পৃষ্ঠাসমূহ

অণুগল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
অণুগল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

রবিবার, ৩ আগস্ট, ২০১৪

একটা জৈবিক কারণ ও তার ফলাফল

১. কারণ -
কি ভাল লাগে তোমার?
ঐ যে, ঐ ওরকম একটা হীরের হার। হিঃ, হিঃ। ধুর, কি বলছি! এসব আমি কোনদিনই পাব না। কতই না দামী এসব!
তোর কথা শুনে সেদিনই ঠিক করেছিলাম, কিনে ফেলব ওটাতোর ফর্সা ঐ সরু গলাটায় বেশ মানাবেতুই জানতিস, পাঁচ হাজারী চাকরি আমার। মায়ের গেঁটে ব্যথায় চিকিৎসা চলছে।
তাই জ্বরের ঘোরে পড়ে থাকতাম বেবাক, ডাক্তার না ডেকেদু-একদিন না খাওয়া, একবেলা আধপেটা ইত্যাদিতে জমেছিল বেশ কিছু। তাতেই কিনলাম ঐ হারটা, মনে কি তেজ তখন! আরও অনেক আশা নিয়ে গেছিলাম তোর কাছে, হয়ে যাক একটা সারপ্রাইজ।
ভুল ভাঙল। সারপ্রাইজ পেলাম আমিই, যখন তোকে দেখলাম সিটি সেন্টারে ওর হাত ধরে। কি সুন্দর তোর ব্লু টপ আর ব্ল্যাক জিন্স...ওর পাশে তোকে বেশ খুশি খুশিই লাগছিল। স্বপ্নের ঘোর কাটল সেদিন। এ ভুল আমার আর হবে না রে। কিন্তু কি জানিস, নিজেকে বড্ড একা লাগছিল তখন, খুব একা। কেউ চায় না আমায়? কেউ না?

২. নিজের মাংস বেচার দিনে –
অমুকবালা বালিকা বিদ্যালয়। ক্লাস টেনের থার্ড পিরিয়ডটা আজকে অফ যাবে। মিস বেড়াতে গেছে।
অগত্যা শুরু হৈ-হট্টগোল। অন্যদিন হলে সারাটা পিরিয়ড চলত এভাবেই। কিন্তু আজ ব্যতিক্রম। সারাটা ক্লাস হঠাৎই চুপ মেরে গেল। কারণ? ক্লাসরুমে একটা লোক এসেছে।
লোক? এই স্কুলে একজন বুড়ো ক্লার্ক ছাড়া আর একটাও পুরুষ নেই। এমনকি দারোয়ানটাও এখানে – ‘পিসি’এখানে এভাবে একটা বাইরের লোক ঢুকে পড়ল কিভাবে? মেয়েরা কেউ কেউ বিস্মিত, কেউ বা ভীত। কি চায় এ? দাড়ি, গোঁফ কামানো, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। জিন্সের প্যান্ট আর লাল টি-শার্টে ওকে তেইশের ওপরে মনে হয় না। ঢুকেই দরজাটা ভেজিয়ে দেয় ছেলেটা।
‘তোমরা সকলে বড় হয়েছ তো? আই মিন অ্যাডাল্ট। মানে তোমাদের সকলেরই বয়স মোটামুটিভাবে ষোলরই আশেপাশে, তাই তো? বাইরের অনেক দেশে এটাই এজ অফ কনসেন্ট’।
লোকটার কথার মাথামুণ্ডু খুঁজে পায় না কেউ। থবির হয়ে বসে থাকে মেয়েগুলো। ওদেরই মধ্যে একজন ম্যাডামকে ডাকবে বলে উঠতে যায়। আর ঠিক তক্ষুনি তার পা দুটো যেন আটকে যায় আপনা থেকেই। ছেলেটা হঠাৎ ওর লাল টি-শার্টটা খুলে ফেলে টিচারের বেঞ্চটার ওপর রাখল। ‘ইমা...’ কেউ কেউ চাপা শব্দ করে। কেউ বা আড়ালে মুখ টিপে হাসে। বেশ পেশীবহুল শরীর ছেলেটার।
বেঞ্চের দুটো রোয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সে এবার কোমরের বেল্টটা আলগা করে। মূহুর্তমাত্র কাউকে ভাবতে না দিয়ে জিন্সটার হুক, চেন খুলে ফেলে সে। প্যান্টটা নেমে আসে আপনা থেকেই। ‘ইসসস...’ শব্দটা ক্লাসরুমের দেওয়ালে দেওয়ালে ফেরে। দু-একজনের দাঁত বেরিয়ে পড়ে অনিচ্ছাসত্ত্বেও। তবু বেশিরভাগই আড়চোখে দেখে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। অনেকে আবার ভয়ে কাঁপছে।
টিচারের টেবিলটা সামান্য উঁচু একটা কাঠের পাটাতনের ওপর। এবার তার ওপর উঠে দাঁড়িয়ে সে জাঙিয়াটাও নামিয়ে দেয় দ্রুত। তারপর সোজা হয়ে দাঁড়ায় সে। চল্লিশটা মেয়ে তখন তার সামনে।
‘দেখো, দেখে নাও ভাল করে। আজই মনে হয় প্রথম এতগুলো মেয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে।‘ কথাগুলো যেন কাউকে নয়, নিজেই নিজেকে বলছে ছেলেটা।
মিনিট তিন-চার বাদে ছেলেটা নিজের পোশাক পড়ে নেয়। তারপর চটপট বেরিয়ে যায় ক্লাসরুম ছেড়ে।
খবর পেয়ে হেডমিস্ট্রেসের তো চক্ষু চড়কগাছ। ‘কি সাঙ্ঘাতিক কথা রে!!! এসব সত্যি?’ পরেরদিন অভিভাবকরা এসে অভিযোগ করে, ‘কি হচ্ছে কি এসব? উটকো পাগল ছাগল স্কুলের মধ্যে ঢুকে পড়ছে, আর স্কুলের কোন নজর নেই?’ এমনকি রিপোর্টাররাও চলে এল রসালো খবর নিতে।
পরের দিন কাগজে ফলাও করে ছাপানো হল ঘটনাটা। বলা হল, ‘এটা নিশ্চয়ই কোন পাগলের কাজ।‘

