পৃষ্ঠাসমূহ

গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

রবিবার, ১৪ মে, ২০১৭

নতুন চাকরি



এগারোটার মধ্যেও যখন উমাদি অফিসে এল না, মাধব রক্ষিত বলে উঠল, ‘বাইরে করিডরটায় কেউ নেই। স্যারের ঘরে বাইরের কোন লোক ঢুকে পড়লে মুশকিল হবে’। সুমিতা কাঞ্জিলাল তাকে সায় দিয়ে অমিয়কে বলল, ‘অমিয়, আজ তোমায় বাইরেটায় বসতে হবে। বাইরে কেউ নেই’। অমিয়র বুকটা ধক করে উঠল। দশদিনের এই চাকরিজীবনে সে যেন প্রথম উপলব্ধি করল তার চাকরিটা আসলে কিসের। বাইরের করিডরটায় লোহার বেঞ্চ পাতা আছে। অমিয় সেখানে এসে বসে। কমিশনার সাহেবের ঘর পাশেই। সেই ঘর পাহারা দেওয়াটাই আপাতত তার কাজ।
যদিও অমিয় জানে যে সে এই ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্টের একজন এম.টি.এস মাত্র। আর এখানে এম.টি.এসের কাজ বলতে মূলত পিওনের কাজই বোঝায়। তবুও বাইরে করিডরে এভাবে একা একা বসে থাকতে বড্ড খারাপ লাগল তার। কমিশনার সাহেবের একজন পিওন আছে – উমা লাহা, সকলের মুখে উমাদি। বিগত ক’টা দিন পিওনের কাজ বলতে যা বোঝায় – কমিশনারের জন্য চা করা, প্লেট ধোওয়া, তার টিফিন এনে দেওয়া, ঘর পাহারা দেওয়া – সব কাজই উমাদি একাই সামলেছে। অমিয়কে এসবের আঁচ পেতে হয়নি। সে বরং সেই সময়ে অফিসের অন্যান্য কাজ করেছে। চিঠি টাইপ করে দিয়েছে। তার টাইপের হাত চালু থাকায় তাকে বকলমে একজন অস্থায়ী টাইপিস্ট হিসেবেই চালিয়ে নেওয়া গেছে। এছাড়াও সে জেরক্স করে, চিঠি ইস্যু করতে দেয়, প্রয়োজনে সেই চিঠি অন্য অফিসে পৌঁছেও দিয়েছে। কিন্তু আজ উমাদি না আসাতেই ঘটল ছন্দপতন। তবে ছুটি তো কেউ প্রয়োজনে নিতেই পারে। সেখানে সমস্যা নয়, সমস্যা অন্য জায়গায়।
হঠাৎ বেল পড়ল। কমিশনার সাহেব তলব করেছেন। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই দেখে কোট প্যান্ট পরিহিত মিঃ শ্রীবাস্তব গদিচেয়ারে বসে ফাইলের কাজে বুঁদ হয়ে আছেন। খানিক বাদে তাঁর খেয়াল হল, অমিয় দাঁড়িয়ে আছে। অর্ডার এল, ‘পানি কা বটল লানা হ্যায়’। অমিয় ঈষৎ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল, তারপর জল আনতে ছুটল দোতলার ক্যান্টিনে। চার বোতল জল লাগবে। অফিসের ইন্সপেক্টর শশাঙ্কদা ক্যান্টিনে আড্ডা মারছিল। অমিয়কে দেখে জিগ্যেস করল, ‘কি রে, এখানে কি ব্যাপার?’ অমিয় জানাল সে কি করতে এসেছে। উত্তরে শশাঙ্কদা বলল, ‘এঃ, তোদের দিয়ে এসব কাজ করাচ্ছে! এসব ভাল ছেলেগুলো...’ শশাঙ্কদা আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল। পাশ থেকে আরো একজন জুড়ে দিল, ‘হ্যাঁ, অনেক নতুন নতুন ছেলেমেয়ে এম.টি.এস হিসেবে জয়েন করেছে। ভাল ভাল ডিগ্রী আছে। অথচ তাদের কাজগুলো সব ফালতু। গ্রুপ ডি’র কাজ। কিছু করারও নেই। কিছু বলতেও পারবেন না আপনি’। আরেকজন বলল, ‘আমাদের অফিসেও তো একজন এসেছে। ছেলেটা এম এ পাশ। আগে প্রাইমারী স্কুলে চাকরিও করতসেসব ছেড়ে এখানে এসেছে। আসলে ওরা বোধহয় বুঝতেই পারেনি, এম.টি.এসের কাজটা কি? সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের চাকরি আর ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্ট দেখেছে, অন্য চাকরি ছেড়ে আগে এখানে এসেছে’।
অমিয়র এসব একঘেয়ে শুনতে বেশীক্ষণ ভাল লাগছিল না। সে শশাঙ্কদাকে বলে সেখান থেকে চলে এল। শশাঙ্কদা তাকে রোজই একবার করে খোঁচা মারে যাতে সে অন্য ভাল কোন চাকরির পরীক্ষা দিয়ে এখান থেকে বেরিয়ে যায়। কিন্তু সে কাজটা যে কতটা সমস্যাসঙ্কুল সেটা শশাঙ্কদাকে বোঝানো অমিয়র পক্ষে এ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি।
কমিশনারকে জলের বোতল দিয়ে আবার করিডরে এসে বসল অমিয়। একা। কেউ নেই কথা বলবার, অফিসের ঘরের দরজাগুলোও বন্ধ। অমিয়কে এভাবেই বসে থাকতে হবে সারাটাদিন। এক-একটা মিনিট যেন এখন এক-একটা ঘণ্টার মত কাটছে। তবু উঠে যাওয়ারও উপায় নেই। পরবর্তী বেল পড়লে শুনবে কে?

