‘কি হয়েছে স্বদেশ? কি ভাবছ অত? পিছন থেকে একটা
অচেনা গলার আওয়াজ। ধীরে ধীরে মাথা তোলে স্বদেশ। এতক্ষণ একটানা দুহাতে মাথা চেপে টেবিলের
সামনে বসেছিল সে। হাতের চাপে কপালের দুই পাশ লাল হয়ে আছে। চোখদুটোর তলায় কালি।
রোগা না হলেও বেশ শীর্ণ দেখাচ্ছে তাকে।
মুখ ফিরিয়ে সে যাকে দেখল, চিনতে পারল না প্রথমে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে লোকটা বছর চল্লিশের কাছাকাছি। মুখে ফ্রেঞ্চকাট
দাড়ি। ধবধবে ফর্সা। বেশ ভাল চেহারা। হঠাৎ দেখলে বিদেশী বলে মনে হয়। মাথার চুলগুলো
পরিপাটি করে আঁচড়ানো। কালো কোট, গলায় টাই। তার মুখের দিকে তাকাতেই পেছনে দেওয়াল
ঘড়িতে চোখ পড়ল – দুটো বেজে দশ। ঝিঁঝিঁর ডাকটা মাঝেমাঝেই মারাত্মক হয়ে উঠছে। মাথা
ধরিয়ে দিচ্ছে আরও। ল্যাম্পপোস্টের আলোটা বারান্দায় এসে মৃদু আলোর অনুরণন সৃষ্টি
করেছে। ধূসরে আলো-আঁধারি খেলা। ঝিঁঝিঁর ডাক আর দূর থেকে আসা দু-চারটে কুকুরের
বকবকানি – এছাড়া বাইরেটা পুরোপুরি প্রাণহীন।
ভ্রূ
কুঁচকে গেল স্বদেশের, ‘কে আপনি?’ আগে কোথাও দেখেছি বলে তো মনে হচ্ছে না। এই
রাতদুপুরে...’।
লোকটা
শশব্যস্ত হয়ে বলে উঠল, ‘না না। আমায় তুমি চিনবে না। রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম, দরজাটা
খোলা ছিল, দেখলাম তুমি এমনভাবে বসে রয়েছ যেন খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। তাই ভাবলাম,
তোমার কাছে গিয়ে দেখি। যদি কোন কাজে লাগতে পারি, এই ভেবেই ঘরে ঢুকে পড়লাম’।
স্বদেশ
অবাক হয়ে বলে, ‘তার মানে? মনে হল আর আপনি অপরিচিত একটা বাড়িতে এই ভাবে ঢুকে পড়লেন?
কোথাকার কে, তার ঠিক নেই। দাঁড়ান, আপনার হচ্ছে’। এই বলে স্বদেশ উঠে দাঁড়াতে গেল।
লোকটা তাকে থামিয়ে ঠোঁটের ফাঁকে এক চিলতে হাসি এনে বলে, ‘কিন্তু বাবা,
তুমিও যে দরজাটা খোলাই রেখে দিয়েছিলে? তার বেলা? এত রাতে দরজা খোলা রাখলে চোর যে
ঢুকবেই’।
স্বদেশ
লোকটার কথায় থমকে গেল। সে যে একটা ভুল করেছে সেটা উপলব্ধি করেই একটা লজ্জায় আটকে
গেল সে। লোকটা এদিকে বলে চলেছে, ‘যাই হোক, আগে আমার কথাটা শোন। আমি কোন খারাপ লোক
নই। তোমার কোন ক্ষতি করতেও আসিনি আমি। আমার নাম স্যাম। তুমি আমাকে আপাতত স্যামকাকা
বলেই ডেকো। আমার আসার কারণ তুমি ধীরে ধীরে বুঝবে’।
স্বদেশ
লোকটাকে ভাল করে একবার মেপে নিল। এমনিতে তাকে মন্দ মনে হচ্ছে না। বরঞ্চ চেহারার
মধ্যে বেশ একটা আভিজাত্যসুলভ ভাব আছে। তবে গায়ের রঙ আর পোশাকেই...
