সারারাত ঘুম হয়নি
টেনশনে। সকালে উঠেও ও খেল না কিছু। মা ব্রেকফাস্ট তৈরি করছে রান্নাঘরে – রুটি
বেলছে লোহার চাটুতে। এ ঘর থেকে ও ঘর – পায়চারি করতে করতে ছোট্ট তক্তাটার ওপর উঠে
বসল বিজিত। থুতনিতে হাতের চেটোটা দুবার ঘষে। তারপর পাশে রাখা একটা ব্যাগের ভেতর
থেকে একটা মোটা বই বের করে। ওপরের মলাটে লেখা – সাকসেস ইন কম্পিটিটিভ এক্সামিনেশন। বইটা হাতে নিয়েই একের পর এক পাতা উলটে
যায় বিজিত। আর মনে মনে বিড়বিড় করতে করতে
মাথা নাড়ায়।
পাশেই রান্নাঘর। মা
সেখান থেকে উঁকি মেরে বলে, ‘কি রে, স্নানটা তো সেরে আয়। তারপর ওসব মুখস্থ করবি। ক’টা
বাজে সে খেয়াল আছে? বাস ধরতে হবে না?’
-‘ধুর বাপু, চুপ করো
তো।‘ গলার জোরে মাকে তড়পে দিলেও বিজিত ভালমতই বোঝে পড়া তার কিছুই এগোচ্ছে না। বইটাকে
খানিকবাদে তাই ফের ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলে ব্যাগের চেন আটকে দেয় সে। তারপর স্নান সেরে
নেয় চটপট।
মা এদিকে গজগজ করেই
চলেছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে যাচ্ছে, ‘কোন কাণ্ডজ্ঞান আছে ছেলের? এখনই বাস ধরতে
দৌড়তে হবে। ঠিকমত খাওয়ারও সময় নেই। পরীক্ষার আগে যে কি এত পড়ার থাকে বুঝি না বাপু।
কিসের যে এত টেনশন, কে জানে?’ মা এসব রাগের মাথায় বললেও সে কিন্তু নিজেও জানে তার
ছেলের এত টেনশন কিসে। আরে বাবা, তার যে একমাত্র শখ সে সরকারী চাকরি করবে।
ন’টা-পাঁচটা ডিউটি আর বাড়িতে এসে ফুর্তি – এই না হলে জীবন? কিন্তু সে কি আর তার
ভাগ্যে আছে? বাবা চলে গেল ক্লাস টুয়েলভেই – অনাথ করে দিল তাদের। আসলে বাবার
মৃত্যুটা ছিল আকস্মিক। হঠাৎ অফিস করে বাড়িতে এসে বলে, ‘বুকে ব্যথা।‘ বুকে তেল
মালিশ করা হল। সেবা-শুশ্রূষা করা হল – কোন কাজই হল না। ব্যথা বেড়েই চলল বাবার।
তারপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল হসপিটাল। পথিমধ্যেই বাবা মারা গেল। ডাক্তারের
চিকিৎসা পাওয়ারও সুযোগ পেল না বাবা। পরে জানা গেছিল হার্টে ব্লকেজ ছিল, গাড়ি করে নিয়ে আসার সময় হার্ট অ্যাটাক করে।
কিন্তু এরপর? চলবে
কি করে তাদের? কিছুদিন না হয় চালান গেল জ্যাঠা আর মামাদের দয়ায়। কিন্তু তারপর তো
তাদের একটা স্থায়ী আয় চাই। বিজিত ঠিক করল সে টিউশানি করবে। আর তার মা ঢুকবে একটা
দোকানে। কিন্তু সেখানে বাদ সাধল জ্যাঠা। সে একদিন এসে মাকে ধমকে উঠল, ‘কি দরকার
তোমার দোকানে ঢোকার? হাজার হোক ভাই তো একটা চাকরি করত। মোটামুটি স্বচ্ছল একটা
জীবনও ছিল তোমাদের। কেন ওসব দোকানে-ফোকানে ঢুকবে? বিজে পড়াতে চায় পড়াক। কিন্তু
আমরা যতদিন আছি তুমি ওসব আয়ফায়ের কথা ভেব না।‘ জেঠিও ঠিক একইভাবে বাধা দিয়েছিল
মাকে।
মা তাই আর আয়ের পথ
খোঁজেনি। আসলে বাবা মারা যাওয়ার পর জেঠুই যেন এখন তাদের অভিভাবক। ফ্যামিলিটা
জয়েন্ট না হলেও পাশের বাড়িটাই জেঠুর। দুই বাড়ির মধ্যে এখনও যথেষ্ট হৃদ্যতা আছে।
এদিকে বিল্টু পড়াত, আর জেঠু যা দিত তাতে তাদের চলেই যেত।
গ্র্যাজুয়েশন পাশ
করেই বিল্টু চাকরির চেষ্টা করে। বেশ
কয়েকদিনের চেষ্টায় প্রাইভেটে সে পেল – ডোমেস্টিক বিপিওর চাকরি। সাধারণ ভাষায় –
সেলসম্যান। মানে আর কি বাড়ি বাড়ি গিয়ে ফিরি কর। দুটো বেচতে পারলে কমিশন পাবে।
