা স্মরণসভা করলেই তো হল। সিধুবাবুকে কথাগুলো সে নিজেও বলবে বলে ভেবেছিল। তবে এখন যা পরিস্থিতি তাতে মাধবের মাথা থেকে সব ঠাণ্ডা চিন্তাই গেছে উবে। না হলে বাবার একটা স্মরণসভা সে তো করতেই চেয়েছিল।
তবে সিধুবাবু যে এই ব্যাপারটা মন দিয়ে ভেবেছেন, ভেবে এতদূর তার জন্য এসেছেন। এতটা দায়িত্ববোধের পরিচয় পেয়ে তাঁর প্রতি মাধবের শ্রদ্ধা দ্বিগুণ বেড়ে গেল।
হাঁটতে হাঁটতে মেন রোড ছেড়ে তারা এসে পড়ল বটতলার রাস্তায়। ঢালাই রাস্তাটা যথেষ্ট সরু আর ভাঙাচোরা। দুধারে আগাছার ঝোপ আর নীচু জলা জঙ্গল। সিধবাবুর অবশ্য সেসবে ভ্রূক্ষেপ নেই। তিনি অনর্গল বলে চলেছেন কোন দিন কিভাবে অনুষ্ঠান করা যায়। কেমনভাবে সেসব ব্যবস্থা করতে হবে সেসব নিয়ে। মাধব অপেক্ষা করছিল সিধুবাবুর কথা কখন শেষ হবে, আর সে তখন তার নিজের কথা পাড়তে পারবে।
ঠিক এমন সময় রাস্তায় থমকে দাঁড়াতে হল তাদের। সামনে পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে তিন-চারজন ষণ্ডামার্কা লোক। প্রত্যেকের হাতে লাঠি, রড। একজনের হাতে দড়িও আছে। মাধব সভয়ে প্রশ্ন করে, ‘আপনারা কারা?’
-      তোর যম। দড়ি হাতে লোকটা কর্কশ গলায় উত্তর দিল। তারপর একজন মাধবকে জাপ্টে ধরল আর সঙ্গে সঙ্গে দড়ি দিয়ে মাধবের হাত পা বাঁধা হল। তার মুখ বাঁধা হল ব্যাণ্ডেজ দিয়ে। মাধব ছটফট করতে থাকে ক্রমাগত।
সে প্রাণ পণে চেঁচাতে থাকে। যদিও মুখে ব্যাণ্ডেজের জন্য তার কণ্ঠস্বর ক্ষীণ। সে সিধুবাবুর দিকে তাকায়। তিনি কি তাকে উদ্ধার করবেন না?
কিন্তু সিধুবাবু! তিনি যে আগের মতই শান্ত। ধীর পায়ে মাধবের দিকে এগিয়ে এলেন তিনি। আমি দুঃখিত মাধব। তোমায় অনেকবার ওয়ার্নিং দিয়েছিলামতোমার বাবাকেও দিয়েছিলাম। কিন্তু তোমারা শোননি আমার সেসব কথা। আজ যা হবে, তার জন্য আমাকে যেন দোষ দিও না। তোমরাই আমাকে এসব করাতে বাধ্য করালে
    মাধবের চোখদুটো তখন বিস্ফারিত ভয়ে বিস্ময়ে সে উন্মাদপ্রায় হয়ে গেছে। আর প্রাণপণে ওদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
সিধুবাবুর অর্ডার এল, ‘কাজ সেরে চলে এসোবলে তিনি সেখান ছেড়ে দ্রুত চলে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে মাধবের মাথায় বাড়ি মেরে তাকে অজ্ঞান করে দেওয়া হল। তারপর তার শরীরটাকে ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে অন্যত্র নিয়ে চলল ওরা।