যেন
তার মনের কথা ধরতে পেরে লোকটা বলে উঠল, ‘কি ভাবছ? আমি বিদেশী কিনা?’ তারপর নিজেই
বলতে থাকে, ‘যাক, সেকথা পরে হবে। আগে আমি তোমার কথা শুনব। এখন বলো তো, তুমি কি
নিয়ে এত দুশ্চিন্তা করছ? আমি তোমার বন্ধু। তুমি আমাকে তোমার মনের সমস্ত কথা খুলে
বল। দেখবে, বললেই সমস্ত চিন্তা দূর হয়ে যাবে’। এই বলে লোকটা তার কপালে ঠাণ্ডা হাত
বুলিয়ে দিল। কি আরাম সেই হাতের ছোঁয়ায়! কি নিবিড় শান্তি যেন তার হাত থেকে বিকীর্ণ
হয়ে স্বদেশের মস্তিষ্কের প্রতিটা কোষে কোষে ছড়িয়ে পড়তে লাগল।
ধীরে
ধীরে স্বদেশের এমন লাগল যেন তার সমস্ত চিন্তা ভাবনা স্থবির হয়ে যাচ্ছে। তার চেতনা
যেন সম্পূর্ণরূপে বিবশ হয়ে যাচ্ছে। সে শুধু এখন একটাই কথা ভাবতে পারছে, এই লোকটা
তার বন্ধু ছাড়া অন্য কেউ হতে পারে না। এমনই এক বন্ধু যার সাথে মন উজাড় করে কথা বলা
যায়। কিন্তু এর বিপরীতেও যে কোন সম্ভাবনা থাকতে পারে, এ চিন্তা তার মাথাতেই এল না।
সিলিং-এর
কোণে মাকড়সার জাল। তাতে ছোট্ট একটা ফড়িং আটকা পড়ে গেছে। আর একটা মাকড়সা তাকে গিলে
খেতে আসছে। স্বদেশ সেই দিকেই তাকিয়ে, কিন্তু তার ভাবনা তখন অন্য। সে বলতে শুরু
করেঃ-
‘আমার
কথা শুনতে চাইছেন? তাহলে যে প্রথম থেকেই বলতে হয়। আমার দুশ্চিন্তার কারণ যে তাৎক্ষণিক নয়’। এই বলে স্বদেশ থেমে গেল।
যেন কোথাও আটকে গেল সে। অচেনা লোকের কাছে সে কি বলবে? তার নিজের জীবনের কথা সে কি
করে বলে? সঙ্কোচ লাগে তার।
স্যামকাকার সরু চোখ নজর এড়ায় না। বরাভয়
জানায় সে, ‘কোন চিন্তা নেই। আমাকে তুমি সব খুলে বল। দেখবে, সমস্ত চিন্তা দূর হয়ে
গেছে।
একটা হ্যালুসিনেশান যেন কাজ করে স্বদেশের
মধ্যে। একটা আবেশের ভেতরে ডুবে সে বলতে থাকে, তবে শুনুন। আসলে জানেন, ছোটবেলা
থেকেই খুব সুখী ছিলাম আমি। আমাকে সবাই খুব পয়া মনে করত। যে কাজে হাত দিতাম, তাতেই
বেশ সাফল্য পেয়ে যেতাম। ক্লাসের পরীক্ষায় কোনদিনও থার্ড পজিশনের নীচে নামিনি। পড়াশুনোর
পাশাপাশি ছবি আঁকা শিখেছি। গানও শিখেছি। আর দুক্ষেত্রেই গোটা কয় কম্পিটিশনে
প্রাইজও জুটিয়েছিলাম। হায়ার
সেকেণ্ডারীতে এইটটি পার্সেন্টের ওপর নম্বর ছিল আমার। কিন্তু জয়েন্টের রেজাল্ট খুব
একটা ভাল হয়নি। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে র্যাঙ্ক এসেছিল ছ’হাজারের মত। আর এখান থেকেই শুরু আমার দূর্ভাগ্য। আমার ইচ্ছা ছিল না ইঞ্জিনিয়ারিং
পড়বার, ফিজিক্সে অনার্স নিয়ে পড়বার কথাই ভেবেছিলাম। কিন্তু সেকথা বলতেই বাবা গুম
হয়ে গেল। আমায় বলল, ‘হাজার হাজার অনার্স গ্র্যাজুয়েট। সব বেকার হয়ে বসে। এখানে
চাকরির কোন গ্যারান্টি আছে?’ আমি স্বীকার করলাম, নেই।
তবু
ছাড়লাম না, ‘কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং পড়লেই যে চাকরি হবে তাও তো বলা যাচ্ছে না বাবা। আজ তো হাজার হাজার ইঞ্জিনিয়ার বেরোচ্ছে। সবাই কি চাকরি পাচ্ছে?’
বাবা
সেকথার উত্তর না দিয়ে মেজাজী স্বরে বলে দিল, ‘দেখ, এঁড়ে তক্কো করিস নে। আজকের দিন
যে কতখানি কঠিন হয়ে যাচ্ছে তা তো তোরা ঘরে বসে বুঝবি না। এখন একটা টেকনিকাল নলেজ
থাকা ছেলের দাম সাধারণ গ্র্যাজুয়েটের থেকে অনেক বেশি। তার চাকরি-বাকরির অনেক
রাস্তাও খোলা থাকে। এ যুগটা যে পুরোপুরিই প্রযুক্তি নির্ভর, তা তো আর অস্বীকার
করতে পারিস না?’
বাবা
আমার কোন কথাই শুনবে না, জানি। তাই সেদিন আর বাবার ভাষায় ‘এঁড়ে তক্কো’ করিনি। তবে
এটুকু জানতাম এ সমস্ত বাবার নিজের কথা নয়। বাবার অনেক বন্ধু আছে, যারা বাবার ব্রেন
ওয়াশ করেছে যাতে আমি ইঞ্জিনিয়ারিং ছাড়া অন্য কিছু পড়বার কথা না ভাবি। মাঝেমাঝেই
শুনতাম বাবা ফোনে অফিসের কলিগদের সাথে, পরিচিত লোকেদের সাথে আমার ভবিষ্যত পড়াশুনো
নিয়ে আলাপ-আলোচনা করছে। তাদের মত নিয়েই বাবা মত তৈরি করছে। অথচ আমার মতের গুরুত্বই
যেন তাঁর কাছে নেই। অন্যদিকে মায়ের কাছে যেতেই মা বলল, ‘এসব আমি কিছু বলতে পারব
না। বাবা যা বলে তাই শোন। অনেকের কাছ থেকে সাজেশন নিয়েই বাবা তোকে ইঞ্জিনিয়ারিং
পড়তে বলেছে। তাই তার কথাও ফেলনা নয়। অগত্যা এখানেও কিছু সুবিধা করতে না পারায় এটা
ভাল করে বুঝতে পারলাম যে ইঞ্জিনিয়ারিংই হবে আমার ভবিষ্যত। তবে যাই হোক, ঐ র্যাঙ্কে
আমি পছন্দমত কোন কলেজই পেলাম না। তাই নির্ভর করতে হল আরো একটা বছরের জন্য। ঠিক
করলাম, আবার জয়েন্ট দেব। আর এবার ভাল করে প্রিপারেশন নিতে হবে।
এই
সময়ে আমি সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলাম চিরশ্রীকে। ও আমার পাড়ারই বন্ধু। আমার মতই ওরও
নৈহাটিতেই পড়াশুনো। কাত্যায়নী গার্লসের ছাত্রী ছিল ও। আমরা একই বছরে উচ্চমাধ্যমিক পাস আউট। টিউশান
ব্যাচে একই সাথে পড়তাম। ফলে ওর পড়ার সাথে অনেকটাই পরিচিত ছিলাম। ও-ও আমার মত ইঞ্জিনিয়ারিং দিচ্ছে দেখে বললাম, ‘তাহলে একসাথেই
প্রিপারেশন নেওয়া যাক?’ ও মুচকি হাসল।
শুরু
হল পড়া। প্রথম দিকে কোন কোচিং সেন্টারে ভর্তি হইনি। জয়েন্ট পরীক্ষার আগে শুধু
টেস্টগুলো দেওয়ার জন্য অমুক ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হয়েছিলাম। চিরশ্রীও তাই। তবে আমরা