প্রথমে তো মাইনে বলতে ছিল শুধুই কমিশন। এখন অবশ্য কিছুটা ফিক্সড হয়েছে। তাও কুড়িয়ে
বাড়িয়ে মাসান্তে পাঁচ হাজারও ঢোকে কিনা সন্দেহ। আর তার বিনিময়ে দিনরাত এক করা
খাটনি। সকাল সাতটায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে সারাদিনের কাজের শেষে ফেরে রাত্তির ন’টা –
ক্লান্ত, অবসন্ন। খেয়েদেয়ে ঘুমটুকু ছাড়া আর কিছু করা তখন তার পক্ষে সম্ভব নয়।
তাই স্বভাবতই সরকারি
চাকরির পড়াশুনাটা তার ঠিকমত এগোয় না। তবুও যতটা পারা যায় রাত জেগে সে পড়াশুনার কাজ
চালিয়ে যেত। কিন্তু সে খুব ভাল করেই জানত যে এই পড়াটা তার যথেষ্ট নয়। অনেক বেকার
ছেলেমেয়েই তার থেকে অনেক ভাল পড়াশুনা করছে। আর সে ক্রমশই তাদের থেকে পিছিয়ে পড়ছে।
আর ফলটাও হল ঠিক তাই – কোন চাকরির পরীক্ষাতেই সে কোয়ালিফাই করতে পারল না। জেনারেল
বলে সে রইল আরোই পিছিয়ে। কিন্তু একটা বাপার ঠিক – সে এখনও আশা ছাড়েনি। পরীক্ষা
দিয়ে যায় সে নিয়মিত। সাফল্য না এলেও...
সেদিন সে রুটি খেল
মাত্র একটা। তাও খেলও নাক সিঁটকে। পরীক্ষার আগের মূহুর্তে খাবার মুখে দিলেই কেমন
যেন বমি বমি ভাব আসে।
মা আগে থেকেই জামা
বের করে দিয়েছিল ওর জন্য। কেন জানি না, মা বলে ঐ জামাটা খুব পয়া। হাল্কা নীল রঙের
হাফাতা জামা। কোত্থেকে মা ওটা পেয়েছিল কে জানে? এ জামা পড়ে কোন শুভ কাজ করলে ফল
ঠিক পাওয়া যাবেই – মায়ের এ দৃঢ় বিশ্বাস। বেরোবার আগে মা তার কপালে চন্দনের ফোঁটা
পড়িয়ে দিল। তারপর শিব, নারায়ণ, কালী – যার ফোটো চোখের সামনে পেল তাকেই ঢিপঢিপ করে
প্রণাম ঠুকতে লাগল বিজিত। আর তখনই ঘড়িতে পড়ল দশটার ঘণ্টা। ‘মা আসছি’ – দ্বিরুক্তি
না করে বেরিয়ে যায় বিজিত। দশটা দশে তার বাস। মা দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর দুটো
হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বলে – দুজ্ঞা, দুজ্ঞা।
দশটা দশের বাস নামেই। ঢুকতে ঢুকতে প্রতিদিনই বাজায় সাড়ে দশ। তবে
বাসস্ট্যাণ্ডটা বেশ ভাল। সিমেন্টে বাঁধানো শানের মেঝে আর একটা বসবার সিটও আছে তাতে,
যদিও সেখানে তিনজনের বেশি ধরে না। কিন্তু দেখুন, এখন সেখানে বসেছে পাঁচজন। আর হবে
নাই বা কেন? এই ছোট্ট একচিলতে চার বাই পাঁচের ছাউনির মধ্যে যদি তিনশো লোককে দাঁড়াতে
হয় তাহলে কি ধরে? অনেককেই বাইরে দাঁড়িয়ে – এপ্রিলের এই রোদের তেজ সহ্য করতে হচ্ছে।
কাছাকাছি কোথাও গাছপালাও নেই যে একটু ছায়ায় দাঁড়াবে। বিজিত যখন সেখানে এল তখন বাস
আসার সময় হয়ে গিয়েছে, বাসের পাত্তা নেই। সে খুব ভাল করেই বোঝে এই ভিড়ের মধ্যে সে
প্রথম বাসে উঠতে পারবে না। তাকে পরের বাসই ধরতে হবে। ছাউনিটার ভেতর মানুষ ভ’রে
একেবারে নিরেট হয়ে গেছে – অগত্যা তাকে বাইরেই রোদের মধ্যে দাঁড়াতে হল।
এটা বিজিতের কাছে তেমন একটা নতুন নয় কারণ সে এইরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন
আগেও হয়েছে। কিন্তু আপনারা এতে অবাক হতে পারেন। আজ রবিবার, ছুটির দিন, কোন বিয়ে থাওয়া কিংবা বাঙালির তেরো পার্বণের একটাও নেই। অথচ
এত ভিড় কিসের? তাহলে ধন্যবাদ দিন পরীক্ষাকে। জানেন না তো, সরকারি চাকরি কাকে বলে?