এর মিনিট পনেরো বাদে সিধুবাবুর কাছে একটা পরিচিত নম্বর থেকে ফোন এল। সিধুবাবুর এই ফোনের অপেক্ষাতেই ছিলেন। ওপার থেকে গলা ভেসে এল, ‘চিন্তা নেই বস, কাম পুরা হো গয়া
*                                                     *                                                          *
মাধবের খোঁজ রাখবার মত বিজনুরে তেমন কেউ ছিল না। তাই পরের দিন থেকে তাকে দেখতে না পাওয়া গেলেও বিশেষ একটা শোরগোল পড়েনি। অনেকেই ভেবেছিল, যাক আপদ বোধহয় এবার ঠান্ডা হল। যারা এ নিয়ে কিঞ্চিৎ মাথা ঘামাতে শুরু করল অন্যেরা তাদের থামিয়ে দিল এই বলে, ‘আরে ছাড়ো তো পাগলের কথা। ওদের আবার থাকা না থাকার কোন ঠিক আছে নাকি? দেখো গে নিজে থেকেই ও কোন পাগলা গারদে ঠাঁই গেড়েছে। হাঃ হাঃ হাঃএই বলে সমস্বরে হাসির রোল উঠল।
কিন্তু সেদিন শ্যামল বাজারে বেরোতে গিয়ে রাস্তায় দুটো লোকের সাক্ষাৎ পেল। লোকগুলো পরিচিত নয়। কিন্তু তার চাইতেও বড় কথা ওদের কাছে কোন গোলাপ দেখতে পেল না সে। তবে কি এরা বিদেশী? ভুল করে এখানে এসে পড়েছে? প্রশ্নাতুর হয়ে তড়িঘড়ি সিধুবাবুর বাড়িতে ছোটে শ্যামল। কিন্তু সিধুবাবুর বাড়ি সেদিন লোকে লোকারণ্য। খোঁজ নিয়ে জানা গেল সিধুবাবু নাকি ভয়ানক অসুস্থ। আর ভেতরের খবরটা সে পেল অনেক পরে। কারা যেন কাল রাত্তিরে গোলাপ বাগানে অর্ধেক গোলাপ নিকেশ করে দিয়েছে। সমস্ত মাটিও গেছে নষ্ট হয়ে। এখন সেখানে চাষ করাই বেশ মুশকিল। কিন্তু কি করে এমন হল তা কেউ বলতে পারে না। কেউ বুঝতে পারে না রাতের ঐ অতন্দ্র পাহারা টপকে কারা কিভাবে ঐ গোলাপের চারা নষ্ট করবার সাহস পেল আরও জানা গেল শুধু শ্যামল নয়, আরো অনেকেই রাস্তায় ঘাটে বাজারে এমন লোককে দেখেছে যাদের কাছে কোন গোলাপ নেই। মাধবের মৃত্যুর পর থেকে এই উপদ্রবগুলো যেন আরো বেড়েছে।
এই সমস্ত শুনেই সিধুবাবু আপাতত গুরুতর অসুস্থ। ভীষণ অসুস্থ।  শ্যামল ভাবে, তাহলে তারা যেটা ভেবেছিল সেটা ভুল! মাধব একা নয়? তার মত এমন আরও অনেকে আছে বিজনুরে যারা গোলাপবিরোধী? কিন্তু কিভাবে তাদের খুঁজে পাওয়া সম্ভব? তারা সংখ্যায় কত? কিভাবে কাজ চালাচ্ছে তারা? ভাবতে ভাবতে শ্যামলের গা থেকে দরদর করে ঘাম ঝরতে থাকে। অসুস্থ বোধ করতে থাকে সে। তবু চিন্তা যায় না। এই কথাগুলোই যখন ওপর মহলের কাছে গিয়ে পৌছবে তখন কি হবে? কি জবাব আসবে সেখান থেকে? ধীরে ধীরে চিন্তারও ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে শ্যামল। গোটা পৃথিবীটা যেন দুলে ওঠে তার সামনে। ধপ্‌ করে বসে পড়ে সে কাঁচা মাটির ওপর।