৩. আজ –

বাড়িতে আমি হাসছি শুধু। আমার কথা আজ খবরের কাগজে! হাঃ হাঃ হাঃ...কেউ ভাবতে পেরেছে? আমার নাকি কোন দাম নেই? আমায় কেউ চায় না? হাসতে থাকি আমি, নিজেকে ব্যঙ্গ করেই। তারপর গালে হাত দিলে টের পাই, চোখের জলে ভ’রে গেছে সারাটা মুখ। 

বৃহস্পতিবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১৪

দৌড়

‘শুরু হতে চলেছে বাৎসরিক দৌড় প্রতিযোগিতা। নিয়মাবলী পড়ে শোনানো হচ্ছেঃ-
১. প্রতিযোগিদের সামনে একশো ক্যারেটের একটা হীরকখণ্ড থাকবে। সেটাকে লক্ষ করে প্রত্যেককে ছুটতে হবে।  
২. অন্যের দৌড়ে বাধা সৃষ্টি করা যাবে না। করলে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা আছে (দশ ঘা চাবুকের বাড়ি),
৩. যে ঐ হীরেটাকে আগে ছুঁতে পারবে, সেই হবে হীরের মালিক 
...’ 
হীরে– এই একটা শব্দের জন্যেই এই প্রতিযোগিতা। বলা হয় এই দৌড়টাই জীবন। ঐ যে গ্যালারিতে রাজামশাই তার সুন্দরী রাণীর সাথে বসে ঝালমুড়ি খাচ্ছেন। তার সাথে মন্ত্রী, আরও যত আমলা, অভিজাতবর্গ – এরাই এসব কথা বলে। সাধারণ লোকে তাই বোঝে জানে প্রতিযোগিতায় প্রথম হলে সে হীরে পাবে। জীবনযুদ্ধে জিতে তার দুঃখ ঘুচবে, দারিদ্র্য ঘুচবে। তাই এই মাঠভর্তি লোক শুধু হীরের দিকে লক্ষ রেখে ছুটবে।  
রেফারি বাঁশি দিতেই শুরু হল দৌড়। পিছনে চলল অশ্বারোহী বাহিনী। কিছু লোক আছে যারা অন্যকে ল্যাং মেরে ফেলার চেষ্টা করল। তাদের গায়ে চাবুকের বাড়ি পড়ল সপাং সপাং। মাঠ থেকে তাদের বের করে দেওয়া হল।
সবাই দৌড়চ্ছে।
জোরে...
আরও জোরে...
শুধু একটা লক্ষের দিকেই তারা তাকিয়ে। পাশ ফিরলে দেখতে পেত রাজা আর রাণী কেমন হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ছে। কেমন মজা উপভোগ করছে ওরা।
একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ল অনেকে। কেউ কেউ বমি করল। কেউ বা মাঠেতেই শুয়ে পড়ল, মুখে গ্যাঁজলা উঠতে উঠতে মরেও গেল কিছুকিন্তু তাদের দিকে তাকাবে কে?
   *                                             *                                                    *