সদ্য পাশ করা উচ্চমাধ্যমিক থেকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট দাদা-দিদিরা পর্যন্ত সব্বাই এই
যুদ্ধে সামিল। পঞ্চান্ন লাখ পরীক্ষা দিচ্ছে শুধু এই পশ্চিমবাংলাতেই। চাকরি পাওয়ার
জন্য এত ভিড় কোথাও দেখেছে নাকি কেউ? তাও কোথায়? না সাধারণ প্রাইমারি স্কুলে!
যাই হোক, একটা বাস আসার আওয়াজ পাওয়া গেল। বিজিত সামনেটা থেকে সরে দাঁড়ায়।
রাস্তার কাছে সমস্ত ভিড়টা গিয়ে জমল। বাসটা ভর্তিই ছিল। তবুও সবাই পড়ি কি মরি করে
ঝাঁপ দিল বাসটার ওপর। কেউ জোর করে ঠেলেঠুলে ঢুকে গেল, বাকীরা দাঁড়িয়েই রইল বাইরে।
পরেরটার আসার অপেক্ষা।
বাসটা চলে যেতেই সামনেটা খানিক ফাঁকা হয়। বিজিত সেখানটা আগে দখল করে। যাতে
বাসটা এলেই ভিড়ের মধ্যে কোনরকমে নিজেকে বাসের ভেতরে সেঁধিয়ে দিতে পারে। যা হয় হোক,
এই বাসটা মিস করলে চলবে না। ইতিমধ্যে বিজিত দেখে সে প্রায় শ’খানেক লোকের মধ্যে
দাঁড়িয়ে রয়েছে। সবার গায়ে গায়ে ঠেলাঠেলি। রাস্তার ওপরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে সবাই। গরমটা
আরও বেশি লাগছে যেন। দরদর করে ঘামছে সে।
‘একটু সরুন না, আপনার ওদিকে অনেকটা জায়গা আছে’। তার পাশে
দাঁড়িয়ে লম্বা চওড়া চেহারার একটা বাইসেপওয়ালা ধমকে ওঠে যেন। ‘কোথায় দেখছেন জায়গা?
আমার পাশে দেখুন, সরবার মত জায়গাই নেই।‘ প্রমাণ দেওয়ার চেষ্টা করে বিজিত। তার
ওদিকে যদিও সামান্য জায়গা আছে, কিন্তু সে তবু সরতে পারছে না পুরোপুরি। আসলে তার
ওদিকে একটা বেঁটেখাটো মেয়ে দাঁড়িয়ে – কি করে সে একটা মেয়ের গায়ে একেবারে ঠেস দিয়ে
দাঁড়ায়?
