পৃষ্ঠাসমূহ

শনিবার, ২৯ আগস্ট, ২০১৫

আশঙ্কায় আছি



একটা ভয়াবহ সত্যকে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু কিছু করতে পারছি না। এ এক বিষম জ্বালা। বন্ধুদের কাছে অনুরোধ, তাঁরা যদি কেউ এ লেখা পড়েন। তাহলে যেন আমাকে এ থেকে পরিত্রাণের উপায় বাৎলে দেন। যে ঘটনাটা থেকে এ সবের সূত্রপাত সেটাই আগেই বলি।
অফিসে যাওয়ার সময় রোজ লালগোলা ফাস্ট প্যাসেঞ্জার আমার বাঁধা থাকে। দরজার থেকে কিছুটা দূরে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ানোটা আমার বরাবরের অভ্যাস হয়ে গেছে। আসলে আমি উঠি নৈহাটি থেকে। আর নৈহাটির পর থেকে আমার গন্তব্য স্টেশন শিয়ালদা পর্যন্ত এ ট্রেন কোথাও দাঁড়ায় না। তাই লোকেদের নামাওঠার ভিড়টাও থাকে না। শুধু লোকে এখানে দুটো কাজ করতে আসে। সে দুটো হল এক, বিড়ি খাওয়া আর দুই, বাথরুমে যাওয়াশুক্রবার, মানে গতকাল ট্রেনে চড়েছি। প্রায় শিয়ালদার কাছে পৌছে গেছি তখন। একটা পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের ছেলে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরাল। যদিও ট্রেনে বাসে সিগারেট খাওয়াটা আইনত অপরাধ। কিন্তু আমাদের দেশের নিয়মানু্যায়ী, বেআইনি কাজকে আইন বলে চালিয়ে দেওয়াটা অসম্ভব কিছু না। অহরহ ঘটছে এসব। তাই ছেলেটাকে বলব বলব করেও কিছু বললাম না।
সিগারেট শেষ হলে টান মেরে দরজা দিয়ে বাকিটুকু ফেলে ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে একবার হাসল। আমি চিনি না ওকে। হাসল কেন তাও জানি না। তবু প্রতি হাস্যে আমিও জবাব দিলাম। ছেলেটা বলল, ‘আপনি কি সরকারি জায়গায় আছেন?’ আমি উত্তরে হ্যাঁ বললাম,। ও ফট্‌ করে বলে ফেলল, ‘আচ্ছা, আপনার কাছে অ্যাকাউন্টসের কোন কাজ আছে?’ আমি ‘না’ বলি।  
দেখলাম ছেলেটার চেহারা ভাল। সুন্দর স্বাস্থ্য। দেখতেও মন্দ নয়। কিন্তু এই বয়সের একটা ছেলের চাকরি করবার জন্যে অচেনা একজনকে অনুরোধ করতে লজ্জা করছে না দেখে খুব অবাক হলাম। ঠিক ততটাই হলাম অসন্তুষ্টওকিন্তু সে অসন্তোষ না প্রকাশ করে ওর কথা আমি শুনে যেতে লাগলাম। ও বলে যাচ্ছে, ও কোন এক কোম্পানীর অ্যাকাউন্টসে আছে। কিন্তু সেখানে কাজের খুব চাপ। মাইনেও খুব কম। তাই ও সেকাজে ইস্তফা দিয়ে নতুন কাজ খুঁজছে।
আমি ওকে বললাম, প্রাইভেট কোম্পানী যে ঝেড়ে নিংড়ে তবে দুপয়সা দেবে সেটাই স্বাভাবিক। আপনি যদি সরকারি চাকরি করতে চান, তাহলে সরকারি চাকরির পরীক্ষাগুলো দিন। আমার কথা শোনার পর ছেলেটা একটানা বকে যেতে লাগল। ওর চাকরিতে কি কি সমস্যা আছে, কি করলে সে ভাল কাজ পেতে পারে তার জন্যও সে কি ভাবছে ইত্যাদি ইত্যাদি। ওর কথাগুলো শোনার পর আমার ভুল ভাঙল। ছেলেটা সাধ করে আমার কাছে থেকে চাকরির খোঁজ চাইছে না। সে চূড়ান্ত টেনশনের মধ্যে আছে। আর ওর মধ্যে চলতে থাকা এই উদ্বেগই ওকে আমার মতো একজন অচেনা অজানা লোকের থেকে চাকরির খোঁজ করাতে বাধ্য