পৃষ্ঠাসমূহ

বাঙালি লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
বাঙালি লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

রবিবার, ২৯ জুলাই, ২০১৮

মাটি ছাড়ার ভয়


বর্তমানে যে ইস্যুটাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে সেটা হল আসামের এন আর সি। ২০০৯ এবং ২০১০ সালে ১৯৫১ সালের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন হবার পর আসাম সরকার মনস্থ করেছে যে তারা বেআইনি বাংলাদেশী নাগরিকদের আসাম থেকে বিতাড়িত করবে। এব্যাপারে আমাদের বলার কিছু নেই। কারণ যে সমস্ত মানুষ অন্য দেশ থেকে বেআইনিভাবে এদেশে এসেছে তাদের এখানে বসবাস করবার অধিকার নেই। এটা মেনে নিয়েও আমি বলতে পারি, এই এন আর সি কিছু মানুষের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকারক। তারা বেআইনি বাংলাদেশী হোন, কিংবা না হোন, তাদের কিন্তু এই নীতির শিকার হতেই হবে। আমি এ ব্যাপারে কিছু উদাহরণ তুলে দিচ্ছি। 

কিন্না খাল হল এমন একটি জায়গা যেটা আসামের বরাক উপত্যকা থেকে মাত্র ৪০ কিমি দূরে এবং ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ৫০০কিমি দূরে। এখানকার বেশিরভাগ মানুষই হল বাঙালি তপশিলী শ্রেণীভুক্ত। এখানেই বাস করেন এক অশিক্ষিত হতদরিদ্র মানুষ যার নাম বাদল দাস। স্থানীয় হাওড়ে তিনি মাছ ধরেন এবং এটাই তার রুটিরুজি। বাদলবাবু এন আর সিতে নাম নথিভুক্ত করবার সময় তার বাবার লিগ্যাসি ডেটা কোড ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু সমস্যা বাধল তার বাবার নাম নোকেশ রাম দাস যেটা ক্লারিকাল ত্রুটির কারণে হয়ে গেছে নোকেশ চন্দ্র দাস। এই কারণে তার নাম নথিভুক্ত করা সম্ভব হয়নি। পুলিশ ব্যাপারটাকে ঠিক করে দেবে কথা দিয়েছিল এবং বাদলবাবুর কাছ থেকে ৫০০০০৳ নিয়েওছিল। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। 

না বন্ধু, কেবলমাত্র এই একটা উদাহরণ দিয়েই আমি ক্ষান্ত হতে পারছি না। কিন্না খাল, এবং তার সংলগ্ন নরপতি কলোনি, সুবোধনগর, চাঁদিনগর এবং সালিমবাদের হাওড়ে বসবাসকারী বেশিরভাগ মানুষই এই একই সমস্যায় ভুগছেন। শুধু কিন্না খালের ৩৫০০ মানুষের নাম এন আর সির প্রথম খসড়াতে আসেনি। তাদের ভয়, আগামীকাল যে শেষ খসড়াটি প্রকাশিত হবে, তাতেও তাদের নাম থাকবে না। কারণ, তারা অত্যন্ত নীচু জমিতে বসবাস করেন যেখানে বছরের ৮-৯ মাস জলমগ্ন থাকে। তারা সরকারী ন্যুনতম পরিষেবাটুকুও পান না। ফলে তাদের ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড, শরণার্থী নিবন্ধন কার্ড নষ্ট হয়ে গেছে কিংবা হারিয়ে গেছে। এন আর সি সেবা কেন্দ্র তাদের প্রত্যেকের জমা করা নথিতে ত্রুটি খুঁজে পেয়েছে। আর বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে অবস্থিত হওয়ায় তাদের প্রতি সন্দেহটাও সকলের বেশি। 