*                                              *                                              *

অমিয়কান্তি মুখোপাধ্যায়। বাবা অনেকদিন নিখোঁজ হওয়ায় মামার বাড়ি থেকেই সে মানুষ। অবশ্য মামার আয়ও নেহাতই যৎসামান্য। সামান্য বিজনেস করে সে। আর অমিয়র মা ক’টা বাচ্চাকে পড়ায়। অমিয় কেমিস্ট্রিতে অনার্স নিয়ে ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করে। তারপর করে মাস্টার ডিগ্রী। স্কুলে একটা দিনও কামাই করত না বলে বন্ধুরা তাকে মজা করে ‘বাঘের বাচ্চা’ বলত। দেড় মাইল রাস্তা হেঁটে স্কুলে যেত সে রোজবাসভাড়া বাঁচত তাতে। সাইকেল তো নেই। যতদিন চাকরি পায়নি, সে টিউশানি চালিয়ে গেছে। টেন, ইলেভেন, ট্যুয়েলভ। কিছু টাকা তাতে সংসারে এসেছে। কিন্তু তা সামান্যই। মায়ের তাতে বিশেষ কিছু সুরাহা হয়নি। বাচ্চা পড়িয়ে, সংসারের সমস্ত কাজ সামলে মা যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ত, শরীরের যন্ত্রণায় যখন সে বিছানায় গা এলিয়ে দিত, অমিয় ভাবত একটা ভাল চাকরি আর না জোটালেই নয়। তার নিজের জন্যেও যেমন,  মায়ের জন্যেও তেমনি এই চাকরির দরকার। অবশেষে বছরখানেক চেষ্টার পর এস. এস. সির পরীক্ষা দিয়ে পেল সে এম. টি. এসের চাকরি। সেদিন মায়ের আনন্দ দেখে কে? অমিয়র মনে আছে, অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার যেদিন এল, মা সেদিন ফোন করে করে সমস্ত আত্মীয়স্বজনদের জানিয়েছিল তার এই চাকরি পাবার খবরটা। আর সেই লেটারের খামটা মা যত্ন করে রেখে দিয়েছিল। বলেছিল, ‘যতদিন বাঁচব, এটা আমি আমার কাছেই রেখে দেব’। অমিয় জিগ্যেস করেছিল, ‘প্রথম মাইনেতে তোমার জন্য কি আনব বল?’ মা বলেছিল, ‘চাকরি পেয়ে যা এনেছ, তার চেয়ে বেশী আর কিছুই চাই না বাবা’
হঠাৎ বেলটা আবার বেজে ওঠে। এবার কমিশনার সাহেব একটা ফাইল নামিয়ে দিতে বললেন আর বললেন তাঁর জন্য চা করে নিয়ে আসতে। অমিয়র ভেতরটা যেন মুষড়ে পড়তে লাগল। তবু সে বাধ্য। ফ্লাস্কে জল গরম করতে করতে তার এক-একবার মনে হচ্ছিল এ চাকরী করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। সে যে শিক্ষা পেয়ে এসেছে, যে পরিবেশ থেকে এসেছে – তার সঙ্গে এসব কাজ মোটেই খাপ খায় না। অফিসে চাকরি করতে এসেও যে তাকে ফাইফরমাশ খাটতে হচ্ছে এর থেকে দুঃখের আর কিছু নেই। কিন্তু চাকরি ছাড়াটাও কি সহজ এখন? বিশেষত সরকারী একটা চাকরি পাওয়ার পর, তার পক্ষে কি আর আগের ঐ কষ্টকর দিনগুলোতে ইচ্ছাকৃতভাবে ফিরে যাওয়া সম্ভব?
কমিশনারকে সেদিন চা করে দিল অমিয়। তাঁর চা খাওয়া হয়ে গেলে কাপ-প্লেট ধুয়ে রেখে দিল। তারপর আবার সেই নিরন্তর বসে থাকা পরবর্তী বেল পড়বার অপেক্ষায়। দুপুর দেড়টা নাগাদ কমিশনার সাহেব টিফিন করতে বসেন, তাঁর টিফিন হয়ে গেলে আবার পড়ল বেল। অমিয় ঘরে ঢুকতেই ঘরময় খাবারের একটা ভ্যাপসা গন্ধ পায়। মিঃ শ্রীবাস্তব তাঁর এঁটো টিফিনবস্কটার দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘ইয়ে সাফা করকে লে আও’। কমিশনারের অর্ডার শুনে অমিয় হঠাৎ যেন একটা ধাক্কা খেলতার সামনে থেকে যেন সবকিছু সরে যেতে থাকল। জীবনে এই প্রথম তাকে অন্য কারুর এঁটো বাসন মাজতে হচ্ছে। যাক্‌, তবু এও তো সরকারী চাকরি।
বাথরুমে এসে সে যখন বাসন পরিষ্কার করছিল, ঠিক সেই সময় একটা লোক হাত ধুতে এল। অমিয় নিজের কাজে ব্যস্ত থাকলেও স্পষ্টই বুঝতে পারল লোকটা তাকে দেখছে। অদ্ভুত, অবাকপারা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। একটা স্যুটেড-বুটেড ছেলে, দেখে মনে হচ্ছে যথেষ্ট শিক্ষিত – সে কি করে এই ধরনের কাজ করে? তার মনে হল, লোকটা মৃদু হাসছে, এ হাসি সৌজন্যমূলক হাসি নয়। বিদ্রুপের হাসি এটা। ঠিক যেমন তার বেশভূষা, তার পরিবেশ, তার শিক্ষা – তাকে নিয়ে বিদ্রুপের হাসি হাসছে, লোকটাও তেমনভাবেই হাসছে। অমিয় টের পায় তার ভেতরে একটা উতরোল চলছে। হঠাৎ থমকে গেল সে, চকিতে চাইল সে লোকটার দিকে নির্বাক একটা প্রতিবাদ নিয়ে। কিন্তু লোকটা কোথায়? কেউ তো নেই! বাথরুমে কেউ নেই, সে একা! নিজেকে যেন হঠাৎ করে ফিরে পেল অমিয়। টিফিন বক্স পরিষ্কার করা হয়ে গেছে, সেটা স্যারের জিম্মায় রেখে এল সে। তারপর বাইরের করিডরটায় আবার এসে বসল। জীবনে এত বড় গোলামী অমিয়কে কখনও করতে হয়নি। তার প্রতিটা পদক্ষেপ এখন শ্লথ, তার সমগ্র সত্ত্ব্বা এখন আবিষ্ট, আচ্ছন্ন – আত্মগ্লানিবোধে।   
এমন সময় পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এল গৌতমদা। কমিশনার সাহেবের সিনিয়র পি. এস। ‘কি ভাই, আজ তুমি একা? সব কাজ করতে হচ্ছে? উমাদি হঠাৎ করে কামাই করল...’