করছে। পরে আমার মনে হচ্ছিল, ও কিছুটা মানসিকভাবেও অথর্ব হয়ে পড়ছে। একটা সাহারা খুঁজছে ও। ভারি খারাপ লাগল আমার। আজকের এই যুবসমাজ যারা কিনা ভবিষ্যত ভারতবর্ষ তৈরি করবে, তারাই আজ কেমন পঙ্গু হয়ে গেছে। সামাজিক ব্যধি, অর্থনৈতিক নিষ্পেষণ আজ এমন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছেছে যে ভবিষ্যত প্রজন্ম আজ মানসিক ব্যধির শিকার। কি করে ভাল হবে আমাদের ভবিষ্যত পৃথিবী। যে ছেলেটার কথা আমি এতক্ষণ বললাম, মধ্যবিত্ত ঘরে এরকম শিক্ষিত ‘বেকার’ যুবকের সংখ্যা কিন্তু নেহাৎ কম নয়। আমার বন্ধুবান্ধবদের বেশিরভাগকে দেখেই আমি একথা বলছি। আর এও সত্যি যে দেশের পরবর্তী দিনগুলো গড়ে তুলতে এই সকল ছেলেমেয়েদের ভূমিকা হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কেমন হবে সেই দিন? কি করে এই চরম নিষ্পেষণের মধ্যে এরা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে? শক্তি পাবে কোথায় এরা? আশঙ্কায় আছি, ভবিষ্যতটা না আরো দীন হয়ে পড়ে। শক্তি জোগাতে হবে এদের। আমার পাঠক, তোমরা সবাই এসো। আজকের যুবসমাজকে শক্তি দাও তোমরা। মহাভারতে পড়েছিলাম, শ্রীকৃষ্ণ বলে গেছেন, এ পৃথিবী যখনই অধর্মের শিকার হবে তখনই যুগে যুগে তাঁর আবির্ভাব ঘটবে। সমস্ত পৃথিবীকে তিনি অপশক্তির হাত থেকে রক্ষা করবেন। আজ হাজারো দূর্যোধনে পৃথিবী ভরে গেছে। কিন্তু তাঁর দেখা মেলে কই? হয়ত এ কথার কথা। তাই তার জন্যে অপেক্ষা করে আমাদের লাভ নেই। আমাদের মধ্যে থেকেই কেউ একজন উঠে আসবেন। আসুন না এমন কেউ, যিনি সারাটা যুবসমাজকে নেতৃত্ব দেবেন – একে এর গভীর অসুখ থেকে মুক্ত করে সুন্দর এক ভবিষ্যতের জন্ম দিয়ে যাবেন।  

বৃহস্পতিবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৫

বিতর্কিত



আজ বেঁধে গেল তুমুল তর্ক। একপাশে আমি, আর ওপাশে তিনজন। আর শুরু হতে না হতেই তা জমে এক্কেবারে ক্ষীর। তা হোক, কিন্তু তর্কের বিষয়বস্তুটা না জানলে যে লেখাটাই জমবে না। তাই গোড়াটা আগে বলা ভাল।
আজ অফিসে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের অফিসের স্টেনোগ্রাফার শান্তনুদা আমাকে বলে, আচ্ছা শান্তনু, একে চন্দ্র, দুয়ে পক্ষ...ওটা তোমার পুরো মুখস্থ? আমি যথারীতি বলে দিলাম, হ্যাঁ। উনি আসলে পুরো ছড়াটা ভুলে গেছিলেন। তাই আমি বলে যেতেই উনি সেগুলো লিখে নিলেন। কিন্তু নয়ে নবগ্রহতেই হল সমস্যা। আমি বললাম, এখানে হয়ত বলেছে, নয়ে নবগ্রহ। কিন্তু আদতে তা নয়। প্লুটোর গ্রহ তকমা ছেঁটে ফেলার জন্য ও এখন নাম যশ খুইয়ে বামন গ্রহের দলে চলে গেছে। ওকে আর ‘গ্রহ’ সম্মান দেওয়ার দরকার নেই। ফট্‌ করে শশাঙ্কদা বলে উঠল, ‘কিন্তু জ্যোতিষে তা বলে না। সেখানে কিন্তু বলে ওটা গ্রহই’। আমি তো মুখ বেঁকিয়ে বলে ফেললাম, ‘সেখানে তো অনেক কিছুই বলে কিন্তু বিজ্ঞান তো তাকে প্রমাণ করতেই পারেনি’।
-      কিন্তু বিজ্ঞানও কি সব বলতে পেরেছে...
