পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ১২ আগস্ট, ২০১৮

মাটি (সিনেমা) - একটি প্রতিভাব


গতকাল একটা ভাল সিনেমা দেখলাম। মাটি। আজকের দিনের পরিপ্রেক্ষিতে এই সিনেমাটাকে একটা ইতিহাসচর্চারই সামিল বলে মনে করা যেতে পারে। যদিও সেই হিসেবে ‘ইতিহাসচর্চা’ কথাটা যতটা ভাবগম্ভীর এবং বস্তুনিষ্ঠ, তার ধারেকাছেও এই সিনেমা যায় না। বরঞ্চ এই ছবি অনেক বেশি আবেগপ্রবণ। আসল কথা, সিনেমার দাবি তার দর্শকের কাছে আর তাই দর্শকের রুচিকে পাত্তা না দিলে চলে না। তবে সেদিক থেকে আর পাঁচটা ঝালমুড়ি সিনেমার থেকে এদের কাজ যথেষ্টই এগিয়ে রয়েছে। ঝালমুড়ির মত দ্রুত মিইয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা এতে দেখিনে।


এবার আসি মূল গল্পটাতে। গল্পটির কেন্দ্রীয় চরিত্র একজন মহিলার – নাম মেঘলা। সে কলকাতা নিবাসী। কিন্তু তার পারিবারিক ইতিহাস পড়ে রয়েছে বাংলাদেশের ঢাকা শহরের একদা একটি বনেদী বাড়িতে। ৪০০ বছরের বেশি প্রাচীন ইতিহাস রয়েছে সেখানে। মেঘলা তার ঠাকুমার ব্যক্তিগত রচনা থেকে সেই ইতিহাস সম্বন্ধে অবগত হয়। সে জানতে পারে, তাদের পরিবারের প্রভূত বৈভব ছিল, তাদের সম্পদ ছিল অগাধ। তাদের বাড়িতে দুর্গাপুজো হত, সেখানে একটি নাটমন্দির ছিল। ’৪৬ সালের দাঙ্গার সময়কার ভয়াবহ চিত্র না থাকলেও তার কিছু আঁচ দর্শক পাবেন মেঘলার ঠাকুমার বর্ণনা থেকে। বাইচ প্রতিযোগিতা নিয়ে হিন্দু-মুসলমান ঝামেলা, ফুটবল প্রতিযোগিতায় মুসলমানের ছেলের দল ভাঙা প্রভৃতি ঘটনা থেকেই এটা বোঝাবার চেষ্টা করা হয়েছে দ্বিজাতি তত্ত্ব সেকালের মানুষের মনকে কিভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। 

মেঘলা যখন তার বন্ধুর বিয়েতে এল ঢাকা শহরে, এয়ারপোর্ট থেকে তাকে বন্ধুর বাড়িতে নিয়ে এসেছিলো এক বিশিষ্ট ভদ্রলোক যার নাম জামিল, লোকের কাছে সে পরিচিত জামিলভাই বলে। মেঘলা যখন দেখলো তাদের সেই সুপ্রাচীন ঐতিহ্যবাহী বাড়িটায় (যার অস্তিত্ব কেবলমাত্র তার ঠাকুমার লেখায় এবং তার নিজের কল্পনার বাইরে অবলুপ্ত) আজ অন্যের অবস্থান, তখন সে বড় আঘাত পেল। সে ভাবতে লাগল তাদের নিজেদের বাড়ি দখল করে আজ অন্য মুসলমান সেখানে ঘাঁটি গেঁড়েছে। সে আরো আঘাত পেল যখন সে জানল তার সম্প্রতি পরিচিত হওয়া জামিলভাই-ই সেই বাড়িতে বসবাস করছে। তাদের পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি ত্যাগ, তার ঠাকুমার সম্ভাব্য হত্যা এবং তাদের ঐ পরিবারের ওপর সমস্ত বঞ্চনা এবং অন্যায়ের কারণস্বরূপ সে ঐ লোকটাকেই ঠাহর করল। সে লোকটাকে মনে মনে অত্যন্ত ঘৃণা করতে লাগল। 