এমন সময় শোনা গেল – পঁক-পঁক আওয়াজ। বাস আসছে। নীল-সাদা বাসটার মাথায় প্রায়
জনা দশ বারো লোক বসে। ভিড় উপচে গেট
থেকে বেরিয়ে এসেছে। দুজন লোক নেমে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে বাকিরা দৌড়তে শুরু করে
ঢোকবার জন্য। বিজিতের পিছনের
অনেক লোকও ঢুকে যাচ্ছে ভিতরে। এই দেখে বিজিত একেবারে ঝাঁপ দেয় বাসের গেটের ওপর। বাসের শেষ
পাদানির একটা কোণ বাকি ছিল। সে সেটাকেই দখল করে। বাস ছাড়বে ছাড়বে করছে। অনেকেই
উঠতে পারেনি।
বাস ছাড়তেই কণ্ডাক্টর তার পেছনে চেপে দাঁড়িয়ে পড়ল। বিজিত পুরোপুরিই বাইরে
ঝুলছে। বাঁ হাতে সে কোনরকমে ধরে রয়েছে একটা হ্যাণ্ডেল। বাস চলছে বেশ স্পিডে।
এইভাবে বাসে চড়া তার এই প্রথম। তাই প্রথমটায় সে একটু ভয় ভয় পাচ্ছিল। তার সামনে
দাঁড়িয়ে সেই মেয়েটা, যে তার পাশে ছিল। তারও অবস্থা সঙ্গীন। একটা ধাপ ওপরে সে
জড়োসড়ো হয়ে বেঁকেচুরে দাঁড়িয়ে। আর তার ফলে বিজিতের কনুইটা বার বার তার মাথায়
লাগছিল। বিজিতের এতে খারাপ লাগে, তাই সে হাতটাকে ঠিক করতে যাবে এই সময়ই হঠাৎ বাসটা
জোরে ব্রেক কষল। হুমড়ি খেয়ে পড়ল সকলে এ ওর ঘাড়ে।
আর বিজিত ছিটকে পড়ল রাস্তায়। তার ডান পাটার ওপর দিয়ে বাসের একটা চাকা চলে
গেল। যন্ত্রণায় চিৎকার করে ওঠে সে। তারপর সে টের পায়, তার যন্ত্রণাটা যেন মাথায়
উঠে আসছে। ধীরে ধীরে কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে গেল চারিদিক। তার সমস্ত চেতনা যেন অবশ
হয়ে যেতে লাগল। তারপর আর তার কিছুই মনে নেই।
চোখ যখন খুলল, দেখে মা তার দিকে উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে রয়েছে। পাশে দুটো ছেলে
দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে কিসব বলাবলি করছে। বিজিত চেনে ওদের – পাড়ারই ছেলে ওরা।
ফিনাইলের একটা তীব্র গন্ধ তার নাকে এসে লাগে। নজরে আসে তার সামনে স্ট্যান্ডে ঝুলছে
স্যালাইন ওয়াটার বটল। আর তারপরেই তার চোখে পড়ে তার ডান পা’টা। পায়ে কোন সাড় নেই।
মোটা ব্যন্ডেজ বাঁধা, ঝোলানো অবস্থায় রয়েছে। মূহুর্তে যেন সমস্তটা বুঝে নেয় বিজিত,
চমকে ওঠে সে। তার বুকে হাত
দিয়ে এক নীল পেড়ে সাদা শাড়ি নার্স বলে, ‘উঠবেন না, এখন চুপচাপ শুয়ে থাকুন।‘
মায়ের কান্নার শব্দ পেয়ে মায়ের দিকে তাকায় বিজিত। আঁচলে চোখের জল মুছে মা
তাকে বলে, ‘চিন্তা করিস না বাবা, সব ঠিক হয়ে যাবে। তাড়াতাড়িই সুস্থ হয়ে যাবি তুই।
নার্স এবার সবাইকে বলে দেয়, ‘পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে। আর কোনো চিন্তা নেই। এবার
আপনারা আসুন।‘ সবাই চলে গেল একে একে।
বিজিতের খুব একা একা লাগতে শুরু করে। যদিও ঘরে অনেকগুলো বেড আছে, তার বেশ কয়েকটা ভর্তি। নার্স, ডাক্তারেরা আসা যাওয়া
করছে অহরহ। কিন্তু তবু, বিজিতের কাছে তাদের এই উপস্থিতিটা যেন কিছুই না।
তার যে শুধু চিন্তা হয়। তার পা কি আদৌ সারবে? সারলে সেটা কবে? কতদিন আর
তাকে এভাবে থাকতে হবে? এইভাবে থেকে গেলে তাকে চাকরি থেকে ছাঁটাই করে দেবে না তো?
মনে এমনতরো হাজারো প্রশ্ন ঘোরাফেরা করে নিরন্তর। এভাবেই সময় পেরিয়ে যায় ঘন্টার পর
ঘন্টা।
পরের দিন সকালে জেঠু হাজির। মাথাজোড়া অবাক-পৃথিবী মার্কা টাক, মাথার দুই
পাশে, আর পেছনে কিছু চুল অবশিষ্ট। সরু গোঁফ, সবটাই পেকে গেছে। জেঠুকে দেখলেই বিজিত
সিগারেটের গন্ধ পায়। আসলে তার ছোটবেলায় জেঠু খুব সিগারেট খেত। তারপর দশ বছর হল
সেসব পাপ চুকেছে। তবু তার কাছে কাছেই যেন গন্ধটা এখনও ঘোরাফেরা করে। হতে পারে, জেঠু
সিগারেট ছাড়লেও গন্ধটা তাকে ছাড়েনি।
জেঠু তার কাছে আসতে আসতেই বলে, ‘কি রে ক্ষ্যাপা, শেষমেশ পা’টাই ভেঙে বসলি?’