বিকেলের রোদ পড়ে আসে একসময়। শেষ ব্যক্তিও দৌড়তে দৌড়তে তখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আর চলতে পারছে না সে। মাটিতে শুয়ে পড়ার আগে লক্ষ করল গ্যালারি ফাঁকা। এমনকি রাজসৈন্যও আর নেই। বিকেলের পড়ন্ত আলোয় সে দেখতে পেল, হীরের খণ্ডটা এখনও উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছে। অধরা। দৌড়নোর আগে ঠিক যতটা দূরে ছিল, এখনও ততটাই। অবাক হয়ে গেল সে। এটা কি তবে ভ্রান্তি???
সন্ধে নাগাদ কয়েকটা বাচ্চা ছেলেমেয়ে মাঠে আসেপ্রতিবারই ওরা আসে এসময়ে। মাঠে উচ্ছিষ্ট খাবারদাবার পড়ে থাকে। ওরা সেগুলো কুড়িয়ে খায়। অভিজাতরা যত না খায় তার চেয়ে বেশি ছড়ায় – এতে বাচ্চাগুলোর পেট ভরে এই যা।
ওরা অবাক হয়ে লক্ষ করল – মাঠে প্রায় কয়েক হাজার লোকের ভিড়। তারা কিসব যেন আলোচনা করছে। তাদের কেউ কেউ মাঝেমাঝে উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করছে। বাচ্চাগুলো ভয় পেয়ে যায়।
      *                                             *                                                 *       
রাজবাড়ি।
এখানে দুশ্চিন্তা। গুপ্তচরের কথায় সকলের তো মাথায় হাত।  
সে জানাচ্ছে, সবাই নাকি বুঝে গেছে, ওটা আসল হীরে নয়। একটা টোপ। ওরা নাকি এও জেনে গেছে, ওরা সারা মাঠ শুধু ঘুরেছে। কিন্তু হীরেটা কেউই পায়নি।
রাজা বলল, ‘জানল কি করে ওরা?’
সবাই নিরুত্তর।
-ওদের যে করে হোক বোঝাও, হীরেটা প্রথম ব্যক্তিই পেয়েছে। ওরা তো এতদিন তাই জানত। আর তাই তো ওরা প্রথমজনকে ঈর্ষা করত। একে অন্যকে দোষারোপ করে বেশ তো শান্তিতে ছিল। তবে এবার কি করে সত্যিটা টের পেল তারা?
মন্ত্রী মনে মনে বলে, কত দিন আর বোকা বানানো যায় মহারাজ? কিন্তু তারপরেই তার খেয়াল হল, তাকে রাজআজ্ঞা পালন করতে হবে। সে অন্যান্য পারিষদদের সাথে এই ব্যাপারে কথা বলতে যায়
তারপর যুদ্ধাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সৈন্যরা যখন বেরোল, বাইরে তখন প্রচণ্ড ঝড় উঠেছে। রাজবাড়ির ফ্ল্যাডলাইটে দেখা গেল দূরে একটা কালো বর্ডার।
কালো বর্ডারটা ধীরে ধীরে পুরু হচ্ছেমনে হল একটা বন্যা যেন এদিকেই আসছে। মাঠের ঐ হাজার লোক এখন লক্ষ হয়ে গেছে।
ওদের মুখে গান, ‘তৈরি হও রাজাএবার তোমরা দৌড়বে। যে প্রথম হবে সে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচবে।’

প্রকাশিত - লেখালিখি ওয়েবজাইন