ব্যস, শুরু হয়ে গেল বিতর্ক। দুই স্টেনোগ্রাফার শান্তনুদা আর সোমনাথদা, আর একজন ইন্সপেক্টর শশাঙ্কদা – এইসব রথী-মহারথীদের বিরুদ্ধে আমি একা চুনোপুঁটি এম.টি.এস। কিন্তু ওদের বক্তব্য শুনে যা বুঝলাম তা হল, ওরা বলতে চায়, বিজ্ঞান সবকিছু প্রমাণ করতে পারেনি। কিন্তু তাই বলে তো সেগুলো মিথ্যে হয়ে যায়নি। এমনকি বিজ্ঞান যা প্রমাণ করতে পেরেছে তাও যে ঠিক হবেই এমন বলবার জোরও তার নেই। অতএব বিজ্ঞান হঠাও। যার বলার মধ্যে কোন জোরই নেই তাকে আবার মানে কে? কিন্তু একজন জ্যোতিষী তো ধ্রুব সত্য বলে, তার বলার মধ্যে তো কোন সন্দেহ নেই। আবার তেমনি জ্যোতিষবিদ্যা যে মিথ্যে তাও তো বিজ্ঞান প্রমাণ করতে পারেনি। হয়ত এই জ্যোতিষের ক্রিয়াকলাপের বিজ্ঞানসম্মত পন্থা নেই। কিন্তু এমনও তো হতে পারে যে বিজ্ঞান তাকে এখনও পুরোপুরি বুঝে উঠতেই পারেনি। অমুক গ্রহর ছায়া তমুক নক্ষত্রের ওপর পড়লেই যে আমার বিপদ হবে, তা বিজ্ঞান বলে না। কিন্তু দূর ভবিষ্যতেও যে বলবে না তার প্রমাণ কই? তার মানে, জ্যোতিষশাস্ত্রকেও ভ্রান্ত বলা যায় না কখনোই। তাই একে মেনে চলতে অসুবিধা কি?
অপরপক্ষে আমার বক্তব্য ছিল, বিজ্ঞান আজ পর্যন্ত যা প্রমাণ করতে পেরেছে তাকে সঙ্গে নিয়েই কেবল আমাদের চলতে হবে। যেমন, সূর্য একসময় আমাদের চোখে দেবতা ছিল, কিন্তু বিজ্ঞান যখন তাকে দেখাল সেটা কোন দেবতা নয়, একটা নক্ষত্র মাত্র, তখনই তাকে দেবত্ব থেকে পদত্যাগ করে একেবারে সাদামাটা একটা নক্ষত্র হয়ে যেতে হল, যে নক্ষত্র আমাদের ছায়াপথে অসংখ্য রয়েছে। কিন্তু তাই বলে আমি যদি ভাবতে থাকি, বিজ্ঞানের এই সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত নয়। বিজ্ঞানের ভুল একদিন ভাঙবেই। আর যেদিন ভাঙবে সেদিন সূর্য আবার স্বমহিমায় তার দেবতার আসন ফিরে পাবে। তাহলে আমার কাজটা আর যাই হোক, মনুষ্যবুদ্ধিপ্রসূত হল না। কারণ মানুষ আদতে যুক্তিবাদী প্রাণী। আর এই যুক্তি দিয়েই এটা বোঝা যায় যে কবে কি হবে তার অপেক্ষা না করে এখনও পর্যন্ত যা পাওয়া গেছে তাকেই আমাদের মেনে নিতে হবে। কারণ তা বৈ তো বাস্তব সত্যকে বোঝবার মত বিকল্প কোন উপায় আমাদের হাতে নেই।
কিন্তু শশাঙ্কদা সেই কথা বুঝল না। সে তর্ক থামাল না। তখন আমি বাধ্য হয়ে স্টিফেন হকিন্সের শরণাপন্ন হলাম। কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আর ইউনিভার্স ইন অ্যা নাটশেল – দুটো বইই আমার পড়া আছে। আমি বিগ ব্যাং তত্ত্ব প্রয়োগ করে বলতে লাগলাম, কেন মানুষের পক্ষে ভগবানের ধারণাকে বোঝা সম্ভব নয়। কেন জ্যোতিষকে বোঝা সম্ভব নয়। কিন্তু যুক্তি প্রয়োগ করতেই শশাঙ্কদা বলে, ‘স্টিফেন হকিং কি করে জানল। বিগ ব্যাং – এর সময় কি সে উপস্থিত ছিল? আর এনট্রপি ধারণাকে খণ্ডন