-      গৌতমদা শুনুন। - গৌতমদা চলে যাচ্ছিল, তাকে থামিয়েই সে ডাকল।
অমিয় যেন এবার ভেঙে পড়ল, ‘আমি আর এ চাকরী করতে পারব না গৌতমদা’।
-      কেন, কি হল হঠাৎ?

-      নাঃ, এসব কাজ আমার পোষাচ্ছে না। আমি পারছি না, বিশ্বাস করুন, আমি এখনই এখান থেকে চলে যেতে চাই’। কিছুক্ষণ থেমে সে আবার বলে, ‘আমি আগে যে টিউশানি করতাম, টাকা কম হলেও সেটাই আমার ভাল ছিল।
গৌতমদা বিচক্ষণ মানুষ। আর বছর দুয়েক আছে তার অবসর নিতে। অমিয় তার কাছে পুত্রপ্রতিম। তাই সে স্নেহার্দ্র স্বরে বলতে লাগল, ‘দেখো ভাই, চাকরি ছাড়াটা কোন কাজের কথা নয়, আর এই বাজারে একটা সরকারী চাকরির মূল্য অনেক। তুমি তো নিজেও সে কথা জানো। আর তোমার এই চাকরি ছাড়া আর ভাল আয়ও কিছুই নেই। সুতরাং সেদিকটাও তো ভাবতে হবে। বাড়িতে তোমার মা আছেন, তাঁর কথাও ভাবো। আর তাছাড়া পরিশ্রম করেই তো তোমায় এই চাকরি জোটাতে হয়েছে। তারপরেও যদি সেটা হারাতে হয়, তবে সেটা খুবই দুঃখের হবে। একটু বিবেচনা করে দেখো, আমার মনে হয় না একটা চাকরি পেয়েও একেবারে সাথে সাথে ছেড়ে দেওয়াটা তোমার উচিত হবে
-      কিন্তু যেসব কাজ আমাকে করতে হচ্ছে, তা যে আমি কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছি না। আমাদের অভাব ছিল মানছি। কিন্তু আমার মা তো তাই বলে কখনো পরের বাড়ি ঝি গিরি করতে যায়নি। সেও পড়াত। হয়ত তাতে টাকা এমন কিছু বেশি আসত না, কিন্তু সম্মান? তাকে আপনি অস্বীকার করবেন কি করে? আর আমিও যে এই পরিবেশেই মানুষ হয়েছি গৌতমদা।
গৌতমদা অমিয়র কথাগুলো শুনে কিছুক্ষণ চিন্তা করে নিল। তারপর বলল, ‘সবই বুঝলাম, তবু বলব চাকরি ছাড়াটা ঠিক নয়। এতে পলায়নী মনোবৃত্তিও কাজ করে। কেন তাকে প্রশ্রয় দেবে? তার চেয়ে বরং ভাল চাকরির পরীক্ষা দিয়ে অন্য চাকরি পেয়ে তারপর এই চাকরি ছাড়ো। তাতে লাভ অনেক বেশি’। এই বলে কিছুটা থেমে গৌতমদা আবার জুড়ে দিল, ‘আর দু-একদিন এইসব কাজ আমাদেরও করতে হয়েছে। এমনও একদিন গেছে, স্যারের ঘরে মিটিং চলছে, আমি চা সার্ভ করছি, শশাঙ্ক বিস্কুট দিচ্ছে। সুতরাং এই নিয়ে ঘাবড়াবার দরকার নেই’।
        কথাগুলো বলে গৌতমদা চলে গেল। আর করিডরে বসে অমিয় ভাবতে থাকে, সত্যিই কি ঘাবড়াবার দরকার নেই? যেগুলো সে ভেবেছে তা নিছকই ভুল? নিজের মনগড়া মিথ্যে গুমর?