বিজিত কোন উত্তর দেয় না। রাত্তির থেকে চিন্তা করে করে তার ঘুম হয়নি ভাল। তাই এখন
খুব ক্লান্ত সে। জেঠু একটা চেয়ার টেনে তার সামনে বসে বলে, ‘তারপর দেখি তোর হাতটা’
বলে সে তার নাড়ী পরীক্ষা করতে শুরু করল। দেখা হলে বলে, ‘এই তো দিব্যি আছিস। তা অত
ভাববার কি আছে? অমন গোমড়া কেন? সব ঠিক হো যায়গা।‘ বিজিতের মুখে তবুও কোন উত্তর
নেই। জেঠু প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করে একনাগাড়ে বলে যায়, ‘আর অমন দু-একবার পা
ভাঙতেই পারে। খেলতে গিয়ে আমাদেরও অমন কম হয়েছে নাকি? পা ভাঙত, সারত, আবার খেলতাম।
আর তোরা তো এসব জম্মে বুঝলি না।‘ একটানা বলে থামে জেঠু। মা পাশ থেকে বলে, ‘কাল
থেকে কিছুই খেতে চাইছে না। কি জ্বালাতন বলুন তো দাদা।‘
জেঠু হাঃ হাঃ করে হেসে বলে, ‘সে কি রে পাগলা। তুই কি পায়ের জন্য খেতেও ভুলে
গেলি নাকি? অ্যাঁ!’ তারপর হাসি থামিয়ে বলে, ‘কিন্তু কি জানিস তো, তোর কষ্টটা না
পায়ে নয়। মনে। ওটাকে আগে ঠিক কর। নয়ত সব গেল। আর একটা কাজ কর। এখন এখানে হাল্কা
গল্পের বইটই পড়। পারলে চটিও পড়তে পারিস। গানফান শোন। আর একদম এসব ভাবিস না বুঝলি?’
শেষের কথাটায় একটা আদেশের সুর টের পেল বিজিত।
বিজিত এতক্ষণ কোন কথা বলেনি। সারারাত সে তার পায়ের কথা, নিজের ভবিষ্যতের
কথাই ভেবে এসেছে। আর যত সে এসব ভেবেছে – কোন তল খুঁজে পায়নি। আর সেখানে জেঠুর এই
কথাগুলো তাকে যেন ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে তোলে। তার চিন্তার ভারটা হঠাৎ যেন অনেকখানি
কমে আসে। অনেকটা ভাল লাগে তার এখন। জেঠুর কথায় সে মৃদু হেসে মাথা নাড়ায়, মুখে বলে,
‘ঠিক আছে, তুমি বই এনে দিও।‘ হাসপাতালে
ঢোকার পর থেকে এটাই ছিল তার প্রথম কথা, আর প্রথম হাসি।
এরপর আত্মীয়স্বজনদের সকলেই এসেছে, বন্ধুরাও অনেকে এসেছ তাকে দেখতে। জেঠি
বাড়িতে রান্না করে পাঠায়, মা বেশিরভাগ সময়ই হাসপাতালে – তাই ঘরের সমস্ত কাজ আর
আগের মতন করতে পারে না সে। আর এদিকে নিয়মিত আসে জেঠু। প্রত্যেকদিন সকালে সে আসবেই। আর একটানা কথা বলে যাবে। কোন বিরাম নেই। যেন সে ক্লান্তই হয় না। এই ষাট বছর
বয়সেও তার তেজ এখনও ষোল বছরের যুবকের মত।
এমনি করে কেটে গেল প্রায় একটা মাস। বিজিত এখন চলাফেরা করতে পারে।
হাসপাতালের সামনে একটা বাগান রয়েছে – প্রায় প্রতি বিকেলেই সে সেখান থেকে ঘুরে আসে।
মা থাকে সঙ্গে। কিন্তু যেখানেই যাক না কেন, ক্র্যাচ তার সর্বক্ষণের সঙ্গী। উঠতে