করতে শশাঙ্কদা যা বলল তা তার মুখেই শুনুন – তুই বলছিস তো, মানুষের চিন্তার ফলে মস্তিষ্কের ভিতরে শ্বসনের ফলে তাপ উৎপন্ন হয়। আর তার ফলে অণু পরমাণুগুলো সব স্থিতি থেকে গতির অবস্থাপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু সাধুরা যখন একমনে বসে ধ্যান করে তখন কিন্তু তারা সমগ্র বিশ্বটাকে একস্থানে কেন্দ্রীভূত করে’। আমি বললাম, হ্যাঁ সে হয়ত সেভাবে মনঃসংযোগের পরিমাণটা বাড়ায়, আর তাই বাইরের চিন্তাভাবনা তাকে দোলা দেয় না। কিন্তু তার মানে এই নয় তার এনট্রপি বৃদ্ধি তার ক্ষেত্রে কাজ করছে না। তার কিন্তু সেই ধ্যানমগ্ন অবস্থাতেও শ্বাসকার্য চলছে, আর তাই শ্বসনও থেমে নেই। তাই শ্বসনের ফলে তাপ তো উৎপন্ন হবেই।
শশাঙ্কদার এবারে যে বলল তা শুধু আমার কাছে অদ্ভুত আর অভিনবই নয়, বরং চূড়ান্ত ভয়াবহ। ওনা কথাটা আমার সারাজীবন মনে থাকবে। উনি বললেন, কিন্তু সাধুরা ধ্যানের সময় তো শ্বাস নেয় না। তাদের সেই সময় শ্বসনও চলে না।
আমি আর কিছু বলিনি। কিন্তু মনে মনে ভাবলাম এই শশাঙ্কদাই কি করে গর্ব করে তার একজোড়া ডিগ্রী আছে বলে? কি করে বলতে পারে, ‘আমি নাটক করি, গান জানি’। কি লাভ হল তার এইসব শিক্ষা পেয়ে? যে তার চেতনাকে কেবল প্রাচীন বিশ্বাসের মধ্যেই সম্পূর্ণরূপে বাঁধা দিয়ে রেখেছে, তার ডিগ্রি বাড়িয়ে, শিক্ষিত হওয়ার মধ্যেই বা সার্থকতা কোথায়? এই শিক্ষা এদেরকে যে কেবল টাকা রোজগার করতেই শিখিয়েছে, মানসিক মুক্তি দেয়নি। তাই তারা আজও রাধামাধবের পায়ে কপাল না ঠেকিয়ে ঘর থেকে বেরোয় না, অফিস থেকেও বেরোয় না।
মনে আছে, ছোটবেলায় এক গরমের দিনে আমি রিক্সায় উঠেছিলাম, আমার সাথে মা ছিল। আর গরমটাও সেদিন বেজায় ছিলশুনলাম আমাদের রিক্সাওয়ালাটা চেঁচাচ্ছে, আসলে সূর্যটা আকাশ থেকে পৃথিবীর দিকে অনেকটা নেমে এসেছে তো, সেই কারণেই গরমটা বেড়ে গেছে। মনে পড়ে, আমি আর মা সেদিন তার এই কথা শুনে খুব একচোট হেসেছিলাম। এখন আর লোকটাকে দেখি না। কিন্তু এখন যদি সেই রিক্সাওয়ালাকে আবার দেখতে পাই,  তবে তার কাছে ক্ষমা চাইব। বলব, ঘাট হয়েছে দাদা, আপনাকে নিয়ে আমার হাসা সেদিন উচিত হয়নি। আমি সেদিন না বুঝলেও আজ এটা ভালভাবেই জানি, তথাকথিত শিক্ষিতরাও এমন সব চিন্তা করেন, যা আপনার সেদিনের সেই চিন্তার থেকে কোন অংশেই কম মজাদার নয়।
তবু আরো একটা কথা বলে যেতে চাই। কারণ এই ঘটনাটার উল্লেখ না করলে এই লেখাটা সম্পূর্ণ হবে না। আজকের সেই স্মরণীয় বিতর্কের পর, অনেকক্ষণ কেটে গেছে। সবকিছু শান্ত। আমার কিছু কাজ ছিল অফিসারের ঘরে। সেসব শেষ করে আমি খেয়ে নিয়েছি। এমন সময় সেই স্টেনোগ্রাফার সোমনাথদা আমাকে ডাকল। আমি তার কাছে যেতেই সে বলল, জান শান্তনু, তোমার মত বয়স যখন আমার ছিল। তখন