মাটি সিনেমার একটি দৃশ্য

কিন্তু সত্য তা বলে না। ইতিহাস পর্যবেক্ষণ আমরা করি ঠিকই, কিন্তু তাতেও থেকে যেতে পারে বিস্তর গলদ। কারণ ইতিহাস আবেগকে সহ্য করে না। তাই জামিলভাই বলে, ‘আপনার এই দেশটা সম্বন্ধে একটা ইল্যুশন আছে’। সেই ইল্যুশনকে ঝেড়ে ফেলাই হল এই সিনেমার মূল প্রাণ। যখন কোন ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে মেঘলা জামিলকে কটূকথা শোনায়, তখন কিন্তু জামিলভাই রাগ করে না। বরং মেঘলার অন্তঃস্থল থেকে বেরিয়ে আসা রাগটাকে সে যত্ন নিয়ে দেখে এবং পরিমার্জনা করে দেয় তার দৃষ্টিভঙ্গীর ত্রুটিগুলি। 

দর্শকেরা অনেকেই আছেন, যাদের ইতিহাস কিংবা পারিবারিক ইতিহাস মেঘলার ইতিহাসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাদেরও মনে হয়ত মেঘলার মত কোন ইল্যুশন রয়েছে বাংলাদেশ সম্বন্ধে। সেটাকে কাটানোই এই সিনেমাটার মূল প্রতিপাদ্য। আমার ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গীতে অন্তত তাই মনে হয়েছে। ইতিহাসকে আবেগ দিয়ে না দেখে সত্যকে সৎপথে দেখবার সাহস দেখিয়েছেন ছবিটির যুগ্ম পরিচালক শৈবাল বন্দ্যোপাধ্যায় এবং লীনা গঙ্গোপাধ্যায়। এ কারণে তাঁরা দুজনেই ধন্যবাদার্হ। 

আমার ব্যক্তিগতভাবে সর্বশ্রেষ্ঠ লেগেছে আদিল হুসেনের অভিনয় যিনি জামিলভাইয়ের চরিত্রে ছিলেন। তাঁর ব্যক্তিত্ব, চেহারা, কথাবার্তা – সবকিছুতেই তিনি যেন অন্য সব অভিনেতাদের থেকে ছাপিয়ে গেছেন, যেমনটা জামিলভাই ছাপিয়ে গেছেন তার কাজের জন্য। তবে চেহারায় আর চরিত্রের সঙ্গে সবথেকে ভাল মানানসই হয়েছে অপরাজিতা আঢ্যের চরিত্রটি যিনি কুমুদিনী দেবী অর্থাৎ মেঘলার ঠাকুমার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। বনেদী বংশের গৃহিণী হিসেবে ওঁর চেহারাটা এককথায় লা-জবাব। মেঘলার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন পাওলি দাম। তিনিই এই সিনেমার প্রোটাগনিস্ট। সেই দিক থেকে তাঁর চরিত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেই গুরুত্বটা দিয়েই তিনি যথেষ্ট দক্ষতার সাথে অভিনয় করেছেন। মেঘলার বন্ধু জিনিয়ার চরিত্রে মনামী ঘোষ এবং জামিলের মায়ের চরিত্রে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয় যথেষ্ট প্রশংসার দাবী রাখে। বাকী চরিত্রগুলোও খারাপ নয়। 

এই ছবির গানগুলোও মোটামুটিভাবে উপযুক্ত স্থানেই রয়েছে। তবে প্রার্থনা সঙ্গীত হিসেবে ‘ও আমার দেশের মাটি’ গানটায় দেখলাম স্কুলের অনেক মেয়েই গানটা গাইছিল না, তারা খেলা করছিল। এটা একটু হাস্যকর হয়ে গেল। আর অতজন মেয়ে প্রার্থনা সঙ্গীত গাইছে সেখানে স্পষ্টভাবে কি করে জামিলভাইয়ের গলা শোনা গেল এবং মেঘলার কান্না শোনা গেল, সেটাও কিন্তু অজ্ঞাত রয়ে গেল। আমার তো মনে হয় ঐ গানটাকে পুরোটা না দিলেই ভাল হত। আর শেষ বিয়ের গানটাও একটু যেন কৃত্রিম বলেই মনে হল। যেন দর্শকের মনোরঞ্জনের জন্যই নির্মিত। তাছাড়া জামিলের এক কথায় কিভাবে হিন্দুর ছেলে আর মুসলমানের মেয়ের বিয়ের রফা হল সেটাও ঠিকমত বোঝা গেল না। গ্রামের লোকের অসন্তোষ কি শুধু একা জামিলভাইয়ের কথাতেই ঠাণ্ডা হয়ে গেল? প্রতিপত্তিওয়ালা লোকেদের ঝামেলা লাগাতে দেখি, ঝামেলা থামানোটা কিন্তু সত্যিই কঠিন কাজ।