গেলেই চাই ক্র্যাচ, বাথরুমে যাওয়া, ঘুরে আসা – সবসময়ই তাকে ক্র্যাচে ভর করে চলতে
হয়। তার ডান পা’টা একেবারেই অকেজো হয়ে গেছে। তাতে আর জোর পায় না সে কোনমতেই। এসব
মনে এলেই নিজেকে খুব দুর্বল লাগে তার। একি হল? তার সুস্থ সবল শরীরটা কিভাবে এমন
পঙ্গু হয়ে গেল? নার্স, ডাক্তার সবাই বলে, ‘কি আর করব বলুন, সবকিছু তো আর আমাদের
হাতে নেই।‘
বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস নেমে আসে বিজিতের। তার মানে, তার পা আর কোনদিন
ঠিক হবে না। তার বয়স কম, এখনও অনেক জীবন যে বাকি। কি করবে সে এই পঙ্গু শরীর নিয়ে? বড্ড
অসহায় লাগে তার। কিন্তু কারুর কথাও এখন ভাল লাগেনা শুনতে।
পরের দিন সকালে জেঠু এসে দেখে বিজিত কি একটা বই পড়ছে, আর মাঝে মাঝে মুচকি
হেসে উঠছে। জেঠু এসেছে যে সে খেয়ালই করেনি। বইয়ের পাতায় সে তখন মগ্ন। পাশে ওর মা
চুপ করে বসে আছে একটা চেয়ারে। জেঠুকে দেখতেই মা উঠে বসতে দেয়। জেঠু তাতে পাত্তা না
দিয়েই বিজিতের মাথায় হাল্কা একটা চাঁটি মেরে বলে, ‘ঐ ক্ষ্যাপা, এ নে। কি এনেছি
দেখ।‘ বলতে বলতে সে একটা কাগজ বের করে। কাগজে মোড়া একটা ফর্ম।
‘সরকারি চাকরি সরকারি চাকরি বলে খুব তো লাফাতিস। এই যে তোর এস এস সির ফর্ম
বেরিয়েছে। এবার তাড়াতাড়ি ফিলাপ কর তো দেখি।‘
মা বলে, ‘বাঃ। খুব উপকার করলেন দাদা। আপনার মত একজন লোক সত্যি খুব দরকার।‘
বিজিত অবাক হয়ে বলে, ‘আরে তুমি? তুমি কি করে জানলে আমার চাকরির ফর্ম কবে
বেরোবে?’ সে আরো আশ্চর্য হয় এই ভেবে সে নিজেই জানে না কবে পরীক্ষার নোটিশ
বেরিয়েছে, আর সেখানে জেঠু সব খোঁজখবর রেখে তার জন্য ফর্ম নিয়ে এল? কিভাবে জেঠুকে
সে ধন্যবাদ দেবে সেটাই বুঝে উঠতে পারছিল না সে।
সারাদিনটা বিজিতের কাটে একটা আশা নিয়ে। এতদিনে সে যেন সামনে একটা রাস্তা
খুঁজে পেয়েছে। এস এস সির পরীক্ষা সে দেবে বলে আগেই ঠিক করেছিল, কিন্তু জেঠু হাত
বাড়ানোয় কাজটা আরো কত সহজ হয়ে গেল। ভাবতেই মনটা খুশি হয়ে উঠছে তার।
সন্ধ্যেবেলার দিকে হঠাৎ হাম তেরে বিন সুরে বেজে ওঠে তার ফোন। মোবাইলের
স্ক্রিনে নামটা পড়তেই তার ভুরুটা কুঁচকে যায়। সেটা মায়ের নজর এড়ায় না, ‘কি রে কার
ফোন?’ বিজিত তাতে উত্তর না দিয়ে ফোনটা রিসিভ করে, ‘হ্যালো, হ্যাঁ, বলুন
স্যার...ও...ও...ওকে...ওকে সিওর স্যার। ঠিক আছে তাই হবে।‘ মিনিট পাঁচেকের মধ্যে
মোবাইলটা কান থেকে নামিয়ে রাখে সে। মা আবার বলে, ‘কার ফোন রে?’
