বাসস্ট্যাণ্ডে দাঁড়িয়ে আছি বাসের অপেক্ষায়। নামেই বাসস্ট্যাণ্ড।
কবেকার কোন বটগাছের গায়ে সাঁটা ‘বাস থামিবে’। তবু এখানেই বাস থামে। এখান থেকেই আমি
রোজ অফিস থেকে ফেরার বাস ধরি। এই যেমন আজ। তবে আজ শরীরটা খারাপ লাগছিল বলে অফিস
থেকে একটু আগেই বেরিয়ে পড়েছি। আর অফিসে কাজের যা চাপ তা যারা এ ব্যাঙ্কে কাজ করে
তারাই জানে। সর্দিটা এমনিতেই ছিল। কাজের চাপে শুরু হয়ে গেল মাথা যন্ত্রণা। তবে এখন
মনে হচ্ছে এই সময় বেরিয়ে ভুলই করলাম। এই প্যাচপেচে অসহ্য গরমের দুপুরে শালোয়ারটা
জ্যাবজেবে হয়ে ভিজে গেছে ঘামে। একটা বন্ধ দোকানের শেডের তলায় দাঁড়িয়ে ওড়নাটাকে
মুখের ওপর নাড়াতে লাগলাম। ঠিক এমন সময় দেখি একটা ছেলে আমার পাশেই এসে দাঁড়াল।
আমারই মত বয়স। বেশভূষায় মনে হল না কোন ভাল ঘরের ছেলে। হাড়গিলে চেহারা। কোটরে ঢোকান
দুটো চোখ। আমি ভেবেছি, হয়ত বাস ধরবে। তাই প্রথমটায় ততটা খেয়াল করিনি। খানিকক্ষণ
বাদে যেন মনে হল, ছেলেটা আমার দিকেই বারবার তাকাচ্ছে। কেমন একটা অস্বস্তি বোধ
করলাম। ভরদুপুর। তাই রাস্তায় লোকজন প্রায় নেই। দোকানপাটও সব বন্ধ। মেন রোডটা দিয়ে
মাঝেমাঝে হুশ-হাশ করে দু-একটা গাড়ি ছুটে যাচ্ছে। আমি ওড়নাটাকে ঠিক করে গুছিয়ে
নিলাম। সবুজ শালোয়ারটা ঘামে গায়ের সাথে একেবারে লেপ্টে আছে। সেটাকেও একটু ঠিক করে
নিলাম। বলা যায় না কিছু, কার মনে যে কি আছে। আর যা দিনকাল পড়েছে। এইসব ভেবেই একটু
পাশে সরে এসে দাঁড়ালাম। এমন সময় সামনে
বিকট ঘরঘর আওয়াজে একটা দশচাকার গাড়ি যেতে লাগল। ভাঙা রাস্তায় যেতেও পারছে
না জোরে। আর এদিকে আওয়াজে কানে তালা পড়ার জোগাড়। ঠিক তক্ষুনি আবারও মনে হল, ছেলেটা
আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমি নিশ্চিত সেটা আমার মনের ভুল নয়। একটা ভয় কাজ করতে লাগল
আমার মধ্যে। অন্য দিকে ঘুরে দাঁড়ালাম। কিন্তু স্পষ্ট বুঝলাম ছেলেটা আমার দিকে আরও
এগিয়ে আসছে। আরও। আরও। আর ফিরে তাকাবারও সাহস ছিল না আমার। দৌড়ে পালাব কি চীৎকার
করব ভাবছি। এমন সময় ছেলেটা মুখ থেকে একটা অদ্ভুত শব্দ করে আমায় এক ধাক্কা মেরে
ফেলে দিল। বেশ কিছুটা দূরে ছিটকে পড়লাম আমি। ইতিমধ্যে ছেলেটাও মারল এক লাফ। আর ঠিক
সেইসময়েই কি একটা ভেঙে পড়ার তীব্র আওয়াজ। সমস্ত ঘটনাটা কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঘটে
গেল। রাস্তায় পড়ে আমার সারাটা শরীর তখন অবসন্ন। ব্যথায় কুঁকড়ে আসা চোখদুটো তুলে
দেখি, একটা লরি সামনের ঐ দোকানটায় ধাক্কা মেরেছে। বোধহয় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিল
ওটা। আর আমি যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম সে জায়গাটা ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে। চারিদিকে কাঁচের
টুকরো, ইঁটের টুকরো ছড়িয়ে রয়েছে। দৃশ্যটা দেখে আমি শিউরে উঠলাম। দেখি সামনে ঐ
ছেলেটা। আমাকে তোলার জন্য হাত বাড়িয়েছে। পরে বুঝেছি, যে ছেলেটা বোবা। তাই আমাকে
লরিটার ব্যাপারে কিছুই জানাতে পারেনি। মুখে শব্দ করেছিল, কিন্তু ঐ দশচাকার গাড়ির
আওয়াজে আমি কিছুই টের পাইনি। আসলে আমার মনটাও যে তখন অন্যদিকে ছিল। যাই হোক, আমার
হাতে পায়ে বেশ কতক জায়গায় কেটে ছড়ে গিয়েছিল। হাজার বারণ সত্ত্বেও ও নিজেই সেগুলো
ধুয়ে পরিষ্কার করে দিল। তারপর আর কোনদিকে না তাকিয়ে ঐ ভেঙে পড়া লরিটার দিকে ছুটল।
কিন্তু যাবার আগে ও একটা অদ্ভুত হাসি হেসে গেল। হয়ত এভাবেই ও বলে গেল... কি জানি কি বলে গেল?