আমিও তোমার মত চিন্তা করতাম। সমস্ত কিছুকে যুক্তি দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করে মানবারই চেষ্টা করতাম। কিন্তু কি জান, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার ভেতরের সেই জোরটা কমে গেছে। এখন কোনকিছু না মেনে চললে, বিশ্বাস না করলে কিছুতেই যেন শান্তি পাই না’সত্যি কথা বলছি, ওনার কথা শুনে আমার খুব খারাপ লাগল। আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম, উনি যেন নিজের ভুলগুলো ধরতে পেরেছেন। ওনাদের যুক্তির মধ্যে যে গলদ ছিল, তা ওনার চোখে পড়েছে। আর তাই উনি যখন নিজের ছোটবেলাটাকে আমার মধ্যে প্রতিস্থাপন করলেন, তার পাশে আজকের উনি, ওনার চোখেই বৃদ্ধ হয়ে পড়লেন। উনি আত্মসমীক্ষণের মধ্যে এটা বুঝতে পারলেন, যে উনি নিজের দূর্বলতা আর তার জেরে বাঁচবার জন্য একটা ভর্সা খুঁজে পেতেই এত গাঢ়ভাবে বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরেছেন। বস্তুত, এই বিশ্বাসই কিন্তু এঁদের সবাকারই নিজেদের অস্ত্বিত্বের একটা দৃঢ় অবলম্বন। তাই একে যেন-তেন-প্রকারেণ রক্ষা করবার জন্যে মরিয়া এরা। তাতে শিক্ষিত-অশিক্ষিত ভেদাভেদ মুছে যায়। পড়ে থাকে কেবল বিশ্বাসকে ধরে রাখবার তাগিদ। তাই এরা তাদের ছোটবেলার দিনগুলোকেই আঁকড়ে ধরে থাকতে চায়। তাদের কাছে সেদিনগুলোই হয় স্বর্ণযুগ, আর আধুনিক যা কিছু সবই খারাপ। কারণ আধুনিককে মেনে নেওয়ার মত মানসিক জোর তো তাদের নেই। আর এখানেই তো তাদের ব্যর্থতা। নতুন যে আসছে, তাই পুরোনোকে তো তার জায়গা ছেড়ে দিতেই হবে।
তবু আমি সোমনাথদাকে ধন্যবাদ দেব। উনি তো তাও প্রকারান্তরে হলেও নিজের ভুলটুকুকে স্বীকার করেছেন, কিন্তু বাকি দুজন তো তাও করেনি। অর্থাৎ যে মানসিক জোরের অভাবের কথা সোমনাথদা বলছিলেন, বাকি দুজনের সেই অভাব তার থেকেও যে বেশি এটুকুই বোঝা গেল। তবে এই বিতর্ক থেকে আর যাই হোক আমি কিন্তু শিখলাম অনেক কিছু। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য শশাঙ্কদার সেই ভয়াবহ ডায়লগ। নাঃ এখন আর সেই কথাগুলো দ্বিতীয়বার লিখব না। আমার ভয় তাহলে আরো বেড়ে যাবে। বরং এখন আসি, টাটা।

সোমবার, ২৪ আগস্ট, ২০১৫

একটা আবেদন



রবি-শরতের সময় এখন গিয়েছে। বিষ্ণু-বুদ্ধদেব কিংবা বন্দ্যোপাধ্যায় খনি খোঁড়ার কাজও শেষ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সদ্য প্রয়াত, ভদ্রলোককে নিয়ে আর নাড়াঘাঁটা না করাই ভাল। কিন্তু তিরিশের নিচে? ভাল লেখা কই তিরিশের নিচে? রেনেশাঁ শেষ তো কবেই, আজ তার রেশও প্রায় বিলীয়মান। তবু তাকে ঘিরেই এখনও চর্বিতচর্বণ? কবে ঘুম ভাঙবে বাঙালীর? সাহিত্যে আবার কবে উঠবে হিল্লোল? নাকি প্রযুক্তির রমরমায় মৃত্যুই এর একমাত্র ভবিতব্য?