বিজিত একটা হতাশাভরা গলায় বলে, ‘অফিস থেকে। বলেছে পা ঠিক হয়ে গেলে
রেজিগনেশন লেটারটা জমা দিয়ে যেতে। ওরা আমাকে বরখাস্তই করে দিল মা।‘ মা দেখে
বিজিতের মুখে একটা অন্ধকার নেমে এসেছে। গল্পের বইটা পাশে সরিয়ে সে মাথায় হাত দিয়ে
বসে থাকে চুপচাপ। শুনতে পায় মা কাঁদছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে।
-
এখন আমি কি করব মা? বিজিতের প্রশ্ন।
-
জেঠু এলে বলিস বাবা। আমার মাথা আর কাজ করছে না। মায়ের গলাটা যেন বুজে আসে।
পরের দিন জেঠু এলে বিজিত
তার খারাপ খবর জানায়। কিন্তু জেঠুর মধ্যে কোন চাঞ্চল্য নেই। সে সব শুনে অমায়িক
মন্তব্য করে, ‘তা এতে আশ্চর্য কি? প্রাইভেট কোম্পানি তো আর তোকে বসিয়ে মাইনে দেবে
না। তুই কাজ না করলে ভাগিয়ে দেবে। সে পা ভাঙুক কি হাত। ওদের ওতে কিছু যায় আসে না।‘
তারপর হাতের ভাঁজ করা খবরের কাগজটা মেলে ধরে চোখ বোলাতে বোলাতে বলে, ‘ওসব নিয়ে
একদম ভাবিস না।‘ এসব চাকরি যায় আবার আসে।
‘কিন্তু আমার
ভবিষ্যত?’ মরিয়া হয়ে প্রশ্ন করে বিজিত।
জেঠু এবার একটু মৃদু
হাসে। তারপর বলে, ‘নিজের ভবিষ্যত নিজেই তৈরি কর’। বলে সে আবার কাগজে মুখ নামায়।
কিছুক্ষণ পড়ে কাগজটা আবার সে ভাঁজ করে বিজিতের দিকে ছুঁড়ে বলে, ‘এই নে যেটা
চাইছিলি।‘
বিজিত কাগজটা ক্যাচ
লুফে বলে, ‘কি?’
জেঠু বলে, ‘তোর
ভবিষ্যত। বসে বসে তো শুধু ল্যাদ খাচ্চিস। এদিকে পরীক্ষা এগিয়ে আসছে সে খেয়াল আছে? রোজ
এটা মন দিয়ে পড়বি। জিকে বাড়বে, ইংরেজি নলেজ বাড়বে। বুঝলি?
মুচকি হেসে ওঠে
বিজিত বলে, ‘নিশ্চয়ই পড়ব’। বলেই সে কাগজটা খুলে চোখ বোলাতে শুরু করে।
এরপর কেটে গেছে
প্রায় একটা বছর। বটতলার ধারে চুনিলালের বাড়ি। পেশায় সে বাসচালক। আজ সে সবে বাড়িতে
ঢুকেছে, এমন সময় দরজায় ঠকঠক আওয়াজ।
এই অসময়ে কে এল? কেউ
তো আসে না এখন, এক ঐ মাখনলাল ছাড়া। মাখনলালের কাছে চুনির অনেক দেনা। তাই তাগাদা
করতে আসে সে। স্বভাবতই একটু ভয়ে ভয়ে দরজা খোলে চুনি। কিন্তু বাইরে সে যাকে দেখল,
তাকে ঠিক চিনতে পারল না। একটা বাইশ-তেইশ বছরের ছেলে। হাতে ক্র্যাচ। অন্য হাতে একটা
প্লাস্টিকের ব্যাগ। একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সে ঘরে এসে ঢুকল। ঘরের মধ্যে বেশ কিছুটা
ঢুকে সে দাঁড়িয়ে রইল।
‘কে আপনি? কি চান
বোলেন?’ চুনির কপালে ভাঁজ স্পষ্ট।
‘আপনি কি চুনিলাল?’
চুনির দিকে তাকিয়ে ছেলেটা জিগ্যেস করে। পরিষ্কার বাংলা উচ্চারণ তার।
‘হাঁ, হামি চুনিলাল।
কিন্তু...’
‘একবছর আগের একটা
ঘটনা মনে আছে? সকালের দিকে বাস চালাতেন তো তখন, এই দশটা-সাড়ে দশটা নাগাদ’। ছেলেটা
যেন হঠাৎ করে বলতে শুরু করে।
চুনিলাল এসবের মানে
না বুঝে মাথা নাড়ায়। ছেলেটা ঠিকই বলেছে সে গতবছর ঐ সময়ই বাস চালাত। নৈহাটি-হাবড়া
রুটের বাস। এখন
তার রুট বদলেছে। কিন্তু এই ছেলেটা এসব বলে কেন?
‘মনে আছে, একদিন
বাসে খুব ভিড় হয়েছিল? একটা ছেলে বাসে ঠিকমত উঠতে পারেনি। আপনি জোর ব্রেক কষেছিলেন
বলে সে বাস থেকে পড়ে যায়, আর চাকার তলায় তার পা’টা পিষে যায়। মনে পড়ে এসব?’