মঙ্গলবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৩
সোমবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৩
বন্ধু
সেদিন ঋতু আর তরুণের মধ্যে কি একটা কারণে তুমুল ঝগড়া বেধেছিল। বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় রাস্তার লোকগুলো পর্যন্ত চমকে উঠছিল। বাড়ির পোষা মেনি বেড়ালটা ভয়ে বাগানে ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে পড়ল। অবশ্য স্বামী-স্ত্রীর নতুন এই যুগলবন্দীতে এমন ঝামেলা একটু আধটু হয়েই থাকে। তবে এদের ঝামেলাটা বেশ কদিন ধরেই বেড়ে চলেছে। তারই বোধহয় চরম রূপ নিল আজ। রেগেমেগে বাড়িই ছেড়ে বেরিয়ে এল ঋতু। কিন্তু বেরিয়ে তো এল। এবার যাবে কোথায়? শীতের বিকেল। রোদ্দুর পড়ে এসেছে। বেলাশেষের ম্লান আভাটা সারাটা আকাশে ছড়িয়ে পড়ে বিকেলটাকে জিইয়ে রেখেছে। ঠাণ্ডা হাওয়া বয়ে চলেছে মৃদুমন্দ। এবার শীতটা কিন্তু পড়েছে বেশ জাঁকিয়েই। গায়ের হলুদ চাদরটাকে বেশ করে জড়িয়ে নিয়ে ঋতু কিছুক্ষণ এ রাস্তা ও রাস্তা ঘুরলো। জায়গাটা অত্যন্ত অলিগলি ঘেরা। যে এখানে নতুন এসেছে, তার রাস্তা ঠিকমত রাস্তা চিনে নিতে বেশ অসুবিধেই হবে। ঋতুও এখানে নতুন। ওর বিয়ে হয়েছে মাত্র মাস দুয়েক। তবু রাস্তাগুলো ও মোটামুটি চেনে। সেই চেনা রাস্তা-গলির পথে চলতে চলতে সামনে পড়ল একটা খেলার মাঠ। খুব একটা বড় নয়। মাঠের মাঝখানে একটা ফুটবল খেলা চলছে। দুদিকে পেয়ারা গাছের চারটে ডাল পুঁতে তৈরী হয়েছে গোলপোস্ট। আর মাঠের ধারে কয়েকজন মহিলা কিসব গল্পগুজব করছে। হয়ত বা পিএনপিসি চলছে। সে যাক, একটা বটগাছে ঠেস দিয়ে ঋতু দেখতে লাগলো সামনের ঐ ফুটবল ম্যাচ। কিন্তু মনটা তার পড়ে থাকে সেই বাড়িতেই। কি যে হচ্ছে আজকাল। মনটাকে একদম স্থির করতে পারে না সে। মাঝে মাঝেই খুব রাগ ওঠে তরুণের ওপর। কি করবে কিছু ভেবে পায় না ঋতু। এই সময় কারুর সাথে কথা বলতে পারলে ভাল লাগত। কিন্তু কার সাথেই বা বলবে? কে তাকে বুঝবে? আর তাছাড়া, হাজার হলেও সে তো এখানে নতুন। তাই… হঠাৎ পেছন থেকে তার হাতটা ধরে কে এক হ্যাঁচকা টান মারল। চমকে উঠে পেছনে তাকাতেই দেখে একটা ফুটফুটে বাচ্চা মেয়ে। বছর পাঁচ কি ছয়ের হবে। ধবধবে সাদা ফ্রক পড়ে ফোকলা দাঁতে হাসছে। ঋতু তাকে দেখে মৃদু হেসে বলল, কে তুমি? কি নাম তোমার? মেয়েটা বলে, জানিনা। গলাটা বেশ আদো আদো। ঋতু অবাক হয়ে বলে, সে কি! তোমার নামই তুমি জানো না? এ আবার কি? আরো কিছু হয়ত ঋতু ওকে বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু মেয়েটা ওকে বাধা দিয়ে বলে উঠল, তুমি আমার সাথে খেলবে? এহেন প্রশ্নে ঋতু ছেলেমানুষের মত হেসে ওঠে। তারপর বলে, বেশ তো। বল কি খেলবে? মেয়েটা খিলখিলিয়ে হেসে বলে, লুকোচুরি, দেখি তুমি আমায় খুঁজে বের করতে পার কিনা? তারপর একটু থেমে সে আবার বলে, তুমি আমার সাথে খেলবে বলেছ। এই নাও এগুলো তোমায় দিলাম। উপহার। এই বলে সে হাত থেকে একগোছা রজনীগন্ধা ঋতুর দিকে বাড়িয়ে ধরল। ঋতু বেশ অবাক হয়ে ফুলগুলো দেখল। বাঃ, কি সুন্দর! বলে সে একবার প্রাণভরে শুঁকে নিল সেগুলোকে। এ ফুল তুমি কোথায় পেলে? – জিগ্যেস করতে যায় ঋতু। কিন্তু মেয়েটা ততক্ষণে কোথায় লুকিয়ে পড়েছে। ঋতু তাকে খুঁজতে শুরু করে দিল। পাঁচ মিনিট গেল, দশ মিনিট গেল। কোথাও পাওয়া গেল না তাকে। অলি গলি তস্য খোঁজা হয়ে গেল ঋতুর। আবার চারিদিকটা ঘুরে দেখতে গেল সে। এইভাবে প্রায় আধঘণ্টা পার হয়ে গেল। তবুও মেয়েটাকে খুঁজে বের করতে পারে না ঋতু। কোথায় গেল মেয়েটা? – প্রশ্নটা ভাবিয়ে তুলল ঋতুকে। এইভাবে আরো কত সময় কাটল কে জানে? সন্ধ্যে নামতেই বাড়িতে বাড়িতে শাঁখ বেজে উঠল। রাস্তার স্ট্রীট লাইটগুলো উঠল জ্বলে। তবু মেয়েটার কোন খোঁজ নেই। অবশেষে ঋতু ওকে ডাকতে শুরু করল। কিন্তু ওর নাম তো জানে না। তাই এই যে। তুমি কোথায় গেলে? – এই বলেই ডাকতে হল। রাস্তার লোকেরা ঋতুর দিকে একটু অদ্ভুতভাবে তাকাচ্ছিল। ঋতু তাদের জিগ্যেস করতে লাগলো মেয়েটাকে কেউ দেখেছে কিনা। কিন্তু দুর্ভাগ্য, মেয়েটাকে ওরা কেউই দেখেনি। কেউই চিনতেও পারল না ওকে। সবাই এরপর যে যার মত চলে গেল। অগত্যা হিমেল হাওয়ার জোর বাড়ছে দেখে ঋতুও বাড়ির দিকেই হাঁটা লাগাল। মনে রয়ে গেল কিছু প্রশ্ন। কিছু চিন্তা। এভাবে আনমনেই বাড়ি ফিরল সে। বাড়িতে ঢুকতেই তরুণ ব্যঙ্গের সুরে বলতে থাকে, কি হল? খুব তো রেগেমেগে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছিলে। বলেছিলে আর নাকি ফিরবেই না! এখন কি হল? ঋতু এসবের কোন উত্তর করল না। ধীরে ধীরে সে হাতের মুঠো খুলে বের করল রজনীগন্ধাগুলো। তারপর মৃদু হেসে সে ওগুলো বাড়িয়ে দিল তরুণের দিকে। ওর এই অপ্রত্যাশিত ব্যবহারে তরুণ বেশ হকচকিয়ে গেল। কিন্তু তার খুব ভাল লাগল এটা দেখে যে ঋতু তাকে ভালবাসে, তাই সে তার জন্যে অমন সুন্দর ফুল নিয়ে এসেছে।। আর পারল না সে। একবার ‘সরি’ বলে ঋতুকে সে জড়িয়ে ধরল সে নিজের বুকে।