হঠাৎ সে দেখতে পেল গৌতমদা আবার ফিরে আসছে। হঠাৎ সে অমিয়র দিকে আঙুল তুলে কি যেন ইঙ্গিত করতে চাইল। মুখে তার ফুটে উঠল হাসি – সেই হাসি যা সে দেখেছিল বাথরুমে সেই লোকটার ঠোঁটে। হঠাৎ পাশের অফিসঘরগুলোর দরজা খুলে গেল। সেখান থেকে একে একে বেরিয়ে আসতে লাগল শশাঙ্কদা, স্বপ্নাদি, সুমিতাদি, মাধবদা, জীবনদা, কুন্তল, অনুপদা – সমস্ত স্টাফেরা। তাদের সকলেরই মুখে সেই একই বিদ্রুপাত্মক হাসি। তারা এখন আর মুখ টিপে হাসছে না। তারা জোরে হাসছে, হাঃ হাঃ করে হাওছে আর তাকে ক্রমাগত আঙুল তুলে ইঙ্গিত করছে, অমিয় এদের দেখে ঘাবড়ে গেল, সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। আর ওকে উঠে দাঁড়াতে দেখে সবাই তার দিকেই এগোতে লাগল বড় অদ্ভুতভাবে, হাসতে হাসতে, ইঙ্গিত করতে করতে। অমিয় উপায়ান্তর না দেখে পালাতে চাইল সেখান থেকে। কিন্তু সকলে যে তাকে ততক্ষণে চারিদিক থেকে ঘিরে ধরেছে, আরো ঘিরে ধরছে। সে আকুল স্বরে চীৎকার করতে লাগল, আমাকে ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও’। কিন্তু তার গলা থেকে এক ফোঁটাও আওয়াজ বেরোল না।
‘কি হয়েছে ভাই, শরীর খারাপ লাগছে?’ গৌতমদার কথায় অমিয়র যেন হুঁশ ফিরল। সে স্থির দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ গৌতমদার দিকে চেয়ে রইল। তারপর চারিদিকে তাকিয়ে দেখল, কই, কেউ তো নেই এখানে! সব অফিসঘরই তো বন্ধ। ঠিক যেমনটা আগে ছিল, তেমনই রয়েছে। এ তার সাথে তবে কি হচ্ছে? কেন হচ্ছে এসব? তার একেবারে অসহ্য লাগল। সারা শরীর থেকে অবিরল ঘাম ঝরছে, পকেট থেকে সে রুমাল বার করল ঘাম মোছবার জন্য। গৌতমদাকে জানিয়ে দিল, চিন্তার কিছু নেই। সে ভালই আছে।
সেদিন দু-একটা ফাইল এ ঘর থেকে ও ঘর আনা নেওয়া ছাড়া আর বিশেষ একটা কাজ কিছু ছিল না। ছুটির সময় পড়ল আবার ডাক। এবার স্যারের ব্যাগটা নিয়ে তার গাড়িতে রেখে দিয়ে আসতে হবে।

*                                              *                                              *
বাড়ি ফিরতে ফিরতেই অমিয় মনস্থ করে ফেলল আর একদিনও সে এ চাকরি করবে না। কালই সে রেজিগনেশন করবার জন্য যা করতে হয়, তা জেনে নেবে এবং সেইমত কাজ শুরু করবে। তবে মায়ের সাথে পরামর্শ না করে তো আর কোন সিদ্ধান্তে নেওয়া যাবে না। ঠিক করল, মায়ের কাছ থেকে অনুমতি নিয়েই সে এই চাকরি ছাড়বে। তবে মায়ের সম্মতি পাওয়াটা খুব একটা অসুবিধা হবে বলে তার মনে হলও না। একটু চাপ দিলেই, একটু অনুনয় করে বললেই মা সবটা বুঝতে পারবে। আর সেও মুক্তি পাবে এই নিরন্তর মানসিক নিষ্পেষণ থেকে।
সেদিন অমিয় বাড়ি ফিরল রাত সোয়া আটটায় বাড়িতে এসেছে পাশের বাড়ির আরতিকাকিমা। মায়ের পাড়াতুতো বন্ধু। প্রায়ই সে আসে মায়ের সাথে গল্প করতে। তবে বড্ড বেশি পিএনপিসি করে বলে অমিয়র তাকে বড় একটা ভাল লাগে না। আরতি কাকিমা অমিয়কে ফিরতে দেখে হাসিমুখে জিগ্যেস করল, ‘কি রে অমিয়, অফিস থেকে এই ফিরলি বুঝি?’ অমিয় মৃদু হাসি টেনে বলে, ‘হ্যাঁ, এই সময়েই তো ফিরি’। কাকিমা বলে, ‘তা বাবা, নতুন চাকরি কেমন লাগছে?’ প্রশ্ন শুনে অমিয়র প্রথমটায় বিরক্তি লাগে, তারপর সেটা ঢাকতে ম্লান হাসবার চেষ্টা করে ঘাড় নেড়ে জানায়, ‘ভাল’। তারপর সে পাশের ঘরে চলে যায়। ঘরটা অন্ধকার। সে আলো না জ্বেলেই অফিসের ব্যাগটাকে ঘরের একপাশে ফেলে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। শুনতে পায়, আরতিকাকিমা মাকে জিগ্যেস করছে, ‘তোমার ছেলের অফিসে কাজের চাপ কেমন গো?’
মা বলে, ‘কাজের চাপ তো তেমন কিছুই নেই। ঐ কয়েকটা চিঠি টাইপ করতে হয়, ব্যস এই অব্দিই’।
-      যাক, তাহলে ভাল। আমারটা যে কবে একটা চাকরি জোটাবে। আসলে কি জানো তো, ওর মাথা আছে, অথচ কিছুতে মন দিয়ে পড়বে না। এই হল সমস্যা। আর আজকের দিনে যা কম্পিটিশন। তাতে মন দিয়ে না পড়ে কি আর ভাল চাকরি পাওয়া যায়?
মা তাতে সায় দিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ, সেই। অনেক পরিশ্রম করতে হয়। আমার ছেলেও তো একবছর চাকরির জন্য চেষ্টা করেছে, তবে পেয়েছে। এতদিন শুধু টিউশানি করত বলে লোকে নানা কথা বলত, ‘কত আয় হয়’, ‘তোদের চলে কি করে’, ‘কিভাবে চালাবি সংসার’। যাক, এখন তো সেসব বলতে পারবে না। এখন আমি গর্ব করে বলতে পারব, ছেলে আমার সরকারী চাকরি করে।....