ভুলত্রুটি সব জায়গাতেই থাকবে। তবে একথা বলতে দ্বিধা নেই যে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এই ধরনের একটা ছবি কিন্তু যথেষ্ট মর্যাদার দাবী রাখে।

রবিবার, ২৯ জুলাই, ২০১৮

মাটি ছাড়ার ভয়


বর্তমানে যে ইস্যুটাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে সেটা হল আসামের এন আর সি। ২০০৯ এবং ২০১০ সালে ১৯৫১ সালের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন হবার পর আসাম সরকার মনস্থ করেছে যে তারা বেআইনি বাংলাদেশী নাগরিকদের আসাম থেকে বিতাড়িত করবে। এব্যাপারে আমাদের বলার কিছু নেই। কারণ যে সমস্ত মানুষ অন্য দেশ থেকে বেআইনিভাবে এদেশে এসেছে তাদের এখানে বসবাস করবার অধিকার নেই। এটা মেনে নিয়েও আমি বলতে পারি, এই এন আর সি কিছু মানুষের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকারক। তারা বেআইনি বাংলাদেশী হোন, কিংবা না হোন, তাদের কিন্তু এই নীতির শিকার হতেই হবে। আমি এ ব্যাপারে কিছু উদাহরণ তুলে দিচ্ছি। 

কিন্না খাল হল এমন একটি জায়গা যেটা আসামের বরাক উপত্যকা থেকে মাত্র ৪০ কিমি দূরে এবং ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ৫০০কিমি দূরে। এখানকার বেশিরভাগ মানুষই হল বাঙালি তপশিলী শ্রেণীভুক্ত। এখানেই বাস করেন এক অশিক্ষিত হতদরিদ্র মানুষ যার নাম বাদল দাস। স্থানীয় হাওড়ে তিনি মাছ ধরেন এবং এটাই তার রুটিরুজি। বাদলবাবু এন আর সিতে নাম নথিভুক্ত করবার সময় তার বাবার লিগ্যাসি ডেটা কোড ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু সমস্যা বাধল তার বাবার নাম নোকেশ রাম দাস যেটা ক্লারিকাল ত্রুটির কারণে হয়ে গেছে নোকেশ চন্দ্র দাস। এই কারণে তার নাম নথিভুক্ত করা সম্ভব হয়নি। পুলিশ ব্যাপারটাকে ঠিক করে দেবে কথা দিয়েছিল এবং বাদলবাবুর কাছ থেকে ৫০০০০৳ নিয়েওছিল। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। 

না বন্ধু, কেবলমাত্র এই একটা উদাহরণ দিয়েই আমি ক্ষান্ত হতে পারছি না। কিন্না খাল, এবং তার সংলগ্ন নরপতি কলোনি, সুবোধনগর, চাঁদিনগর এবং সালিমবাদের হাওড়ে বসবাসকারী বেশিরভাগ মানুষই এই একই সমস্যায় ভুগছেন। শুধু কিন্না খালের ৩৫০০ মানুষের নাম এন আর সির প্রথম খসড়াতে আসেনি। তাদের ভয়, আগামীকাল যে শেষ খসড়াটি প্রকাশিত হবে, তাতেও তাদের নাম থাকবে না। কারণ, তারা অত্যন্ত নীচু জমিতে বসবাস করেন যেখানে বছরের ৮-৯ মাস জলমগ্ন থাকে। তারা সরকারী ন্যুনতম পরিষেবাটুকুও পান না। ফলে তাদের ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড, শরণার্থী নিবন্ধন কার্ড নষ্ট হয়ে গেছে কিংবা হারিয়ে গেছে। এন আর সি সেবা কেন্দ্র তাদের প্রত্যেকের জমা করা নথিতে ত্রুটি খুঁজে পেয়েছে। আর বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে অবস্থিত হওয়ায় তাদের প্রতি সন্দেহটাও সকলের বেশি। 