এর ওপর রয়েছে ক্লারিকাল ত্রুটি। এর ফলে লখী মণ্ডল হয়ে গেছে লক্রি মণ্ডল, তার স্বামীর নাম রাসেন্দ্র নমঃশূদ্র হলেও কার্ডে হয়ে গেছে ব্রজেন্দ্র। এছাড়া বামাচরণ দাসের নাম এমন হয়ে গেছে যে তা উচ্চারণ করা যায় না। এরা আপাতত এন আর সি তালিকায় নেই। অর্থাৎ সরকারী ত্রুটির জন্যই এরা এখন বেআইনি বাংলাদেশী। কিন্না খালের মানুষজনকে তাই এখন ৬০০ – ৬৫০ কিমি পাড়ি দিয়ে এন আর সি অফিসে যেতে হয়। গরু-ছাগল এবং গৃহস্থালীর সম্পত্তি বেচে দিয়েও তাদের টাকা জোগাড় করতে হয়। সরকারী গাফিলতি মেটাতে খরচ করতে হয় কাউকে ১০০০০৳ কাউকে ১২০০০৳।
এছাড়া আছে সন্দেহজনক তালিকায় থাকা মানুষ। তিনটিকড়ি গ্রামের ৭২ বছর বয়সী হাজি সফিউল্লা জানাচ্ছেন, তাদের পরিবারের পাঁচজনের নাম এন আর সির প্রথম খসড়ায় থাকা সত্ত্বেও তার মেয়ে মজলুফার নাম কিন্তু সেখানে নেই। সুলেইমান আহমেদের কাহিনী আরও ভয়াবহ। এফ টি৪ (ফরেইনার্স ট্রাইব্যুনাল 8) তাকে ২০১৭ সালের একটি ঘটনায় ভারতীয় বলে দাবি করেছিল। এখন আবার নতুন ভাবে তার গায়ে ‘বিদেশী’ তকমা সেঁটে দেওয়া হচ্ছে। এর কারণ আমাদের জানা নেই। একটি হিসেব থেকে জানা যাচ্ছে, ১৯৯টি গ্রামে মোট ১৪৪০ জন সন্দেহজনক ভোটার রয়েছে। অথচ দেখা যাচ্ছে, বেশিরভাগই সন্দেহজনক ভোটারই পরে ভারতীয় বলে শনাক্ত হচ্ছে। সরকারী পদ্ধতির অপদার্থতা এভাবে কিছু মানুষের ভবিষ্যতকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে। 

সর্ব ভারতীয় সম্মিলিত গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট, যে দল এই সকল প্রতারিত মানুষদের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছেন, তাদের এক কর্মী আমিনুল ইসলাম জানাচ্ছেন, হিন্দু হোক কিংবা মুসলমান, এই এন আর সির মাধ্যমে কিন্তু বাংলাভাষী মানুষদেরই টার্গেট করা হচ্ছে। ২০০৫ সালে দেশের সর্বোচ্চ আদালত যখন বেআইনি অনুপ্রবেশকারী (ট্রাইবুনালের মাধ্যমে স্থিরীকৃত), ১৯৮৩ সালের আইনটিকে বাতিল করে দিল, বাঙালিদের প্রতি এই শোষণ কিন্তু তখন থেকেই নেমে এল।
কাল ৩০শে জুলাই। অর্থাৎ এন আর সির অন্তিম খসড়া প্রকাশের তারিখ। আশা করব, আগের খসড়ায় যাঁরা প্রতারিত হয়েছেন, তাদের নাম এই খসড়ায় থাকবে এবং এইসকল হতদরিদ্র মানুষগুলোর পরিশ্রম, জীবনের সমস্ত সঞ্চয় নিঃশেষ করে দেওয়া সার্থক হবে। নিজেদের ভিটেমাটির ওপর তাদের নিজেদের অধিকার থাকবে। কিন্তু যদি তা না হয়? সেই সম্ভাবনাও কিন্তু অত্যন্ত প্রবল। কারণ আসামের জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলো এখন বাঙালিদের টার্গেট করা শুরু করেছে। বাঙালিরা ভারতীয় হোক, বা না হোক, তারা বাংলাভাষী মানুষকে এখন দেশ থেকে তাড়াতে চায়। শোনা যাচ্ছে, বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে চুক্তি করে একটা বড়সড় রকমের প্রত্যর্পণ করা হবে। দেশান্তর করা হবে বেশ কিছু মানুষকে। তাহলে কি শুধুমাত্র বাঙালি বলেই বাদল দাস, রসেন্দ্র নমঃশূদ্র, লখী মণ্ডলেরা দেশত্যাগ করতে বাধ্য হবে? প্রশ্নটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। উত্তর মিলবে কি?