মা হয়ত আরো কিছু বলছিল। অমিয় আর থাকতে পারল না। বিছানা ছেড়ে উঠে সে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিলমায়ের কথা এখন আর শোনা যাচ্ছে না। এটাই একটা স্বান্ত্বনা। একটা দীর্ঘশ্বাস আর ঘরময় সব অন্ধকার। নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। অমিয় বুঝে নিল, তার গোপন দুঃখের একমাত্র সাক্ষী হিসেবে কেবল এই অন্ধকারটুকুই পড়ে রয়েছে।
:: সমাপ্ত ::

রবিবার, ১২ জানুয়ারী, ২০১৪

অন্তরে নিহিত

স্বর্ণাকে সারাদিন গুমরে থাকতে দেখে রাতের দিকে অনুপ বিরক্তিতে বলে ওঠে, ‘তোমার কি হল বলতো? সারাদিন একঘেয়ে এই ঘরের কোণে চুপ করে বসে আছো যে? যাও যাও, ভাত বাড়ো, খেয়ে শুই’। স্বর্ণা খাট থেকে নেমে রান্নাঘরে যায়। এতগুলো কথার একটাও উত্তর সে করে না। কিন্তু অনুপ এদিকে গজগজ করেই চলেছে, ‘কি যে হয় তোমার মাঝেমাঝে, কিসুই বুঝি না’। খানিক বাদে স্বর্ণা ঘরে ঢুকে ভাতের থালাটা মেঝেতে ‘ঠকাং’ করে রেখে আবার রান্নাঘরে ফিরে যায়। তবে রান্নার কাজ এখন আর তার নেই। তাই চল্লিশ ওয়াটের বাল্বটাকে সে নিভিয়ে দেয়। তারপর চুন-পলেস্তারা খসা দেওয়ালটায় ঠেস দিয়ে বসে থাকে অন্ধকারে।
স্বর্ণার এই অন্ধকারটা ভালো লাগে, ভালো লাগে এই নিঃসঙ্গতাটাও। মন চায় একাকী থাকতে। ভালো লাগে না তার স্বামী, পুত্র, পরিবার। তার জীবনটা আজ নতুন মোড় নিলোএতদিন ধরে চলতে থাকা উৎকণ্ঠা, তার একটা পর্ব আজ শেষ। নতুন কোন চিন্তা আর সে চায় না এই চল্লিশোর্দ্ধ জীবনে। আসলে উৎকণ্ঠা আর উদ্বেগের এই লড়াইটাই যে তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল অহর্নিশ, এটা সে যেন আজ নতুন করে উপলব্ধি করতে পারল। সে অনুভব করে তার জীবনীশক্তি যেন আজ কিছুটা হলেও কমে এসেছে। এত পরিশ্রম শেষে সে যেন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। সে চাইছে আজ পালিয়ে যেতে, দূরে, আরও দূরে, বহুদূরে। কিন্তু বাধা একমাত্র তার বারো বছরের কিশোর টুটুন; এখন যে পাশের পাড়ায় পড়ার ব্যাচে। আসতে তার এখনও যে দেড় ঘণ্টা বাকি। তার জন্যই তো শুধু অপেক্ষা করে স্বর্ণা। তার এই অপেক্ষা শেষে টুটুন এলে...
টুটুনের কথা মন বলতেই কে যেন তার মধ্যে শিহরণ জাগায়। কারুর উপস্থিতি হঠাৎ যেন টের পায় স্বর্ণা। কারো তপ্ত শ্বাস সেন তাকে ছুঁয়ে চলেছে আশিরনখ। কোন বিদেহী কি আছে এ ঘরে? না, সে তো অসম্ভব। তবে? অবচেতনে কি তবে সাড়া জাগায় সে? আজকের দিনটা তো তারই; সেই কি তবে ডাক দিল এভাবে? দশ বছরের ফেলে আসা স্মৃতি হঠাৎই ধরে ফেলে স্বর্ণাকে কোন এক অদৃশ্য চক্রব্যূহেরাতটা বড়ো বেয়ারা। অজ পল্লীতে দূরে শেয়াল কুকুরের উদাত্ত স্বর ভেসে ভেসে আসে। আলো জ্বালায় স্বর্ণা। নজরে আসে রান্নাঘরের কোণে স্তূপীকৃত বাসনকোসন। সেগুলো সরালে একটা লাল মোটা খাতা। স্বর্ণার জীবনের একমাত্র নীরব দর্শক। ধুলোর পুরু স্তর এর আভরণ। তবু এই ভালো। সকলের দৃষ্টির বাইরে আছে তা। সামনে এলেই এ ডায়রি পড়ে ফেলতে কেউ এতটুকু দ্বিধা করবে না; বিশেষতঃ তার স্বামী অনুপ। কিন্তু না। এসব নিয়ে অনেক সয়েছে স্বর্ণা। অনেক ব্যঙ্গ বিদ্রূপ, অনেক অপমান সে মুখ বুঝে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। এ ব্যাপারে বন্ধু-বান্ধব-আত্মীয়-স্বজন-পাড়া-প্রতিবেশী সবাই সমান। সবাই ওকে আজও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, অবজ্ঞা করে। কিন্তু সত্যিটা যে কেউ জানে না, একমাত্র সে আর তার এই ডায়রিটা ছাড়া।