চুনির স্মৃতি এবার
হার মানে। একেই মদের ঘোরে সে দিনের অর্ধেক সময় কাটায়, তার ওপর রয়েছে নানান নেশা।
সে গতবছরের এত ঘটনা কি করে মনে রাখে? সে ক্ষমা চাওয়ার গলায় বলে, ‘দেখিয়ে বাবু,
হামার এতসব কুথা তো মনে নাই। কিন্তু এসবে হামার কি কসুর বোলেন তো?’
‘না না ওসব কসুর
মসুর শুনছি না। মনে না পড়লে মনে করাতে হবে।‘ এই বলে ছেলেটা সেদিনকার সমস্ত ঘটনা পুঙ্খনাপুঙ্খরূপে বর্ণনা করে যায়।
ভালভাবে বুঝিয়ে দিতে থাকে। কিছুক্ষণ পর চুনিলাল মাথা নাড়ায়, ‘হাঁ হাঁ মনে পড়েছে’। বলে ওঠে সে। যদিও তার
সেভাবে কিছুই মনে পড়েনি।
কিন্তু সে খুব
ভালভাবে বুঝতে পারে তাকে এই ছেলেটা ফাঁসানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। সে তাই আবার বলে,
‘দেখিয়ে বাবু, এতোদিন পোরে, এ সোব কুথা খামোকা বলছেন কেন? বহুত দিন হোয়ে গেছে না?
তো এসব আভি বাতানে কা কেয়া মতলব? যো হো গেয়া ও হো গেয়া। ছোড়িয়ে না।‘
‘ছাড়ব বলে তো আসিনি।
একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে।‘ ছেলেটা সজোরে বলে ওঠে।
চুনি এবার গম্ভীর
হয়। তার ঘোলাটে চোখ দুটো খুব ক্রুর হয়ে উঠতে থাকে। কালো ঠোঁট দুটো সরু হয়ে আসে
তার। তবু সে যথাসম্ভব শান্ত হয়ে বলার চেষ্টা করে, ‘কেয়া বাতানা চাহতে হ্যায় আপ?’
ছেলেটা এবার হাতের
ব্যাগটা থেকে একটা মিষ্টির প্যাকেট বের করে বলে, ‘এই নিন। আপনার পুরস্কার। সত্যি বলছি দাদা, সেদিন ব্রেকটা কষে আমার অনেক উপকার করেছেন।‘
হাসতে থাকে ছেলেটা।
চুনি তো থ। সে
মিষ্টির প্যাকেটটা ওর হাত থেকে নিয়ে ধরলক্ষণ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুই বলতে পারে
না। ছেলেটা বলতে থাকে, ‘বুঝলেন না তো? এবার বুঝিয়ে দিচ্ছি। আসলে আমি অনেকদিন ধরে
একটা সরকারি চাকরি খুঁজছিলাম। কিন্তু কি জানেন, কোথাও পেলাম না। আর তাছাড়া কোন
কোটাও ছিল না আমার। তাই একজন মিডিওকোর ছেলে
হয়ে চাকরি জোটাই কি করে বলুন তো? কোন সুযোগই তো ছিল না আমার হাতে।
কিন্তু সেই সুযোগটাই
এনে দিলেন আপনি। সেদিনের সেই অ্যাক্সিডেন্টের পর আমার পা’টা চিরকালের জন্য নষ্ট
হয়ে যায়। আর সেই কারণেই আমি আজ পি এইচ কোটা পেয়ে গেছি। আর দেখুন আমার চাকরিও হয়ে
গেছে কি সুন্দর। খুব তাড়াতাড়ি হয়ে গেছে। আমি এখন সরকারি চাকরি করি। এবার বলুন তো,
আপনি সেদিন ব্রেকটা কষায় কতই না উপকার হল? পা’টা ভাঙায় ভাল তো আমারই হল, তাই না?
তাই ধন্যবাদ তো সবথেকে বেশি আপনাকেই জানানো উচিৎ, কি বলেন?
তাই এই সামান্য
মিষ্টির প্যাকেটটা সবথেকে আগে আপনার জন্যই নিয়ে এলাম। নিজে খাবেন, বৌদিকেও দেবেন। ভাইপো,
ভাইঝি সবাই মিলে খুব আনন্দ করুন আজ। কেমন? আমি আজ আসি। ভাল থাকবেন দাদা।‘ এই বলে
ছেলেটা ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
আর এদিকে চুনিলাল মিষ্টির প্যাকেটটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে
দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর দরজাটায় বন্ধ করে খিল আটকে দেয়, আর একটা বাঁকা হাসি হেসে ওঠে
সে নিঃশব্দে।
1 টি মন্তব্য:
ভালই লিখেছেন
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন