পৃষ্ঠাসমূহ

মালঞ্চ নার্সিংহোম লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
মালঞ্চ নার্সিংহোম লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

বৃহস্পতিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০১৩

অ্যাক্সিডেন্ট

বিকেল তখন বেশ গাঢ় হয়ে এসেছে। মালঞ্চ নার্সিংহোমের ওটি ডিপার্টমেন্টে ডাঃ রায় গম্ভীরভাবে পেশেন্টের পালস পরীক্ষা করছেন। ফ্যাকাশে সাদা বেডে শুয়ে থাকা পেশেন্টের সারাটা মাথা জুড়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা। স্যালাইন চলছে। স্থির হয়ে আছে তার দেহটা। নার্স দুজন একদৃষ্টে ডক্টরের দিকে তাকিয়ে। পালস দেখা শেষ হলে হাতটা আস্তে করে নামিয়ে রাখলেন ডক্টর। তারপর একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওটি থেকে বেরোতেই এক ভদ্রমহিলা উদগ্রীব হয়ে তাঁর দিকে এগিয়ে এল। অবস্থা কেমন, ডাক্তারবাবু? প্রশ্নটা যেন ভদ্রমহিলার ভেতর থেকে আপনিই বেরিয়ে এল। ডাক্তার মাথাটাকে সামান্য নাড়িয়ে বললেন, তেমন পজিটিভ নয়। আর আধঘণ্টা ওয়েট করছি। আশা করি, তার মধ্যে সেন্স ফিরবে। লেটস সি, নাউ। চশমাটা বাঁ হাত দিয়ে ঠিক করে দ্রুত পায়ে ডাক্তারবাবু চলে গেলেন অন্যদিকে। পাশ থেকে এক ভদ্রলোক সেই ভদ্রমহিলার কাঁধে হাত রাখতেই ডুকরে কেঁদে উঠলেন তিনি। অন্য পাশে দাঁড়িয়ে ছিল স্বপ্ন। মাসির এই কান্না দেখে ওরও চোখ ফেটে জল আসতে লাগল। আর সবথেকে বেশি রাগ হতে লাগল তার নিজের ওপর। আসলে এই সবকিছুর মূলে যে সেই, একথা তো আর অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। সেদিন ওর কি মনে হয়েছিল কে জানে? ঠিক করল, মাসতুতো বোন লিপিকে সে স্কুটি চালানো শেখাবে। খেয়ালটাও যে এমনিতে আসে নি। আসলে ওর বাবা সদ্য স্কুটি কিনেছে। নিজের কাজে অনেক সময় বাইরে-টাইরে যেতে হয়, এই ভেবেই কেনা। কিন্তু সেটা যে এভাবে স্বপ্ন দখল করে নেবে, তা কে বুঝেছে। দুদিন শুধু লেগেছে তার শিখতে। তারপর দোকানে যাওয়া, বন্ধুর বাড়ি যাওয়া, বন্ধুদের সাথে ফুর্তি করা, এমনকি কদিন আগে ওটা নিয়ে পড়তে যাবে বলেও ঠিক করেছিল। কিন্তু মায়েরপইপই করে মানাআর বাবার চোখ রাঙানিতে শেষমেশ তাকে ক্ষান্ত হতে হয়েছিল। কিন্তু তাতেও তার হল না। কাউকে না শেখালেই তার নয়। কাকে শেখান যায়, কাকে শেখান যায় ভাবছে। এমন সময় মওকা নিজেই এসে হাজির। কদিনের ছুটি নিয়ে দুদিন আগে মেসোরা এসেছিল। ব্যস! তাকে আর পায় কে? মাসতুতো বোন ছিল লিপি। ওকেই ধরল। বয়সের দিক থেকে ওরা প্রায় পিঠোপিঠি। মাত্র তিন বছরের ফারাক। তাই প্রথম ছাত্রী তার একরকম ঠিকই হয়ে গেল। কিন্তু লিপির বয়স যে পনের সে খেয়াল তার নেই। ওকে চুপি চুপি সেদিনই দুপুরে বলে, অ্যাই বুনু, স্কুটি চালাবি? আয় তোকে শিখিয়ে দিই। দুপুরের ঘুম সেরে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে লাফিয়ে ওঠে বুনু। এদিকে বুনু ভাল করে সাইকেলটাও চালাতে পারে না। ডেসপারেট মেয়ে! বিকেল হতে না হতেই বেরিয়ে পড়ল দুজনে। মা আর মাসি তখন দোতলায় ঠাট্টা-ইয়ার্কিতে ব্যস্ত। হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে মাঝেমধ্যে। আর এদিকে বাবা আর মেশো দুজনেই বেশ নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। যাক নির্বিঘ্নেই হবে শেখানোটা। স্বপ্নের মনটা আনন্দে নেচে ওঠে। গাড়ি চালাতে শিখে যদি কাউকে নাই শেখান গেল, তাহলে কি আর কোন লাভ আছে? আর স্কুটি চালান একেবারেই সোজা। আলাদা করে স্টার্ট দেওয়ার কোন ঝামেলা নেই, গিয়ার-ফিয়ার চেঞ্জেরও কোন পাপ-বালাই নেই। সব দেখেশুনে বুনু বলে, বাঃ, তো খুব সোজা! কোন চিন্তাই নেই। যা হোক করে উঠে বসল বুনু। গাড়িতে স্টার্ট দিয়েই রেখেছিল স্বপ্ন। বলেছিল, পরের বার থেকে তুই- স্টার্ট দিয়ে চালাবি, বুঝলি? মাথা নেড়েই বুনু আক্সিলেটরে দিল জোর চাপ। আসলে জানতোও না চাপ দেওয়ার কায়দাটা। আর স্বপ্নও সেকথা ওকে বলতে ভুলে গেছে। ব্যস। গাড়ি গিয়ে ল্যাম্পপোস্টে মারল এক ধাক্কা। লিপি ছিটকে পড়ল রাস্তায়। মাথা ফেটে চৌচির। চারিদিকে শুধু রক্ত আর রক্ত। মাথাটা ধরে রাস্তায় ছটফট করতে থাকে সে। পড়িমরি করে ছুটে এল স্বপ্ন। রাস্তার লোকজন সব ছুটে এসেছে। চীৎকার-চেঁচামেচিতে বাবা আর মেশোর ঘুম গেল ভেঙে। আর মা-মাসি দুজনেই তখন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছে নিচে
ভাগ্যিস কাছেই মালঞ্চ নার্সিংহোমটা ছিল। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেখানে ভর্তি করান হল। কিন্তু ততক্ষণে ওর সেন্স হারিয়ে গেছে। ব্লিডিং হয়ে চলেছে ক্রমাগত। ডাক্তারের নির্দেশে ব্যান্ডেজ বেঁধে আগে ব্লিডিং বন্ধ করা হল। তারপর হল সিটি স্ক্যান। কিন্তু স্ক্যানের রিপোর্টে খারাপ কিছু মিলল না। কোন ইন্টারনাল হেমারেজ নেই। তবু মারাত্মক ব্লিডিং এর কারণে ক্ষতির একটা আশংকা ছিলই। বেশ কয়েক ঘণ্টা পার হয়ে গেল। কিন্তু লিপির সেন্স ফিরল না। অপেক্ষা করা হল আরও বেশ কয়েক ঘণ্টা। তবুও কোন রেসপন্স নেই। অবশেষে ডাক্তার আটচল্লিশ ঘণ্টা সময় দিলেন। যদি তার মধ্যেও সেন্স না ফেরে তাহলে পেশেন্ট কোমায় চলে যেতে পারে। নার্সকে বললেও ডাক্তারের এই কথাগুলো সেদিন মাসির কানে ঠিকই গিয়েছিল। সারাদিন ধরে তার খাওয়া নেই, ঘুম নেই, তবু ওরা সবাই ভেবেছিল দু-দিনের মধ্যে জ্ঞান ঠিকই ফিরবে। কিন্তু সেই আটচল্লিশ ঘণ্টা শেষ হতে এখন আর মাত্র আধঘণ্টা বাকী। এর মধ্যে দু-একবার হাল্কা রেসপন্স করলেও সেন্স কিন্তু তার ফেরেনি। বুনু জাগবে তো কিছুক্ষণের মধ্যেই? প্রশ্নটা স্বপ্নের ভেতরে ঘুরপাক খেতে লাগল। ভেতরটায় কষ্ট হতে লাগল তার। একটা অপরাধ বোধ তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেতে লাগল। এই দুদিন সে তো সর্বশক্তি দিয়ে সবাইকে সাহায্য করেছে। দরকার হলেই ওষুধ এনে দিয়েছে, ইঞ্জেকশন এনে দিয়েছে। যার যা প্রয়োজন সমস্ত কিছু সে মনপ্রাণ দিয়ে করেছে। শুধু এটুকুই তার প্রার্থনা ছিল, বুনুকে যেন সে আবার আগের মত ফিরে পায়। আবার যেন তারা আগের মতই খেলা করতে পারে, খুনসুটি করতে পারে। কিন্তু তার সেই প্রার্থনা সফল হল না কেন? সে তো কারুর কোন ক্ষতি চায় নি। ভাবনাগুলো তাকে যেন পুড়িয়ে দিয়ে যেতে লাগল। মা, বাবা, মাসি, মেসো – সবাই থাকতেও নিজেকে বড্ড একা মনে হতে লাগল তার। বারবার মনে হতে থাকে, কেন গাড়ি চালানো শেখাতে গেল সে? বুনুর এতবড় ক্ষতি সে কিভাবে করল? একটু যদি সে ভেবে দেখত, কিংবা যদি গাড়ি চালাবার কথাটা তার মাথায় না আসত, কিংবা যদি... এইভাবে কয়েক সহস্র সম্ভাবনার মিথ্যে কল্পনার ভিড়ে অনুশোচনায় দগ্ধ হতে লাগল সে। মাসি কিংবা মেসো – কারুর দিকেই এখন আর তাকানোরও সাহস নেই তার। তার শুধু মনে হতে থাকে, অপরাধ করেছে সে। সে পাপী। আর এত ব্যস্ততা সত্ত্বেও সে এটাও খেয়াল করেছে যে মাসি আর মেসো দুজনেই তাকে এড়িয়ে চলছে এ ‘কদিন। বুকের মধ্যেটায় একটা কষ্ট জমে আসে তার। সে তো আর বুনুকে কম ভালবাসত না। তার মনের পরতে পরতে ভেসে ওঠে ছোটবেলার সেইসব দিনগুলো। যখন বুনুকে সে পড়াত। অনেক ছোট ওরা তখন। মাসিরা তখন এই নৈহাটিতেই থাকত। সে কিনা তিনবছরের বড় দাদা। তাই বুনুকে সে না তো কে পড়াবে? বুনুকে কড়া গলায় বলত, অনেক খেলা হয়েছে, এবার পড়তে বসবি চল। বেশীরভাগ দিনই বুনু সহজে পড়তে চাইত না। তখন ওর কানটা ধরে মুলে দিত দাদা। আর তাতেই ভ্যাঁ করে চীৎকার জুড়ত বুনু। আবার এমনও অনেক দিন যেত যেদিন দাদা অঙ্ক না পারার জন্য বাবার কাছে বকা খেত। তখন বুনু আড়ালে ফিক করে হেসে উঠত। এভাবেই কখন কেটে গেছিল তাদের ছেলেমানুষিতে ভরা শৈশব। তাদের ভালবাসা, আন্তরিকতা সমস্তটাই একটা নিবিড় বন্ধনে তাদের ঘিরে রেখেছিল। আর তাই হয়ত অনেক বড় হয়েও সেই দাদার কাছেই বুনু পড়তে চাইত। বলত, বড় হলেই বা। তোর কাছে না তো কার কাছে পড়ব? তারপর মাসিরা একদিন চলেও গেল নৈহাটি ছেড়ে। সেটল হল ওরা দূর্গানগরে। চলে যাওয়ার দিনটাতে, মনে আছে, কিছুতেই যেতে চায়নি বুনু। শেষে ও ঘুমিয়ে পড়লে গাড়ি করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তবু মাসিরা অন্যান্য আত্মীয়দের মত নয় যারা তাদের ভুলেই গেছে। মাসিরা প্রায়ই আসে ওদের বাড়ি। ওরাও যায়। তাই স্বপ্নের সেই দাদাগিরি, সেই শাসন আজও ঘোচেনি। সে তাই এখনও বুনুকে সব কিছু নিজের হাতে শেখাতে চায়। বুনুর সব কিছুর ওপরেই যেন তারই শুধু অধিকার। আর তাই ও স্কুটিটাও বুনুকে নিজের হাতে শেখাতে চেয়েছিল। কিন্তু নিজের পক্ষে আনা কোন যুক্তিই আজ সে নিজেই মেনে নিতে পারছে না। তার কেবলই মনে হতে থাকে, সে অপরাধ করেছে। একটা মস্ত বড় অপরাধ। এর কোন ক্ষমা নেই। নিজের মনেই কথাগুলো বলে ওঠে স্বপ্ন। কেউ তাকে লক্ষ্য করে না। মা বেঞ্চিতে মাথাটাকে হেলান দিয়ে বসে আর বাবা মাথা নিচু করে গালে হাত দিয়ে বসে বসে পা দুটো হাল্কা দোলাচ্ছে। ঘড়ির দিকে তাকাতেই জবাব পাওয়া যায় আটটার। বুনু কি আর সাড়া দেবে না? না না। সে কি করে হতে পারে? এই তো সেদিন সে কি সুন্দর তাকে বলেছিল, হ্যাঁ, আমায় গাড়ি চালানো তুই –ই শেখাবি, চল। কিন্তু সে কি করে এত নীরব হতে পারে? চোখ ফেটে জল আসতে থাকে স্বপ্নের। ডাঃ রায় সামনে দিয়ে ঢুকলেন ওটি তে। মাসি দুহাতে মুখ চাপা দিয়ে বসে আছে। মেসো মুখটাকে অন্যদিকে ফিরিয়ে গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে। হয়ত বা নিজের মেয়ের মুখটাকেই কল্পনা করছে। আর যাদের অনুশোচনা আর আক্ষেপ সবথেকে তীব্র। স্বপ্নের সেই মা-বাবার মুখগুলো একেবারে শুকিয়ে এসেছে। একদিকে রয়েছে তাদের নিজের ছেলে। অন্যদিকে তাদের বোনঝি। যে নিজের মেয়ের থেকে কোন অংশে কম নয়। যাকে তারা নিজের ছেলের সাথেই পড়তে দিয়েছে, খেলতে দিয়েছে, মানুষ হতে দিয়েছে। তবু মায়ের মনটা হু-হু করে ওঠে নিজের ছেলের মুখটার দিকে তাকিয়েও। কিছু না বললেও স্বপ্নের ভেতরের কষ্টটা মা ঠিক টের পেয়ে যায় কিভাবে। বেঞ্চিতে বসে মাথাটাকে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে আড়চোখে একবার স্বপ্নকে দেখে নেয় মা।
হঠাৎই চমক ভাঙে ডাঃ রায়কে ওটি থেকে বেরোতে দেখে। মাসি ভয়ার্ত চোখে তাকায় ডাক্তারের দিকে। কিছু জানতে চাওয়ারও সাহস হয় না তার। মেসোই ডাক্তারের দিকে এগিয়ে যায়। যা জানা গেল, অবস্থা বিশেষ কিছুই উন্নতি হয় নি। পেশেন্টকে মেডিকেল কলেজে রেফার করতে হবে। তারপর কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে আবার তিনি আরো কিছুক্ষণ ওয়েট করার কথা বললেন। তার কথাগুলো সবথেকে বেশী যার বুকে বাজল সে স্বপ্ন। তার ইচ্ছে এতটুকু মিটল না। তার বুনু কথা বলল না। এর থেকে আর বেশী কষ্টের কি হতে পারে? এবারে তার মধ্যে শুধু নিজেকে দায়ী করা নয়, একটা ভয়ও দানা বাঁধতে লাগল। বুনুর যদি কিছু হয়ে যায়? তখন তার নিজের অবস্থাটা কি হবে? এই ঘটনার কালো দাগটা কি সারাজীবনেও মোছা যাবে? মূহুর্তে সামনের অনিশ্চিত ভবিষ্যতটা তার কাছে যেমন অকল্পনীয় তেমনি ভয়াবহ হয়ে উঠল। নার্সিংহোমের পরিবেশটা তার বিশ্রী লাগতে থাকে। যে কোন ভাবে হোক, এই জায়গাটা তাকে ছেড়ে যেতেই হবে। অসহ্য লাগে তার চারিদিক। গা গুলিয়ে ওঠে তার বারবার। সে কোন কিছু আর না ভেবে ছুটে বেরিয়ে এল নার্সিংহোম ছেড়ে। যাওয়ার আগে একবার যেন অস্পষ্টভাবে শুনতে পায় মায়ের গলা, কি রে, কোথায় যাচ্ছিস? কিন্তু সেসবে তার তখন মন নেই। সে তখন শুধু ছুটে চলে যেতে চায়। দূরে, আরো দূরে, বহুদূরে। সারাটা পৃথিবী তার কাছে অসহ্য ঠেকে। এসবের মধ্যেও তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে বুনুর হাসিমাখা মুখটা। নিজেকে বড্ড ছোট বলে মনে হয় তার। সে তার এই নিষ্পাপ বোনটাকে কি করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিল? পাপী, সে পাপী। তার ভাবনা ভুল হোক, ঠিক হোক – কিন্তু আজ তার সামনে কেউ নেই যে তার এই ভাবনা থেকে তাকে বের করে আনবে। সে তাই চলতে লাগল একাকী। যেদিকে তার পা দুটো তাকে টেনে নিয়ে যায়। নিজের চলার ইচ্ছা শক্তিটাও যে তার ফুরিয়ে গেছে। সোজা রাস্তা ধরে চলতে চলতে একসময় সে সামনে দেখতে পেল হাইওয়ে। গাড়িগুলো ছুটে চলেছে সোঁ সোঁ করে। তার সারাটা মন তখন ক্লান্ত, অবসন্ন। একবার মনে হল, এই গাড়িগুলোর চাকার তলায় সে নিজেকে শেষ করে দেয়। কিন্তু পরক্ষণেই মন তাকে একাজে বাধা দিল। কেন জানি হঠাৎ তার মনে হল, এখুনি ফিরে গেলেই সে বুনুকে সুস্থ দেখতে পাবে। সে তার দিকে তাকিয়ে হাসবে। বলবে, কি রে? ভেবেছিলি আমি আর উঠবো না? ধুর বোকা, তাই কি হয়? এই দেখ, আমি কি সুন্দর তোর সাথে কথা বলছি। ভাবনায় হঠাৎ ছেদ পড়ে স্বপ্নের, একটা অটোর ঘরঘর আওয়াজে। অটো থেকে এক অল্পবয়সী ভদ্রমহিলা তার মেয়েকে নিয়ে নামল। স্বপ্নের চোখ পড়ে ঐ বাচ্চা মেয়েটার দিকে। বছর পাঁচ কি ছয়ের ফুটফুটে মেয়ে। তার বুনুকেও এই বয়সে ঠিক এমনই দেখতে ছিল। তারও এমনই দুটো গভীর কালো চোখ, ফর্সা গাল...... হঠাৎ হাইরোডের ওপার থেকে কে একটা ডেকে উঠতেই বাচ্চাটা ‘মামা’ বলে চেঁচিয়ে একছুট দিল রাস্তার ওদিকে। ওর মা তখন অটোর ভাড়া দিতে ব্যস্ত। গাড়িগুলোকে কেয়ারই করল না বাচ্চাটা। আর ঠিক সেই সময়ই একটা টাটা সুমো বিপুল বেগে বাচ্চাটার একেবারে সামনে এসে পড়ল। ওর মা চীৎকার করে ওঠে আতঙ্কে। মূহুর্তে পুরো দৃশ্যটা ঘটে যায় স্বপ্নের সামনে। সে আর কোন দিকে না তাকিয়ে সোজা দিয়ে বাচ্চাটাকে ঠেলে সরিয়ে দেয় রাস্তার পাশের ঝোপে। তারপরে সে নিজেও উঠতে যায়। কিন্তু তার আর সময় নেই। গাড়ির এক ধাক্কায় অদূরে ছিটকে পড়ে স্বপ্নের দেহটা। একটা পাথরে ধাক্কা লেগে ওর মাথাটা টুকরো টুকরো হয়ে
যায় নিমেষে। 

ঠিক এই সময়েই মালঞ্চ নার্সিংহোমের নার্স হন্তদন্ত হয়ে ডাঃ রায়কে জানায়, ডক্টর, পেশেন্ট রেসপন্স করছে। চমকে ওঠেন ডাঃ রায়, বলছ কি? নার্স হেসে বলে, হ্যাঁ ডক্টর। ও মাকে দেখতে চাইছে। খবরটা পেয়ে ডাঃ রায়ের মন আনন্দে নেচে ওঠে। তখনই তিনি ছুটলেন পেশেন্টের রুমে। তারপর মাসি, মেশো, বাবা, মা সবাইকেই জানানো হয় খবরটা। সবাই নিশ্চিন্ত হয়, লিপি আবার ভাল হয়ে গেছে। আবার তাকে আগের মত সুস্থ দেখবে সবাই। মাসি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না। হু-হু করে কেঁদে ওঠে। খুশীতে মেশো আর বাবার চোখেও জল এসে যায়। মাও খুব খুশি হয়। কিন্তু তারপরেই উদ্বিগ্ন স্বরে বলে, ছেলেটাকে খবরটা জানানো দরকার। ও কোথায় গেল?
প্রকাশিত - এপার বাংলা ওপার বাংলা (বই)