ধুলো ঝেড়ে শেষ থেকে পাতা ওল্টায় স্বর্ণা। শেষ পাতায় কতকগুলো ছবি আঁকা রয়েছে। কিছু মেয়েপুরুষের হাসি কান্নার ছবি, স্মাইলি। আগের পাতা ফাঁকা। আজ অব্দি সে পাতায় কিছুই লেখা হয়নি। তার আগের পাতায় লেখা ভর্তি। শেষ লেখাটা চার বছর আগের। শখ বলতে তার কেবল এই ডায়রি লেখাটাই ছিল অবশিষ্ট। আজ নানা বাধায়, সাংসারিক চাপে তাও গেছে হারিয়ে। স্বর্ণা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে পড়তে থাকে ডায়রির শেষ থেকে। স্মৃতিগুলো আর একবার রোমন্থন হয়ে যাক। তার বিচিত্র জীবনের অভিজ্ঞতা সে ছুঁয়ে যাক আরও একবার।
১৪ই জুলাই, ২০০৯
আজ বড় নার্ভাস লাগছে। কি লিখব কিছু বুঝতে পারছি না। খুন হয়েছে। ও খুন হয়ে গেছে। স্মরণ্য...হ্যাঁ আমার স্মরণ্য আর নেই। ওকে ওরা খুন করেছে কাল মীনা যখন খবরটা দিল, সত্যি বলতে কি আমি বিশ্বাসও করতে পারিনি। বিশ্বাস না করার যদিও কিছুই ছিল না। কারণ আমিও তো সবটাই জানতাম। শুধু স্মরণ্যকেই সব জানাতে পারলাম না। অনুপ কাল সকালে বলে গেল, একটু আসছি। আজ এই সন্ধ্যেতেও তার দেখা নেই। জানি ও আজ আসবে না, করে আসবে তাও জানতে পারব না। কিন্তু বাড়িতে যদি পুলিস আসে, অনুপকে খোঁজে? কি জবাব দেব আমি? ভাবতেও গা হাত পা শিউরে ওঠে। কোনদিন এমনটা যে হবে তা তো ভাবতেও পারিনি। টুটুনটাও ছোট। কিচ্ছু বোঝে না, শুধু জানে দুষ্টু লোকেদের বাড়ি পুলিস আসে। জানি না ওর মনে কি ভয় ধরবে। ঈশ্বর রক্ষা করো।
৩০শে মার্চ, ২০০৯
যেটা শুনলাম সেটা কি সত্যি! জানি না, তবে সত্যি হলে বড্ড ভয়ের কথা। সন্ধ্যেবেলায় অনুপের প্রতিদল পার্টির কিছু লোক এসেছিল। ওদের জন্য চা বানাতে যখন রান্নাঘরে এসেছি তখনই শুনলাম ওরা স্মরণ্যকে নিয়ে কথা বলছে। সামনে ভোট। স্মরণ্য জনদল পার্টির হয়ে প্রচার চালাচ্ছে। এতেই রাগ ওদের। ওদের একজন বলছিল স্মরণ্যকে ওরা দেখে নেবে। কিন্তু ওরা স্মরণ্যকে ঠিক চেনে না। তাই ঠিক হয়েছে অনুপ ওদের চিনিয়ে দেবে। হ্যাঁ, অনুপ ওদের এই কথাই দিয়েছে। আমার ঘাম ঝরছিল দরদর। এখনও লিখতে গিয়ে হাত কাঁপছে। অনুপ কি সত্যি স্মরণ্যর বাড়ি চিনিয়ে দেবে? ওরা তো তাহলে ওকে ছাড়বে না। হয়তো মেরেই ফেলবে। আমি তক্ষুনি ফোন করেছিলাম স্মরণ্যকে। কিন্তু ওর ফোন না জানি কেন সুইচড অফ ছিল। কি করব আমি। ওর সাথে যোগাযোগের আর তো কোন রাস্তাই আমার নেই। কিন্তু অনুপ তো এটা বোঝে ওই গুণ্ডাগুলো ওকে মেরে ফেলবে, তা সত্ত্বেও ও স্মরণ্যকে চিনিয়ে দেবে? জেনেশুনে একটা মানুষকে খুন হতে দেবে? এত নীচ ও? ছিঃ। আমার আর কিচ্ছু ভাল লাগছে না। মনে হচ্ছে, সবকিছুর জন্য দায়ী আমিই। আর কাকেই বা দোষারোপ করব? আমারই পাপের ফল এসব।
এর আগে অনেকগুলো পাতা ছেঁড়া, স্বর্ণাই ছিঁড়েছে সেসব। নিজেকে আর নিজের জীবনকথা গোপন রাখতেই সে একাজ করতে বাধ্য হয়েছে। মনে পড়ে তার সেদিনগুলো। পাগলের মত লিখে চলত সে পাতার পর পাতা। ডায়রির পর ডায়রি ফুরিয়ে যেত নিমেষে। নিজের জীবনের সমস্ত কষ্টগুলোকে সে
এভাবে উজাড় করে দিত তখন। শেষ হয়ে গেলে ডায়রিগুলো ফেলেও দিত সে চুপিসারে, অন্ধকারে। অবশিষ্ট আছে শুধু এটাই। কারণ একমাত্র এতেই তার জীবনের সমস্তটা সে রেখে দিতে পেরেছে। একাত্ম হয়ে গেছে সে এই ডায়রিটার সাথে। কি করে ফেলে দেবে সে তার এতবছরের পুরনো বন্ধুকে? এরসাথে তো সে কথা বলে একান্তে, একে সম্বোধনও করে সে। তার জীবনের সমস্ত ঘটনার সাক্ষী আছে এই ডায়রিহোক না তার পাতা ছেঁড়া, হোক না তা খাপছাড়া। তবুও...