এর ওপর রয়েছে ক্লারিকাল ত্রুটি। এর ফলে লখী মণ্ডল হয়ে গেছে লক্রি মণ্ডল, তার স্বামীর নাম রাসেন্দ্র নমঃশূদ্র হলেও কার্ডে হয়ে গেছে ব্রজেন্দ্র। এছাড়া বামাচরণ দাসের নাম এমন হয়ে গেছে যে তা উচ্চারণ করা যায় না। এরা আপাতত এন আর সি তালিকায় নেই। অর্থাৎ সরকারী ত্রুটির জন্যই এরা এখন বেআইনি বাংলাদেশী। কিন্না খালের মানুষজনকে তাই এখন ৬০০ – ৬৫০ কিমি পাড়ি দিয়ে এন আর সি অফিসে যেতে হয়। গরু-ছাগল এবং গৃহস্থালীর সম্পত্তি বেচে দিয়েও তাদের টাকা জোগাড় করতে হয়। সরকারী গাফিলতি মেটাতে খরচ করতে হয় কাউকে ১০০০০৳ কাউকে ১২০০০৳।
এছাড়া আছে সন্দেহজনক তালিকায় থাকা মানুষ। তিনটিকড়ি গ্রামের ৭২ বছর বয়সী হাজি সফিউল্লা জানাচ্ছেন, তাদের পরিবারের পাঁচজনের নাম এন আর সির প্রথম খসড়ায় থাকা সত্ত্বেও তার মেয়ে মজলুফার নাম কিন্তু সেখানে নেই। সুলেইমান আহমেদের কাহিনী আরও ভয়াবহ। এফ টি৪ (ফরেইনার্স ট্রাইব্যুনাল 8) তাকে ২০১৭ সালের একটি ঘটনায় ভারতীয় বলে দাবি করেছিল। এখন আবার নতুন ভাবে তার গায়ে ‘বিদেশী’ তকমা সেঁটে দেওয়া হচ্ছে। এর কারণ আমাদের জানা নেই। একটি হিসেব থেকে জানা যাচ্ছে, ১৯৯টি গ্রামে মোট ১৪৪০ জন সন্দেহজনক ভোটার রয়েছে। অথচ দেখা যাচ্ছে, বেশিরভাগই সন্দেহজনক ভোটারই পরে ভারতীয় বলে শনাক্ত হচ্ছে। সরকারী পদ্ধতির অপদার্থতা এভাবে কিছু মানুষের ভবিষ্যতকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে। 

সর্ব ভারতীয় সম্মিলিত গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট, যে দল এই সকল প্রতারিত মানুষদের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছেন, তাদের এক কর্মী আমিনুল ইসলাম জানাচ্ছেন, হিন্দু হোক কিংবা মুসলমান, এই এন আর সির মাধ্যমে কিন্তু বাংলাভাষী মানুষদেরই টার্গেট করা হচ্ছে। ২০০৫ সালে দেশের সর্বোচ্চ আদালত যখন বেআইনি অনুপ্রবেশকারী (ট্রাইবুনালের মাধ্যমে স্থিরীকৃত), ১৯৮৩ সালের আইনটিকে বাতিল করে দিল, বাঙালিদের প্রতি এই শোষণ কিন্তু তখন থেকেই নেমে এল।
কাল ৩০শে জুলাই। অর্থাৎ এন আর সির অন্তিম খসড়া প্রকাশের তারিখ। আশা করব, আগের খসড়ায় যাঁরা প্রতারিত হয়েছেন, তাদের নাম এই খসড়ায় থাকবে এবং এইসকল হতদরিদ্র মানুষগুলোর পরিশ্রম, জীবনের সমস্ত সঞ্চয় নিঃশেষ করে দেওয়া সার্থক হবে। নিজেদের ভিটেমাটির ওপর তাদের নিজেদের অধিকার থাকবে। কিন্তু যদি তা না হয়? সেই সম্ভাবনাও কিন্তু অত্যন্ত প্রবল। কারণ আসামের জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলো এখন বাঙালিদের টার্গেট করা শুরু করেছে। বাঙালিরা ভারতীয় হোক, বা না হোক, তারা বাংলাভাষী মানুষকে এখন দেশ থেকে তাড়াতে চায়। শোনা যাচ্ছে, বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে চুক্তি করে একটা বড়সড় রকমের প্রত্যর্পণ করা হবে। দেশান্তর করা হবে বেশ কিছু মানুষকে। তাহলে কি শুধুমাত্র বাঙালি বলেই বাদল দাস, রসেন্দ্র নমঃশূদ্র, লখী মণ্ডলেরা দেশত্যাগ করতে বাধ্য হবে? প্রশ্নটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। উত্তর মিলবে কি?