না, সাহিত্যের আবেদন মানুষের কাছে কোনদিনই ফুরিয়ে যেতে পারে না। হয়ত বা বড়জোর দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন হতে পারে। তাই একে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে পারে মানুষ। কিন্তু তোমরাই বল না বন্ধুরা, ছোটগল্প পড়তে ভাল লাগে না তোমাদের? ভাল লাগে না উপন্যাসের মধ্যে, তার চরিত্রগুলোর মধ্যে নিজেকে খুঁজে পেতে? মনের অন্তঃস্থল থেকে উঠে আসা কবিতারা মন ভ'রে বৃষ্টি আনে না? আনে তো?
কিন্তু কেই বা ভাবে বাংলা সাহিত্যের ঘুম ভাঙানোর কথা? নামীদামী পত্রিকা যারা কিনা এতদিন পথ দেখিয়ে এনেছে সাহিত্যকে, নতুন নতুন সাহিত্যিকের জন্ম দিয়ে গেছে একের পর এক, বাণিজ্যিক খাতিরে তারাও যে আজ প্রায় বিক্রীত। সস্তার খবর ছেপে, তাৎক্ষণিক ঝালমুড়ি খবরে আর গপ্পে যে মজে রয়েছে তারাও। নতুন লেখক- লেখিকা, যারা সত্যিই সৃষ্টি করতে চায় নিজের প্রাণ থেকে, তাদের যে সুযোগই নেই। যেটুকু বা তারা স্থান পেতে পারত, লবিবাজিতে সেটুকুও নিশ্চিহ্ন। কে দেবে তাদের সুযোগ?
ঘাবড়াবার দরকার নেই বন্ধু। একটা পত্রিকা আছে। যদিও সেই পত্রিকাটার মাত্র দুটো সংখ্যা আমি দেখেছি (কারণ এর কেবল দুটো সংখ্যাই বেরিয়েছে)। শ্রাবণ মাসে এই পত্রিকা প্রথম প্রকাশিত হয়। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী সম্পাদিত এই পত্রিকাটার নাম 'কালি ও কলম'। সবে দুমাসে পা দিয়েছে। অর্থাৎ হাঁটা তো দূরস্থ, এখনও বসতেও শেখেনি এ। তাই বড় হয়ে রবীন্দ্রনাথ হবে কি লাদেন হবে তা বলাটা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি উচিতও নয়। কিন্তু যেটা আমার খুব প্রশংসনীয় লেগেছে - সেটা হল এই পত্রিকাটার সদিচ্ছাটা। সম্পাদকমণ্ডলীতে যারা রয়েছেন তাঁরা হলেন গণেশ হালুই ও বাণী বসু। আশা করি নতুন করে এদের পরিচয় দেবার দরকার নেই। আর কেবল এদের নাম দেখেই পত্রিকার প্রতি আমাদের আশাও বেড়ে যায়। সুখের কথা, জন্মাবস্থা থেকেই কিন্তু কালি ও কলম বেশ শক্তিশালী বলেই মনে হচ্ছে। শুধু গল্প কবিতাই নয়, এর প্রবন্ধ/আলোচনাগুলো পড়ে দেখবে, তাহলেই বুঝতে পারবে। এপার বাংলা- ওপার বাংলা - এই দুই পারের বাঙালিকে নিয়েই পত্রিকার পথ চলা শুরু। তাই এর প্রতি অনেক অনেক শুভকামনা রইল।
আরো একটা ব্যপার আমার ভাল লাগল - এই পত্রিকাটা কিন্তু শুধু প্রতিষ্ঠিতদের নয়, নতুনদের লেখাকেও এরা স্বাগত জানায়। আমাদের নৈহাটির কিছু দোকানে এই পত্রিকাটার খোঁজ করেছিলাম, পাইনি। আরো খারাপ লাগল যেখন দেখলাম সেইসব দোকানেই ফ্যাশন ম্যাগাজিনগুলো দেদার বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু আমার একার পক্ষে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা কি সম্ভব? কখনোই নয়। কিন্তু আমার সাথে এই তোমাদের মত বন্ধুরা এলে তো আমাদের সংখ্যাটা অনেক হয়ে যাচ্ছে, তাই না? এসো না, তাহলে আমরা সবাই মিলে এ হেন একটা শুভ উদ্যোগের পাশে এসে দাঁড়াই। এতে আমার ব্যক্তিগত কোন লাভ নেই, হয়ত তোমারও তা নেই। কিন্তু বাংলা ভাষা আর সাহিত্যকে আমরা মরে যেতে দেব না, বিকিয়ে যেতে দেব না একে আর পাঁচটা পণ্যের মত - এই হোক আমাদের অঙ্গীকার। পত্রিকা তার মান বজায় রাখুক আর আমরা তাকে চলতে সাহায্য করি। কি পাশে থাকবে তো?