আজকের রূপকথা
সে এক রূপকথার দেশ। দেশের নাম বিলাসপুর। যেমনি তার নাম তেমনি ঐশ্বর্য্য। রাজা, রানী, প্রজারা সবাই সেখানে সুখে, শান্তিতে বাস করে। রাজার এক মেয়ে, নাম তার কুসুমকলি। যেমনি তার রূপ, তেমনি গুণ। সারা দেশে সে যেন তুলনাবিহীন। কুসুমকলির নাম, খ্যাতি তাই ছড়িয়ে পড়তে থাকে দেশ থেকে দেশান্তরে। সেই দেশেরই পাহাড়ের এক অন্ধকার গুহায় বাস করত এক ভয়ানক দুষ্ট দৈত্য। কিঙ্কর তার নাম। তার কাছে থাকত এক যাদু আয়না। সে আয়নার কাছে গিয়ে যা বলতো অমনি আয়নায় তা ফুটে উঠত। এমনি একদিন কিঙ্কর তার আয়নার কাছে গিয়ে বলল, আচ্ছা, বল ত আয়না, এ পৃথিবীতে সবথেকে রূপবতী রমণী কে? সঙ্গে সঙ্গে আয়নায় ফুটে ওঠে কুসুমকলির অপরূপ ছবি। পৈশাচিক হাসি হেসে কিঙ্কর বলে উঠল, যে করে হোক, একে আমি বিয়ে করব। যে কথা সেই কাজ। কিঙ্কর এক সুন্দর ছোট্ট পাখির রূপ ধরে রওনা দিল বিলাসপুরের রাজবাড়ির দিকে। তখন বিকেলবেলা। প্রাসাদের ছাদে কুসুমকলি ঘুরে বেড়াচ্ছিল। এমন সময় তার চোখে পড়ল সুন্দর পাখির বেশে থাকা কিঙ্করকে। কিন্তু সে তো আর জানে না যে ওটা একটা ভয়ানক দৈত্য। সুন্দর পাখি দেখে কুসুমকলি এগিয়ে গেল ওর দিকে। যেই না যাওয়া, অমনি দৈত্য তার নিজের ভয়ঙ্কর রূপ ধরে রাজকন্যাকে নিয়ে গেল তার নিজের গুহায়। সমস্ত ঘটনাটা রাজার কানে যেতেই তিনি ভারী মুষড়ে পড়লেন। রাণী নাওয়া-খাওয়া ভুললেন। প্রজারা সবাই হা-হুতাশ করতে লাগলো। রাজকার্য প্রায় বন্ধ হবার যোগাড় হল। রাজার হুকুমে ঢেঁড়া পিটিয়ে জানানো হল, যে রাজকন্যাকে উদ্ধার করে আনতে পারবে তাকে দশলক্ষ স্বর্ণমুদ্রা দেওয়া হবে। কিন্তু কেউই তাঁর এ ডাকে সাড়া দিল না। এরপর রাজা ঘোষণা করলেন, রাজকন্যার উদ্ধারকারীকে স্বর্ণমুদ্রার সাথে অর্ধেক রাজত্বও দেওয়া হবে। তবুও কেউ আসে না। মন্ত্রী জানালেন, দেশে বীরের বড় অভাব। রাজা আরো ভেঙে পড়লেন। রাজকার্য বন্ধ হল। আর এদিকে একাকিনী, বন্দিনী অবস্থায় রাজকন্যা পড়ে রইল এই আশায় যে কোন একদিন কোন এক রাজপুত্র তাকে উদ্ধার করবে। কিন্তু কেউই এল না তবু। আর আসবেই বা কি করে? সব রাজপুত্রেরাই তো এখন পড়া তৈরী করতে ব্যস্ত। না হলে আন্টি যে তাকে বেধড়ক মারবে। তারপর মায়ের পড়া আছে, ক্লাসের পড়া আছে। নাই বা থাকল তার রাজকন্যার গল্প, নাই বা থাকল তার ছেলেমানুষি কল্পনা। তাকে শুধুই পড়া তৈরী করতে হবে। নইলে কেজি টুয়ে সে ফার্স্ট হবে কি করে?
বিতৃষ্ণিত
রোদ ঝলমলে সকালে তখন দশটা ছুঁইছুঁই। নৈহাটির
লঞ্চঘাটের কাছে স্নানের যে ঘাটটা আছে তার কাছে একটা ধাবার ওপর বসে সুনু আনমনে
তাকিয়ে দূরে ভেসে চলা একটা বোটের দিকে। সামনে কলকল করে গঙ্গা বয়ে চলে, ডুগ-ডুগ করে
লঞ্চ ছাড়ে, ফটাস-ফটাস শব্দে ধোপারা কাপড়গুলো আছাড় মারে, দু-তিনটে বাচ্চা ছেলে জল
একবার ঝাঁপ দেয়, আবার পাড়ে ওঠে, কয়েকজন মহিলা পাশে থুপে থুপে কাপড় কাচতে থাকে আর
তার সাবান ফেনা জমা হয়ে পাড়টা যেন দাঁত বের করে হাসে। বেশ কিছু
লোক গঙ্গাজল নিতে এসেছে। হৈ-হুল্লোড়ে চারিদিক মাতোয়ারা। তবু সুনুর এসবে ভ্রূক্ষেপ
নেই। ও তাকিয়ে সিল্যুয়েট ছবির মত দূরের ঐ বোটটার দিকে। একাকী ভেসে যাচ্ছে ওটা
দূরে, আরও দূরে। মোবাইলটা হঠাৎই বেজে ওঠে টুংটাং। ফোনটা
পকেট থেকে বের করে, হ্যাঁ দীপ, বল। এই ধর, সাড়ে দশটা নাগাদ। আরে ছাড় তো, ফাটাফাটি
না আরও কিছু, রেজাল্ট ভালো হবে না রে। আচ্ছা, ঠিক আছে।
ওকে, বাই। ফোনটা কেটে দিয়ে সুনু ফিরে যায় আবার আগের জগতে।
সুনুর ভালো
নাম সুপর্ণ। সুপর্ণ চ্যাটার্জী। বরাবরই ‘ভাল ছেলে’ বলে পাড়া-বন্ধু-আত্মীয় সার্কেলে
মান পেলেও মাধ্যমিকের নাইন্টি পার্সেন্টের পর সেটা ‘খুব ভালো ছেলে’ হয়ে যায়। আর
শুধু পড়াশুনোই বা কেন! ছবি আঁকারও হাত তার ভালো। এই তো সেদিন আকাদেমী অফ ফাইন
আর্টসে তার ছবি শো হয়েছে। আগেও এমন হয়েছে। সেদিক থেকেই বা কম কিসে? আর সেখানে তার
আশেপাশের সবাই প্রায় মিডিওকার। তাই তাদের কাছে সুনুর ইমেজই আলাদা। কিন্তু সেই
ইমেজে হয়ত এবার একটা বড় আঘাত পড়বে। একটা ক্ষতির আশঙ্কা তার সামনে বার বার ফিরে
ফিরে আসে। আজ ওর এইচ এসের রেজাল্ট। কিন্তু সে খুব ভালো করেই জানে রেজাল্ট তার
কোনোমতেই ভাল হবে না। আর হবেই বা কি করে? গত ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি
– পাক্কা তিনটে মাস যে কেটেছে তার টাইফয়েডে। তারপরেও ছিল দুর্বলতা।
ডাক্তারের ভুল চিকিৎসা, গাফিলতিতে রোগ সারতে অনেক সময় লেগে গেছে। পড়াশুনা প্রায়
কিছুই হয়নি এবার। তাই একবার সে ভেবেছিল ড্রপ দেবে। কিন্তু বাবার কড়া হুকুম, ওসব
ড্রপ-ফপের ব্যাপারে ভাবিস না। কোন চিন্তা না করে পড়াশুনো চালিয়ে যা। রেজাল্ট ঠিক
ভাল হবে। মায়েরও মত, বাবা যা বলছে, তাই শোন। এখন ড্রপ দিলে লোককে কি বলবো বল তো?
অগত্যা তাই হল। পরীক্ষা দেওয়া হল। কিন্তু সুনু বেশ ভালোভাবেই জানে, রেজাল্ট তার
ভাল হবে না। সামনের জগতটা তার পুরো অনিশ্চিত।
বেলা এগারোটা। স্কুলের মস্ত বটগাছের গোড়ায় সুনুর
কাউন্টডাউন চলে। সামনে দীপ, রাহুলদের ‘কি হবে, কেমন হবে’ গুনগুনানি। সুনুর ভাল
লাগে না এসব। সে এখন চায় একটু একাকীত্ব। হিসাব করে নিতে চায়, সেভেন্টি-ফাইভ
পার্সেন্ট তার থাকবে তো? নাঃ, ম্যাথসটা খারাপই হয়েছে। তবে সেভেন্টি পার্সেন্টটা
আশা করাই যায়। ফিজিক্সটা যদি একটু লুস করে খাতা দেখে, সেভেন্টি পার্সেন্টের নিচে
নামার তো কথা নয়। কিন্তু সেটা পেলেও সে বাড়িতে বলবে কি করে? মা, বাবা থেকে শুরু
করে আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশী সবাই তো গিলে খেতে আসবে। অনেকে হাসাহাসি করবে।
অস্থির হয়ে ওঠে মনটা। চোখ পড়ে কিছুটা দূরে রজত-অর্ণব-শুভ্রদের দিকে। ওরা বেশ
হাসি-ঠাট্টা-তামাশায় চনমনে। সুনু অবাক হয়ে যায়। সে যেখানে সেভেন্টি পার্সেন্ট নিয়ে
ভাবছে, ওরা তো পাশ করবে কিনা সন্দেহ। তবে কিভাবে থাকে ওরা অত ফুর্তিতে?
ওদের দেখে একটু যেন কনফিডেন্স পায় সুনু। মনে মনে বলে, সুনু ভাল ছেলে। রেজাল্ট
খারাপ হবে কেন? কিসবে যা তা ভাবছে সে? ইতিমধ্যে ঘণ্টা পড়ে।
ছাত্রদের ভিড়টা ঠেলে ক্লার্ককে অফিস-রুম থেকে বেরোতে দেখা যায়। হাতে বিরাট গেজেট পেপার।
রোল নম্বর আর পার্সেন্টেজ লেখা পেপার সেঁটে দিতেই মাছির মত ভনভন করে সাদা-কালো
ড্রেসে ছেলেরা। সুনুর বুকটা ঢিপঢিপ করে। লিস্ট দেখে কেউ কেউ বেরিয়ে আসছে, ‘ইয়েস’
শব্দে। বত্রিশটা দাঁত বের করে। আর কেউ কেউ বা ঠোঁট উলটে শুধু ‘হল না রে’। সুনুও
ইতিমধ্যে জায়গা করে নিয়েছে ভিড়ের মধ্যে। বুকের ভেতর দমাস দমাস করে বাজছে। নিজের
রোলটা দ্রুত খুঁজতে থাকে সুনু। হঠাৎই থমকে যায় সে। একি! এ কি করে সম্ভব? এটা তো
তারই রোল নাম্বার। তবে...মাত্র ফরটি সিক্স পার্সেন্ট? এত পুওর মার্কস? ঠিক দেখছে ত
সে? আবার মেলায় নিজের রোল নম্বর। হ্যাঁ, ঠিকই আছে। আর কিছু ভাবার ক্ষমতা থাকে না
সুনুর। দ্রুত বেরিয়ে আসে সে ভিড় ছেড়ে। স্কুল কম্পাউণ্ড ছেড়ে আনমনে বেরিয়ে আসে
রাস্তায়। মনে হয় যেন ছুটে চলে যায় অন্য কোথাও। ‘আরে ভাই! অ্যাকসিডেন্ট করবে নাকি?
দেখে চলো’। ক্যাঁচ করে ব্রেক কষে ঝাঁঝিয়ে ওঠে মোটরসাইকেল ওয়ালা। ‘ওঃ, সরি’। বলে
কপালটা ডলতে থাকে সুনু। যন্ত্রণা করছে বড্ড। পেটে একটা চিনচিনে ব্যথা। ‘আরে
সুপর্ণ, রেজাল্ট কেমন হল ভাই?’ – পাশ থেকে কে যেন বলে ওঠে। ‘ভালো না’ – বলে দ্রুত
সরে যায় সুনু। স্কুলের ভেতরে ঢুকে রেজাল্ট তোলার পালা। এরপরেও কত কারুর সাথে দেখা
হল, কতজন তাকে কতকিছু বলল। সেসব কিচ্ছু মনে নেই সুনুর। সে শুধু এইটুকুই জানে যে
সবাই তার রেজাল্ট জানতে চায়। সবার এক প্রশ্ন – কেমন হয়েছে? স্কুলেতে বন্ধুরা,
বাড়িতে পৌছলে মা, বাবা, টেলিফোনে পিসি, মাসি, কাকা, মামা ...আরও শতকোটি
আত্মীয়স্বজন। সবাই তাকে শুধু একটাই প্রশ্ন করে...কেমন হয়েছে? ওর মনে হতে থাকে এটা
যেন কোন প্রশ্ন নয়। এটা বরং একটা পরিহাস। সবাই তাকে নিয়ে ঠাট্টা করছে। ওর রেজাল্ট
জেনেই সবাই একটা চাপা হাসি হাসছে। কেউ তো তাকে বুঝছে না। সবাই এটুকুই বুঝছে সুনুর
দৌড় শেষ। ও পিছিয়ে পড়েছে। মুহূর্তে সারাটা জগতটা তার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়ায়।
সে একা। সুখের দিনে যাদের সে পাশে পেয়েছিল তারা এখন আর কেউ নেই। সে যে হেরে গেছে।
‘কারুর সামনে আর মুখ দেখানো যাবে না, ছিঃ’, মায়ের মন্তব্য। বাবার হাহুতাশ, হায় রে!