১১ই জানুয়ারি, ২০০৬
সারাদিন বাড়িতে থেকে থেকে আর ভাল লাগে না। স্মরণ্যর সাথে যাও বা দেখাসাক্ষাৎ হত, এখন তাও বন্ধ। ওর সাথে যার সবথেকে ভাল বন্ধুত্ব হয়েছে সে টুটুন। যখনই আসত স্মরণ্য ওর জন্য চকোলেট বা লজেন্স এনে দিত। খেলনা গাড়িও এনে দিয়েছে কতবার। আমি কোনদিনও ওকে বারণ করিনি। ও ছাড়া টুটুনকে আর এসব দেবেই বা কে? অনুপ তো ওকে দেখলেই শুধু ‘এটা করিস না, ওটা করিস না’ করে যায়। সবসময় বাচ্চাকে বাধা দিলে চলে? বাবাকে দেখলেই টুটুন এখন তাই ভয় পায়। সামান্য জল ঘাঁটলেও ওর বাবা মারধোর করে। আর পড়াশুনো নিয়ে মারামারি তো রোজকার ঘটনা বাইরে ঝামেলা করে ঘরে এসে ছেলেটাকে শুধু মারে। আমার একদম সহ্য হয় না এসবএভাবে ওর মনে ভয় ধরিয়ে লাভ কি? এতো নিষ্ঠুরতা। তাই টুটুনকে বলেছি বাবার কাছে থাকবি না। বাবা মারলে, আমার কাছে চলে আসবি। আর সেখানে স্মরণ্য ওকে কি ভালবাসে! টুটুনকে দেখলেই হল, কাঁধে চড়াবে, পিঠে চড়াবে, কত খেলা করে ওর সাথে। ওদের মধ্যে একটা সুন্দর একাত্মবোধ তৈরী হয়ে গেছে। দেখে আমার খুব ভাল লাগে। কিন্তু এতেই আরও রাগ অনুপের।
স্মরণ্যও তো ক’দিন হল আসছে না। কি জানি ওর কোন অসুখ হল কিনা। কিংবা অনুপ ওকে আবার কিছু বলেছে কিনা তাও বুঝতে পারছি না। সেদিন তো অনুপ আমায় বলেই দিল, ওর সাথে তোমার খুব বন্ধুত্ব তাই না? দাঁড়াও ঘোচাচ্ছি সব। আমি কোন উত্তর দিইনি সেদিন। জানি না ও যে আবার কবে আসবে। অপেক্ষা করে আছি। কেউই তো নেই আমার। একমাত্র স্মরণ্যই যা আসত। নতুন কোন মানুষের মুখই দেখি না। পাড়ায় বেরোলে লোকের গুজুর গুজুর শুনতে ভাল লাগে না। সবাই শুধু আমাদের এই সম্পর্ক নিয়ে তিলকে তাল করে, গল্প বানায়। এখানে যারা আমার ভালো বন্ধু ছিল, তাদের সাথেও আর যোগাযোগ রাখতে পারি না। আর রাখবই বা কিভাবে? বাড়ি থেকে বেরোলেই যে অনুপ নানারকম প্রশ্ন করে। কোথায় যাচ্ছ, কেন যাচ্ছ... ওফ্‌ আর ভাল লাগে না। কেন? আমি কি তোমার সম্পত্তি নাকি? যা বলবে তাই শুনতে হবে?
স্বর্ণা উল্টে চলে ডায়রির পাতা। কত ঘটনা, কত দুঃখ যন্ত্রণা লেখা সেসব পাতায়। ওল্টাতে গিয়ে সে একটা পাতায় হঠাৎ আটকে যায়।
১১ই জানুয়ারি, ২০০০
কাল সারাটা রাত আমি ঘুমোতে পারিনি। খুব নার্ভাস লাগছিল। স্মরণ্য আমার এ কি ক্ষতি করে দিয়ে গেল? কি করব আমি এখন? কাল সন্ধ্যেবেলায় যখন ও এলো, আমি তখনই বুঝেছি এ লোককে ঘরে ঢোকানো ঠিক হবে না। কিন্তু তবু আমি ওকে আশ্রয় দিয়েছিলাম। কেন? শুধু ও কাকুতি মিনতি করেছিল বলে? নিজেও কি কিছু বুঝিনি তখন? না সে কথা তো বলতে পারি না। তা না হলে ঘরে যখন কেউ নেই, অনুপ নেই, বাবা বাইরের ঘরে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে, ঠিক তখনই ও এলোআর আমিও বোকার মত পেছনের দরজা খুলে দিলাম। স্মরণ্যকে ঘরে ঢুকতে দিলাম লুকিয়ে অন্ধকারে। আর লোকে যদি দোষ দেয় তো আমাকেই দেবে। কিই বা করবো আমি? সবই তো তুমি জান। আমার যে কি অবস্থা সে কথা তো সবই লিখেছি। আমিও তো একজন রক্তমাংসের মানুষ।
কাল সন্ধেবেলায় রান্নার কাজে যখন ব্যস্ত ছিলাম, হঠাৎ খেয়াল করলাম আলোটা কে যেন নিভিয়ে দিল। আমি কাঠ হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম এরপরই রান্নাঘরের দরজাটা নিঃশব্দে কেউ যেন বন্ধ করে দিল। সবই বুঝেছিলাম। তবু টুঁ শব্দটিও করিনি। খানিকবাদে খেয়াল করলাম আমার শাড়ি নেমে আসছে খসখস। বুকে অজানা হাতের ছোঁয়া, ব্লাউজটা আমার মুখ থুবড়ে পড়ল। পিঠে নিঃশ্বাসের ওম। অচেনা নয় তবু অন্য অনুভূতি। একবারও তো বাধা দিই নি।
কেন? কেন? কেন আমি ওকে আটকালাম না? মন আজ শুধু নিজেকে বলে, ছিঃ স্বর্ণা, ছিঃ। ধিক তোমাকে। কিন্তু অন্তর্যামী, তুমি তো সব জানো। পারো তো আমাকে ক্ষমা করে দিও।
১৫ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৯