শনিবার, ২২ আগস্ট, ২০১৫

অথ নারীগাড়ি কথা (মাতৃভূমি স্পেশাল)



ট্রেনকে ঘিরে রণক্ষেত্র। আর তার জেরে কেউ কেউ আহত, এমনকি এখন তো শুনছি একজনকে ট্রেন থেকে ফেলেও দেওয়া হয়েছে। শেষের কথাটার সত্যতা কতখানি জানি না, তবে এহেন ঘটনা দেখে তো আমি স্তম্ভিত। সত্যি কথা বলতে কি এরকম একটা সাধারণ ঘটনাকে ঘিরে এমনিধারা অসভ্যতামি শুরু হবে তা তো আর সভ্যদেশে বসে ভাবা যায় না।
এবার আসি আসল ঘটনায়। ঘটনাটা হয়ত আজকের, কিন্তু এই ঘটনার মূল বীজ মাটিতে ফেলা হয়েছিল আজ থেকে প্রায় বছর পাঁচেক আগে। তৎকালীন রেলমন্ত্রী শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (যিনি কিনা এখন পশ্চিমবাংলার ‘মা-মাটি-মানুষের’ সরকারের মা) ফলাও করে রেল বাজেটে ঘোষণা করলেন লেডিস স্পেশাল/মাতৃভূমি লোকাল নামে একধরনের বিচিত্র ট্রেন চালু করা হবে যাতে কোন পুরুষ যাত্রীই প্রবেশাধিকার পাবে না। এতে হবে কি স্ত্রীলোকদের যাদের এতদিন কেবল মাত্র দুটো কামরার মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখতে হত, তারা এখন গোটা ট্রেনটায় বসে বসে মায় শুয়ে শুয়েও দিব্যি যাত্রা করবেন। সত্যি তো, মহিলাদের ট্রেনে করে যেতে কত কষ্ট হয় না! তাই তো এই ব্যবস্থা। সবাই বলে উঠল ধন্য ধন্য! দুহাত তুলে ভোট দিল তারা দেবীরূপা থুড়ি মাতৃরূপা ‘মা-মাটি আর মানুষকে। আর দিদিমণি দুহাত তুলে সকলকে আশীর্বাদ করে বললেন জয়স্তু। বাংলাকে পাঁচ বছরে শ্মশান, মাপ করবেন স্বর্গ বানিয়ে ছাড়ব।
এখন তো হল মেয়েদের জয়জয়কার। বেড়ালকে, মানে এই মাতৃভূমিকে এই দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে সযত্নে লালন পালন করে বড় করে তোলা হল। এরপর দাবী করা হল বেড়াল মেরে ফেলা হবে। কি সাঙ্ঘাতিক কথা একবার ভেবে দেখেছেন? মাতৃভূমিতে এবার যে ছেলেদের প্রবেশাধিকার দিয়ে দিলসাধের স্বর্গরাজ্য যে এবার যায় যায়। একে রক্ষা করা তাই যেকোন বীরাঙ্গনার প্রাথমিক ও পবিত্র কর্তব্য বলে মনে হতেই পারে। সত্যিই তো, এত বড় অন্যায় কি করে মেনে নেওয়া সম্ভব? ছেলেদের সাথে কি মেয়েরা যেতে পারে নাকি? চলছে না, চলবে না। একবার উঠুক ছেলেরা, দেখে নেব। মেয়েরাও কি কম নাকি। তারাও যে পুরুষের থেকে কোন অংশে কম নয় তা তারা দেখিয়ে দেবেই। ব্যস, শুরু হল যুদ্ধ।