কে করবি এরপর? কিস্যু হবে না তোর দ্বারা। সামনের সমস্তটা অন্ধকার হয়ে আসে সুনুর।
সে দিন, সে রাতটা কাটে। সারাক্ষণ সুনু তার নিজের ঘরে একলা। পরদিনও তেমনি। সে দিন
বিকেল যখন ছুঁইছুঁই, ওকে জামা-প্যান্ট পরতে দেখে মা গম্ভীরভাবে বলে, কোথাও যাবি?
সুনু ‘হুঁ, বাইরে একটু ঘুরতে যাব’ – বলে বাড়ি থেকে বেরোয়। দরজাটা বন্ধ হয় সশব্দে।
সুনুর বাবা অজিতেশের অফিসে প্রচুর কাজের চাপ।
তাই বাড়ি ফিরতে এখন বেশ রাত হয়। রাত আটটায় অফিস থেকে বেরোবার পরে মোবাইলটা অন করে।
দশ সেকেন্ডের মধ্যেই বেজে ওঠে – কলিং গার্গী। গার্গী তার স্ত্রী। ফোন তুলতেই
গার্গীর টেনশন একেবারে ফেটে পড়ে। ‘কি হল কি? ফোনটা সুইচ অফ করে রেখেছিলে কেন?’
অজিতেশ বোঝায়, মিটিং চলছিলো। তাই...’ কথা শেষ করতে দেয় না গার্গী। যেন আর্তনাদ করে
বলে, ছেলে এখনও বাড়ি ফেরেনি জানো। অজিতেশ বিহ্বল হয়ে পড়ে।, কি! কি বলছ কি তুমি?
কোথায় গেছে? গার্গী কঁকিয়ে ওঠে, জানি না, সেই চারটের সময় বেরিয়েছে। কোনদিন তো এমন
দেরী করে না। আমায় না জানিয়ে কোথাও যায় না। কি হল আমার ছেলের? হু হু করে কেঁদে ওঠে
গার্গী। অজিতেশ টেন্সড গলায় সান্ত্বনা দিতে চায়, তুমি কিচ্ছু চিন্তা কোরো না। আমি
এখুনিই বাড়ি যাচ্ছি। কথাগুলো কোনরকমে বলে যান্ত্রিকভাবে ফোনটা কেটে দেয় অজিতেশ।
হাঁটতে হাঁটতে দেখে সামনেই চাকদা স্টেশন। ট্রেন ঢুকছে। ট্রেনে উঠে জানালার ধারে
মাথাটাকে এলিয়ে বসে অজিতেশ। চলমান বাইরের দিকে তার দৃষ্টি স্থির, দেহটা স্থবির। মন
প্রায় অচল। তবু ভেবে চলেছে আর কতক্ষণে নৈহাটি আসবে? ট্রেন সঙ্গী সুজনদা ফটাস ফটাস
করে তাসগুলো পিটিয়ে সামনে ছাড়তে ছাড়তে অজিতেশকে বলে, কি অজিতদা? আজ কি হল? খেলবেন
না? এই ধরুন। বলে তাসের একটা বাণ্ডিল এগিয়ে দেয় অজিতেশের দিকে। অজিতেশ মাথাটুকু
নাড়িয়ে শুষ্কমুখে বলে, না ভাই। আজ আর না। সুজনদা অবাক হয়। সে কি শরীর খারাপ?
কিন্তু অজিতেশ তখন সম্পূর্ণ অন্য জগতে। ছেলের মুখটা তার মনে পড়ে বারবার।
অন্যদিনগুলোয় কি প্রাণখোলা থাকে ছেলেটা। কাল একবারে মুষড়ে পড়েছিল। রাগের মাথায় যা
মনে এসেছে তাই ওকে বলেছিল অজিতেশ। আজ সেসব মনে করে চূড়ান্ত আক্ষেপ হয় তার। ইচ্ছে
করে, জোর গলায় ডাকি। ফিরে আয় বাবা। মা-বাবাকে আর কষ্ট দিস না। ফিরে আয়। কিন্তু আর
তাকে ভাবতে দিল না ট্রেনটা। হঠাৎ ব্রেক কষায় একটা প্রচণ্ড জার্কিং হল। আর তক্ষুণি
সবাই, গেল, গেল। সব শেষ। সর্বনাশ’ বলতে বলতে চীৎকার চেঁচামেচিতে করতে লাগলো। কেউ
কেউ লাফ মেরে নামছে। কেউ বা জানালা থেকে উঁকি মারছে। জায়গাটা খুব একটা অন্ধকার নয়।
তার ওপর পূর্ণিমার আলোয় সবই দেখা যায়। ব্যস্ততার মুহূর্তে অজিতেশ উঠে দেখতে গেল কি
ব্যাপার। সামনে যাকে পেল তাকেই জিগ্যেস করল, কি হয়েছে? কি হল ভাই? একজন জানাল,
একটা ছেলে নাকি এই ট্রেনে কাটা পড়েছে। ‘অ্যাঁ, কি বলছ কি?’ চীৎকার করে ওঠে অজিতেশ।
মন বলতে থাকে ছেলে বাড়ি ফেরেনি। আর তার সামনে এই অ্যাকসিডেন্ট। এর মধ্যে কি তবে
কোনো সম্বন্ধ আছে? ---ভাবতে আর পারল না সে। চারিপাশটা যেন গুলিয়ে উঠছে। ধপ করে পড়ে
যায় সে। কিন্তু তার আগেই তাকে ধরে ফেলে বন্ধু সুজনদা।
গঙ্গার সেই ঘাট। লঞ্চ জেটির কাছে বড় গ্যাসের
আলো জ্বলছে। তাতেই চারিপাশ আলোয় ঝলমলে। মাঝ নদীতে একটা লঞ্চ ডুগডুগ আওয়াজে এ পাড়ে
আসছে। একটা উজ্জ্বল আলো তার মাথায়। দোকানপাট অর্ধেক বন্ধ। বাকীগুলোও হব হব করছে।
ঘাটের একেবারে প্রান্তে নদীর ঠাণ্ডা জলে পা ডুবিয়ে সুনু আজকের সারাটা দিনের