কত যে বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়। এই আজ যেমন। রোজকার মত গতকালও অনুপ মদ খেয়ে হাসপাতালের মাঠে পড়েছিল। ফেরার পথে হয়েছে এক অ্যাক্সিডেন্ট। মোটরসাইকেলের সাথে ধাক্কা খেয়েছে। রোজই যেমনটা হয় আর কি। যাই হোক চোট নাকি বিশেষ কিছু লাগেনি। শুধু পায়েই যা অল্পবিস্তর লেগেছিল। একটা লোক ওকে রিক্সা করে নিয়ে এলোঅদ্ভুত ব্যাপার! রিক্সার ভাড়া ঐ লোকটাই মিটিয়ে দিল। বলে, মোটরসাইকেলটা নাকি ও চালাচ্ছিল, তাই দোষটা ওরই। আচ্ছা, এমন লোকও কি আজকালকার দিনে পাওয়া যায়? আমি অনুপের জন্য বিশেষ একটা চিন্তা করিনি, কারণ প্রতিদিনই ও এরকম মদ খেয়ে টলতে টলতে বাড়ি ফেরে। ফেরার সময় কোথাও না কোথাও চোট পায়। আগে এসব নিয়ে চিন্তা করতাম। ওকে মদ খেতে বারণ করতাম। কিন্তু তার ফলটা যে কি হত সে তো তুমি জানোই। তাই আজকের ঘটনাটায় বেশী একটা ভাবিনি। কিন্তু অবাক লাগল আমার ঐ লোকটার আচরণে। আরো আশ্চর্য হয়েছিলাম, যখন ও পরের দিনও এলোঅনুপ কেমন আছে জিগ্যেস করল। অনুপ সেদিন অনেকখানি সুস্থ হয়ে গেছিল। গরম জলে পা সেঁকে স্বাভাবিকভাবেই হাঁটতে পারছিল। লোকটার সাথে পরিচয় করে আমার ভালই লাগল। বেশ গুছিয়ে কথা বলতে জানে। আমাকে সম্মান দিয়ে জানে। আমাকে ‘ম্যাডাম’, ‘আপনি’ করে কথা বলছিল। এখানে অন্য কেউ তো আমায় সে সম্মান দেয় না। তাছাড়া জানলাম ওর ডাক্তারি বিদ্যেও জানা আছে। হাতুড়ে ডাক্তার। আমাদের এখানে অনেকেই তাই ওর ওপর ভরসা করে। কিছু ওষুধও নিয়ে এসেছিল সেদিন। আর আলাপ হলেই যেমনটা বলতে হয় তেমনি আমিও বলে দিলাম, আবার আসবেন কিন্তু। জানি না, আর আসবে কিনা। যাবার আগে নামটা শুধু বলে গেল, স্মরণ্য।
সত্যি বলতে কি, এমন মানুষ আমি যেন বহুদিন পরে দেখলাম। এ বাড়ির সকলেই আমার সাথে দুর্ব্যবহার করে। অনুপের মা-বাবা আমায় গালাগালি দেয়, নানা ছোটখাটো কাজ নিয়েই তিরস্কার করে। আর অনুপ তো আগে রোজই মারধোর করত। আমি মাথা পেতে সব সহ্য করি। কিন্তু এখন বুঝি আমিও শুধুই অবহেলার যোগ্য নই। আমায় সম্মান না দিতে পারলে এবার আমিও ছেড়ে কথা বলব না।
৭ই অগাস্ট, ১৯৯৩
পাঁচ বছর পা হয়ে গেল আমাদের বিয়ে। তবুও মা হতে পারলাম কই? এখানে এসেই বুঝেছি এরা আমায় কেউ ভালবাসে না। এমনকি এদের নিজেদের মধ্যেও কোন মিলমিশ নেই। অনুপ নিজের মা-বাবাকে জোচ্চোর বলে, বেইমান বলে। ছিঃ, এই আমার স্বামী? অবশ্য স্ত্রীর গায়ে হাত তুলতেও যার দ্বিধা হয় না তার মুখে কোন ভাল কথার আশা না করাই ভাল। দিনরাত মুখে গালাগালি আর অসভ্যতা। মদ, গাঁজা কি না খায়! বারণ করলেই গায়ে হাত তোলে। তাই ঠিক করেছি আর কিছু বলব না। ওর যা ইচ্ছে ও তাই করুক। কপাল করে স্বামী পেয়েছি বটে! আশা ছিল, ঘরে নতুন কেউ এলে আমার তাকে নিয়েই সময় কাটবে। তাকে আমি ভাল করে মানুষ করব। যেমন করে আমার মা-বাবা আমায় করেছিল। তাকে কিছুতেই আমি অমানুষ হতে দেব না। কিন্তু সবটাই কপাল। আমাদের কোন বাচ্চাই হল না।
শেষ লেখাটা ডায়রির প্রথম পাতায় ছিল। পড়া শেষ হতেই স্বর্ণা একটা পেন নিয়ে ডায়রির শেষ পাতাটায় লিখতে শুরু করে –
১৪ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩
আজকের দিনটা বড় আনন্দের। কারণ আজ দুটো খুনিই সাজা পেয়েছে। যাবজ্জীবন হয়েছে ওদের। স্মরণ্যের আত্মা আজ কিছুটা হলেও শান্তি পেল। আমার এতদিনের প্রতীক্ষা আজ শেষ হল। একথা মানি যে অনুপও দোষী। তাই নিয়মমতো ওরও শাস্তি হওয়া উচিৎ ছিল। অন্তত ওর শাস্তিটা আমি চেয়েছিলাম। কিন্তু ওর সাজা হল না
স্মরণ্য, তোমার সাথে তো শেষ দেখাটুকুও আমার হল না। অনুপ আমাদের মধ্যেকার সম্পর্কটা বুঝতে পেরেছিল। তাই তো ও তোমায় সরাতে চেয়েছিল। কিন্তু ও এটা জানে না যে টুটুন ওর নয় বরং তোমার ছেলে। চিন্তা নেই, এটা কোনদিন ও জানবেও না। এসব নিয়ে আর ভাবি না। কারণ অনুপ যদি দিনের পর দিন আমায় অসম্মান করতে পারে, আমার গায়ে হাত তুলতে পারে, তবে আমারও সহ্যের সীমা আছে। অনুপ সেটা বোঝেনি, কেউ বোঝেনি সেসব। কিন্তু তুমি তো সবই জানতে। কেউ না বুঝুক, একমাত্র তুমিই আমায় বুঝেছিলে। তোমার কথা আমার খুব মনে পড়ে স্মরণ্য। আর কিছু লিখব না। শুধু এটুকুই চাই, তুমি যেখানেই থাকো যেন শান্তিতে থেকো। আমি তো এখানে আছি শুধু টুটুনের জন্য। ওকে মানুষ করতে পারলেই আমার কাজ শেষ। তারপর আমিও চলে যাব তোমার কাছে স্মরণ্য। সেখানে আমাদের কে বাধা দেবে?

স্বর্ণা হঠাৎ খেয়াল করে ওর চোখদুটো জলে ভরে গেছে কোন এক অব্যক্ত কষ্টে। আর ঠিক তখনই সে শুনতে পায় অনুপের কাশির আওয়াজ, খুব কাছ থেকে।  

প্রকাশিত - ইতিকথা ওয়েবম্যাগাজিন