এই হল মোদ্দা ঘটনা। এখন তো হাড়ে হাড়েই টের পাওয়া গেল পুরুষদের চেয়ে মেয়েরাও কিছু কম নয়। এমনকি নারীর প্রতি সম্মান রাখতে (পড়ুন বাচ্চার বায়না মেটাতে) নারীগাড়ির প্রস্তাবিত পরিবর্তনও স্থগিত হয়ে গেল। রেল কর্তৃপক্ষ ভয়ে সরে গেল নাকি মেকি কান্না থামাতে তাদের চুষিকাঠি দিল তা বোঝা গেল না। তবে যেটা হল তাতে লাই পেল মেয়েরা। মওকা বুঝে এবার তারা দাঁও মারল আরো জোর। আগের দিন হল, শিয়ালদা মেন লাইনে, এবার হল বনগাঁ লাইনে। রানাঘাট লাইনের মেয়েরা তাদের দাবী আদায় করে ছেড়েছে। তাই এবার বনগাঁ লাইনের মেয়েরাই বা ছাড়ে কেন? তারা এবার আরো একদাগ এগিয়ে দাবী করল, নয় বগি মাতৃভূমিতে তাদের বপু আঁটছে না, তাদের দরকার বারো বগি। কিন্তু চুষিকাঠি এবার আর অত সহজে মিলল না। তাদের দাবী শুনে, না তাদের পাত্তা দিল রেল, না দিল পুরুষেরা। রাগে-অভিমানে তপ্তা নারী শুরু করে দিল দফায় দফায় অবরোধ। পুরুষেরা বলল, তুই খালি একা অবরোধ করতে পারিস নাকি, দেখ কেমন আমরাও পারি। ব্যস, আবার অবরোধ। দুই পক্ষে খণ্ডযুদ্ধ। হায় হায় হায়, এ কি দেশে আমরা বাস করি।
আমি বলি, যারা এই অবরোধগুলো করছেন তারা একবার হাওড়া লাইনকে দেখে শিখুন। সেখানে হয়ত কিছু কম যাত্রী যাতায়াত করে। কিন্তু সেখানেও মাতৃভূমি লোকাল আছে। তাতে নির্দিষ্ট কামরায় পুরুষ যাত্রীরা উঠতেই পারে। কিন্তু নারীগাড়ি রক্ষা করার জন্য সেখানকার যাত্রীদের এমন অসভ্যতা করতে দেখা যায়নি। আরে বাবা, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই তো যাত্রী, আর যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্যের প্রয়োজনীয়তাটাও তাই সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এই যুক্তিতে হয়ত ভোটপাখি ধরা পড়বে না। কিন্তু বাস্তব সত্য এটাই আর দিকদারী এখানেই যে যার প্রতি পক্ষপাতিত্ব করা হয়, তারা কিছুতেই যুক্তিকে আমল দেয় না। তারা শুধু গায়ের জোর ফলায়। এতে কোনদিন ভাল হতে পারে না। সাধারণ নিত্য যাত্রীদের (যারা সংখ্যায় অনেক বেশি) হয়রানির শিকার হতে হয় মাত্র কয়েকজনের দুর্বিষহ স্বার্থপর দাবীতে। তাই লেডিস স্পেশাল নিয়ে এই বাঁদরামির প্রতি চূড়ান্ত ধিক্কার জানাই। এই ট্রেন নিয়ে মেয়েরা যতই চেঁচাক না কেন। একটা লেডিস স্পেশালের জন্য যে কত মানুষের সেদিন দূর্ভোগ পোয়াতে হল তা বলে বোঝাবার মত নয়। আর তা কখনোও ক্ষমার্হও নয়। আর এই ধরনের স্বার্থপর শয়তানীকে প্রশ্রয় দিয়ে রেলকর্তারা পূর্বোক্ত বেড়ালকে আরো বড় হতে দিলেন। মন্ত্রীকে এতে হয়ত খুশি করা গেল। কিন্তু এর ফল আবার যে ভবিষ্যতে মিলবে না তাই বা কে বলতে পারে?