ঘটনাগুলো ভেবে চলেছে একের পর এক। নদীর ছলাৎ ছলাৎ কলতানের সাথে যেন ওগুলো বেশ
মানানসই। রেজাল্ট খারাপ হওয়ার ধাক্কা সহ্য করতে পারেনি সে। চারিপাশের চাপে
জীবনটাকে অর্থহীন বলে মনে হয়েছিল তার। অনেক ভেবেছিল সে এই নিয়ে গঙ্গার এই ঘাটেই।
কি হবে তার বেঁচে থেকে। কেউ তো তাকে চায় না। সবাই চায় তার রেজাল্ট। তাই ঠিক করেছিল
ট্রেনের চাকার তলায় সে নিজেকে শেষ করে দেবে। কিন্তু কোথা থেকে কি হয়ে গেল। একটা
ছেলে। তারই মতো বয়স কি একটু বেশি। রিস্ক নিয়ে রেললাইন পার হতে গেল। হয়তো তাড়া ছিল।
সামনে ট্রেন। পিছলে গেল ছেলেটা রেল ট্র্যাকে। আর ওঠারও সময় পায়নি সে। শুধু হাতটাকে
একবার তুলেছিল মাত্র। হয়ত ওটাই ছিল ওর বাঁচার শেষ আর্তি। তারপর সব শেষ। সবটাই মুহূর্তে
ঘটে গেল সুনুর সামনে। ও বিহ্বল হয়ে পড়েছিল এসবে। তারপর...ওঃ! সে কি রক্ত! আর ভাবতে
পারা যায় না। মৃত্যু যে এত ভয়ঙ্কর হতে পারে তার ধারণায় ছিল না। সে তো কিছুক্ষণ
আগেও এই মৃত্যুকেই কাছে ডেকেছিল। না, আর থাকতে পারে নি সে ওখানে। ছুটে চলে এসেছিল
এ ঘাটে। নাঃ, বড় বীভৎস ঐ মৃত্যু – মনে মনে বলে সুনু। ভাবতেই গা গুলিয়ে ওঠে ওর। বমি
বমি ভাব আসে। একটু জিরিয়ে নেয় সে। তারপর এই নদী, লঞ্চ, দোকানপাট, ঐ কুকুরটা, এই
জীবনটা – সবটাকে সে দেখে নেয় প্রাণভরে। যেন কতদিন পরে সে দেখছে এ সব কিছু। একরাশ
ঠাণ্ডা হাওয়া নদী থেকে বয়ে আসে, সুনুকে ভরিয়ে তোলে নতুন প্রাণস্পন্দনে। হঠাৎ
সম্বিত ফেরে তার – বাড়ি ফিরতে হবে তাকে। মনে পড়ে মায়ের কথা, বাবার কথা। তারা কি দুশ্চিন্তাই
না করছে তাকে নিয়ে! বাড়ির দিকে রওনা হতে যায় সে। এমন সময় একটা পরিচিত গলায় ডাক আসে
– ‘সুনু’।
প্রকাশিত - এপার বাংলা ওপার বাংলা (বই)
প্রকাশিত - এপার বাংলা ওপার বাংলা (বই)
-প্রজীতা।
ভুল
কভি আলবিদা না
ক্যাহেনা – মিষ্টি গানটার সুরে বেজে
ওঠে টেবিলে
রাখা মোবাইলটা। পাশেই
পড়ছিলো নিশা। সামনেই
ওর উচ্চমাধ্যমিকের
টেস্ট।
তাই পড়ায়
এখন প্রচুর
চাপ।
এই অসময়ের
ফোনে স্বভাবতই
বিরক্ত হয়
ও।
অন্য কেউ
হলে কি
হত জানি
না।
তবে নিশা
ক্লাসের ফার্স্ট
গার্ল।
তাই পড়ার
ব্যাপারে তার
সিনসিয়রিটি অন্যদের থেকে একেবারেই আলাদা। ফোনটাকে
সাইলেন্ট করে
দেয় ও। কে
করেছে তাও
দেখে না। এখন
ওর পড়ার
সময়...শুধুই
পড়ার।
এবারও যে
ওকে ফার্স্ট
হতেই হবে। উচ্চমাধ্যমিকে
স্ট্যাণ্ড করারও একটা আশা রয়েছে
তার মনে। আসলে
মাত্র দুটো
নম্বরের জন্য
মাধ্যমিকে স্ট্যাণ্ড করতে পারেনি কিনা!
তাই এবারে
আর কোনো
ভুল করতে
রাজী নয়
সে।
উচ্চমাধ্যমিকে সেই আক্ষেপ যেন মিটে
যায়।
সেই চেষ্টাই
সে এখন
একান্ত মনে
করছে।
ফোনটা বাজতে
বাজতে থেমে
যায় একসময়।
কভি আলবিদা না
ক্যাহেনা – কিছুক্ষণ পরেই আবার বেজে
ওঠে ফোনটা। পড়ায়
ডিস্টার্ব হয় আবার। একটু
উষ্ণ মেজাজে
ফোনটা তুলে
নিশা দেখে
স্ক্রিনে নামটা
ঝলকাচ্ছে – সবুজ। ‘ওফ! জ্বালাতন
আর ভালো
লাগে না। এই
এক ছেলে
আছে।
দিনরাত ফোন
আর মেসেজ। মেসেজ
আর ফোন। সারাদিন
শুধু এই
করে যায়। কোনো
কাজ নেই,
কাম নেই। ডিসগাস্টিং। ঝট
করে মেজাজটা
গরম হয়ে
যায় নিশার। আর
হবে নাই
বা কেন?
এমন ইম্পরট্যান্ট
মুহূর্তে ফোন
এলে কার
না বিরক্তি
ধরে! সেদিনের
সেই ছোট্ট
ভুলের খেসারৎ
আজও যে
তাকে দিয়ে
যেতে হচ্ছে। আর
ভাল লাগে
না।
তবু ভুলও
তার পিছু
ছাড়ে না। আসলে
ভুলটা যখন
হয়েছিলো, নিশা
তখন আরেকটু
ছোট, আরেকটু
অপরিণত।
সবে তখন
ইলেভেনে ভর্তি
হয়েছে সে। আশিস
স্যারের ব্যাচে
পড়া ছিল
সেদিন।
বাইরের টুপটাপ
বৃষ্টি দেখে
মন চাইল
না পড়তে
যেতে।
তবুও ‘পড়াটা
কামাই হবে!’
– এই ভেবেই
গেল পড়তে। যেই
না
ঢুকেছে স্যারের বাড়ি, নামলো তুমুল
বৃষ্টি।
সে বৃষ্টির
কোনো কমতি
নেই! একনাগাড়ে
হয়ে চলেছে
তো চলেছেই। থামাথামির
কোনো লক্ষণ
না দেখে
স্যারও সেদিন
বললেন, ‘আজ
আর বেশি
পড়ালাম না। বাইরে
যা চলছে
তাতে আর
কিছুক্ষণ বাদে
বাড়ি ফিরতে
নৌকা লাগবে। সাবধানে
যেও সবাই।‘ স্যার
এই বলে
দোতলায় চলে
গেলেন।
‘সাবধানে যেও’
তো বললেন
স্যার।
এদিকে নিশা
ব্যাগ থেকে
তার ছাতা
বের করতে
গিয়ে দেখে
ছাতার হ্যাণ্ডেলটা
কি করে
ভেঙ্গে গেছে। আসলে
ওটা আগে
থেকেই একটু
নড়বড়ে ছিল। ব্যাগের
মধ্যে চাপেই
বোধহয় একেবারে
ভেঙ্গে গেলো। ওটা
আজকের দিনে
নিয়ে আসাটাই
বোকামি হয়েছে। নিজের
ওপর রাগ
হতে থাকে
নিশার।
এখন স্যারকেও
দোতলা ডাকতে
কেমন বাধো
বাধো লাগে
তার।
আসলে সে
ত এই
স্যারের কাছে
একেবারে নতুন। আজকে
নিয়ে তার
মাত্র দুদিন
হল এই
ব্যাচে।
বেশী ছাত্রছাত্রীও
আসেনি সেদিন
যে কাউকে
বলবে একটু
এগিয়ে দেওয়ার
জন্যে।
যারা এসেছে
তারা কেউই
এদিকে থাকে
না।
আর বলবার মতো
আছে শুধু
সবুজ।
ওর বাড়ি
যদিও অনেক
দূরে, কিন্তু
নিশাদের বাড়ি
ওদের বাড়ির
রাস্তাতেই পড়ে। আর তাছাড়া
সবুজকে অনেকদিন
ধরে চেনেও
নিশা।
দুজনে নাইন,
টেনের অনেক
ব্যাচে একইসাথে
পড়েছে।
নিশা তাই
ওকে ডেকে
বলে, এই
সবুজ।
দেখ না,
আমার ছাতার
হ্যাণ্ডেলটা একবারে ভেঙ্গে গেছে।
তোর ছাতা
আছে তো!
তাহলে আমায়
একটু এগিয়ে
দিতে পারবি
রে? একটু
বোকা বোকা
ভাব নিয়ে
সবুজের দিকে
চেয়ে থাকে
নিশা।
তাই দেখে
একচোট জোর
হেসে নেয়
সবুজ।
বলে,’কেমন
ছাতা রে
তোর? প্লাস্টিকের
নাকি? হাঃ
হাঃ।
ওর হাসি
দেখে নিশা
একটু রাগের
ভঙ্গীতে বলে,
হাসিস না। কোনোরকমে
এখন বাড়ি
পৌছলে হয়। সবুজ
বলে,’আরে,
চিন্তা করছিস
কেন? হাম
হ্যায় না!
এই বলে
ও ওর
দাদুর বিশাল
বড় ছাতাটা
ব্যাগ থেকে
বের করে। তাই
দেখে নিশা
হেসে ফেলে,
‘এ কবেকার
ছাতা? এ
কি তোর
দাদুর ছাতা
নাকি! হি
হি।
সবুজ বলে
ওঠে, হুঁ
হুঁ, বাবা!
এ দাদুর
ছাতা হলে
কি হবে,
এর জোর
একেবারে নাতির
মতো।
যাই হোক,
দুজনে এবার
হাঁটা লাগালো
জলভরা পথে,
ছলাৎ ছলাৎ। সবুজ
নিশাকে আলতো
করে জড়িয়ে
ধরে। আর কিসব যেন
ওকে বলতে
থাকে নিচু
স্বরে।
তাতে নিশা
হেসে ওঠে
মাঝেমাঝেই।
ওদের হাসি
আর কথাগুলো
বৃষ্টির ঝিরিঝিরি
কলতানের সাথে
মিশে তৈরী
করে এক
নতুন আবেশ।
তবু এটাই ভুলের
শুরু।
ভুলেও ভাবতে
পারেনি ওরা,
যে এখানে
কোন ভুল
লুকিয়ে থাকতে
পারে।
তাই ওরা
এগোল যৌবনের
ছন্দে তালে। আর
দুজনের দুই
চোখের ডাকে
আনকোরা এক
সাড়া দিয়ে
ফেলল একসময়। এই
সাড়াই ওদের
সামান্য বন্ধুত্বটাকে
করে তুললো
আরোও নিবিড়। নিজেদের
অজান্তেই তা
আরো রঙিন
হয়ে ফুটে
উঠল ভালোবাসার
প্রথম কুঁড়ি
হিসেবে।
তারপর টুকরোটাকরা
দুষ্টুমিষ্টি ভেজ-নন-ভেজ মেসেজ
আর তাছাড়া
মাঝেমাঝে দুজনের
মধ্যে কথাবার্তা
চলতো পড়ার
ব্যাচে কিংবা
অন্য কোন
অচেনা অজানা
জায়গায়।
যেখানে ওদের
কেউ চেনে
না, কেউ
জানে না। কথা
যেন আর
শেষ হতেই
চাইত না,
বাকী থেকে
যেত রোজই। বাকী
থাকা কথাগুলো
ফোনে চলতো...কিন্তু তবু
তা শেষ
হত না। বেশিরভাগ
দিনই সবুজ
ফোন করত। নিশাও
করত মাঝে
মাঝে।
কিন্তু ব্যস!
ওই পর্যন্তই। তারপরই
পড়ার চাপ
বেড়েছে।
নিশা এসব
ব্যাপারে তাই
আর নিজেকে
জড়াতে চায়নি। মূহুর্তের
ভুল হয়ে
সে দিনগুলো
কেটে গেছে
ক্লাস ইলেভেনের
প্রথম দিকেই। বয়সটা
কম ছিলও
কিনা ওর!
তাই ওরকম
ভুলভ্রান্তি একটু-আধটু হয়েই থাকে। নিশা
হয়ত থেমেছিল
এরপর।
কিন্তু থামেনি
সবুজ।
নিশার কোয়ালিটির
পাশে সবুজ
যদিও পাত্তা
পাওয়ারও যোগ্য
নয়।
তবু নিশাকে
একবার দেখবার,
তার সাথে
কথা বলবার,
তার কথা
শোনবার, হাসি-ঠাট্টা করবার
ষোলো আনা
ইচ্ছেই তার
ছিল।
এদিকে ইলেভেনে
দ্বিতীয়বার ফেল করলে যে তাকে
স্কুল থেকে
বের করে
দিতেও পারে,
সে খেয়াল
হয়ত তার
ছিল না। তাই
সবুজ এগিয়েছিল
তার খুশিমতো। বারবার
ফোন করে
গেছে সে
নিশাকে।
মেসেজের পর
মেসেজ পাঠিয়ে
গেছে তাকে। কিন্তু
নিশার তখন
অন্য জীবন। তার
পড়াশুনোর জীবন। নিজের
কেরিয়ারই তার
কাছে আগে। তাই
সবুজের ফোনে
সে বিরক্ত
হয়েছে।
তবুও অনেকদিনই
এভাবে চলেছে। কিন্তু
আর পারেনি
নিশা।
কয়েকদিন আগে
বাধ্য হয়েই
সে সবুজকে
জানিয়ে দিয়েছে,
‘দেখ সবুজ,
তোর সাথে
সম্পর্ক রাখার
কোন ইচ্ছে
যেমন আমার
নেই, তেমনি
এখন আমার
পড়ার সময়। তাই,
প্লিজ বিরক্ত
করিস না
এখন।
এরপর ফোনটা
সেদিন নিজেই
কেটে দিয়েছিল
সে।
তবু এই
ভুল কি
এত সহজে
মুছে ফেলা
যায়? হয়ত
না।
তাই সবুজ
আবারও ফোন
করেছিলো নিশাকে। নিশা
আর কোন
দ্বিধা না
করে মাকে
সব জানিয়ে
ফোনটা মায়ের
হাতে তুলে
দিয়েছিলো।
একটা উটকো
ছেলে তার
মেয়েকে জ্বালাচ্ছে!
শুনে মায়ের
মেজাজ গরম
হয়ে গেছিল
সেদিন।
কিন্তু হায়রে,
মা বা
মেয়ের কেউই
জানত না
যে সেদিন
সবুজ নিশার
কোন ক্ষতি
চায়নি।
সে শুধু
এটুকু বলতে
চেয়েছিল,’ সরি কাকিমা, আমার ফোনে
যদি ওর
পড়ার ক্ষতি
হয়ে থাকে
তাহলে আর
ফোন করব
না’।
মা সেসব
না শুনে
বলতে শুরু
করলো, ‘তোমার
তো সাহস
কম নয়। কি
ভেবেছ কি
তুমি? ......’বলতে বলতে ভেতরের ঘরে
চলে গেছিল
মা।
মায়ের কথা
আর শোনা
যায়নি।
তবে একটা
ব্যাপার ঠিক। সেদিনের
পর থেকে
সবুজ আর
কোন ফোন
করেনি।
তাই নিশ্চিন্তই
ছিল নিশা। কিন্তু
কোথায় কি!
এ তো
দেখছি আবার
সেই একই
ঝামেলা।
এবার কি
করা যায়?
সাতপাঁচ ভাবতে
ভাবতে ফোনটা
ধরল নিশা,
হ্যালো।
এরপর প্রায় আধঘণ্টা
কেটে গেছে। চায়ের
কাপ হাতে
নিয়ে মা
এসে ঢোকে
নিশার পড়ার
ঘরে।
নিশা তখন
ফিজিক্স বইয়ের
একটা পাতা
ওল্টাচ্ছিল। চায়ের কাপটা টেবিলে
রেখে মা
বলে, তাড়াতাড়ি
খেয়ে নিস
চা টা। রোজই
তো জুড়িয়ে
ঠাণ্ডা জল
হয়ে যায়। মা
ঘর থেকে
বেরোতে যাবে
এমন সময়
নিশা ডাকে,’মা’।
মা ঘুরে
দাঁড়িয়ে বলে,
‘কি হল?’
কোমল গলায়
নিশা বলে,
সবুজকে সেদিন
তুমি কি
বলেছিলে মা?’
মা মুখে
একটু বিরক্তির
ভাব এনে
বলে, ‘কি
আবার বলবো?
একটা ফালতু
ছেলে আমার
মেয়েকে জ্বালাবে
এ তো
হতে দেওয়া
যায় না। তাই
আচ্ছ্বাসে দিয়েছি সেদিন’, মায়ের স্বরটা
কঠিন হয়ে
ওঠে, ‘যাতে
ও কোনদিনও
তোকে আর
জ্বালানোর সাহস না পায়।
......আবার বলে কিনা ‘সরি বলতেই
তো ফোন
করেছিলাম’।
ভেঙিয়ে ওঠে
মা।
নিশা চীৎকার
করে ওঠে,
‘চুপ করো,
কেন তুমি
ওকে ওভাবে
শাসাতে গেলে?
মা স্তম্ভিত
হয়ে যায়
নিশার চীৎকারে। নিশা
এবার মৃদু
কণ্ঠে বলে,
‘জানো, কাল
রাতে ও
রেললাইনে গলা
দিয়ে সুইসাইড
করেছে।
সুইসাইড নোটে
লিখেছে যে
ওর এই
মৃত্যুর জন্য
কেউ দায়ী
নয়।
আর এই
খবরটা শুধু
আমাকে জানাতে
বলে গেছে। কারণ
আমিই নাকি
ওর একমাত্র
বন্ধু ছিলাম। ওর
দাদা এইমাত্র
ফোন করে
জানালো।
কথাটা শুনে
মায়ের ভেতরটায়
একটা শক
খেলে গেল। কান্নাভেজা
গলায় নিশা
বলে, ‘আমি
তো কারুর
ক্ষতি চাইনি। তাই
না মা?’
বুজে আসে
ওর গলা। মা
দেখে নিশার
চোখদুটো জলে
ভরে গেছে
একটা চাপা
কষ্টে।
ওকে জড়িয়ে
ধরে মা
বলে, ‘না,
মা।
আমরা কেউই
তা চাইনি’।
এতে সদস্যতা:
পোস্টগুলি (Atom)