বেশিটাই নির্ভর করেছিলাম উচ্চমাধ্যমিকের স্যারেদের ওপরেই। ফিজিক্সের তাপস স্যার,
কেমিস্ট্রির কুন্তল স্যার জয়েন্টের জন্যও পড়াত, তাই সুবিধা ছিল। আর আমাদের স্পেশাল
রিকোয়েস্টে অঙ্কের শঙ্কুদাও আমাদের জন্য পড়ার ব্যাচ চালু করল।
-‘তারপর? পরের বছর জয়েন্টে রেজাল্ট কেমন
হল?’ স্যামকাকা উদ্গ্রীব।
‘রেজাল্ট
আহামরি কিছু ভাল হল না। র্যাঙ্ক একটু বেড়ে হল পাঁচ হাজার মত। আর চিরর হল সাড়ে ছয়।
উন্নতিটা ওই ভাল করেছে। আগের বছর ওর র্যাঙ্ক হয়েছিল বারো হাজারের মত।
কিন্তু
র্যাঙ্কের দিকে আর না তাকিয়ে মেরে দিলাম কাউন্সিলিংয়ে। ভাল কলেজের মধ্যে পেলাম
আদিসপ্তগ্রামের একটা কলেজ আর পেলাম শিলিগুড়ি। শিলিগুড়িতেই যদিও আমার যাওয়ার ইচ্ছা
ছিল, কারণ কলেজ হিসেবে ওটাই বেশি ভাল। কিন্তু বড্ড দূর, তাই মা ছাড়তে রাজী হল না।
হাত নেড়ে পরিষ্কার জানিয়ে দিল, ‘না না। অত দূরের কলেজে গিয়ে কাজ নেই। হাতের কাছে
ভাল কলেজ আছে। দর্পণদাও তো পড়েছে ওই কলেজে, সে কি চাকরি করছে না?’
আমি
সেইরাতেই চিরশ্রীর বাড়ি গেলাম। ওর সাথে কথা বলে, আলোচনা করে ঠিক করলাম
আদিসপ্তগ্রামেই থাকব। দূরে যাব না। কিন্তু একটা ব্যাপার আমার খুব খারাপ লাগল,
এখানে আমি ওর সাথে পড়তে পারব না। কারণ ওর স্ট্রীম এখানে নেই। আছে হুগলীতে। তাই ও
পড়তে চলে গেল হুগলী।
এদিকে
আমার শিকে ছিঁড়ল আদিসপ্তগ্রামেই। কাছেই কলেজ, তাই হস্টেল নেই, র্যাগিংও নেই। আর
আমাদের কলেজ খুব ডিসিপ্লিনড্ ছিল, তাই কলেজ র্যাগিং ছিল না। কিন্তু পড়ার খরচ
চালাতে ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিতে হয়েছিল, কত জানেন?’
একটু
থামল স্বদেশ। তারপর ধীরে ধীরে কেটে কেটে উচ্চারণ করে সে নিজেই উত্তর দিল, ‘পাঁচ
লাখ’।
স্যামকাকা
তার কথাগুলো শুধু শুনছেই না, একেবারে গিলছে। তার চোখের দৃষ্টি স্বদেশের ওপরে স্থির
নিবদ্ধ। সেই দৃষ্টিতে আকুতি খুঁজে পেল স্বদেশ। যেন সে আর ধৈর্য রাখতে পারছে না।
স্বদেশ
বলে যেতে লাগল, ‘এতদিন পর্যন্ত তেমন কোন বিঘ্ন ঘটেনি। সবটাই ঠিকঠাক। থার্ড ইয়ারে
ক্যাম্পাস সিলেকশন হল। আমি ভয়ে ভয়ে ছিলাম। শুনছিলাম, মন্দার চাপে নাকি
রিক্রুটমেন্ট খুব কম হচ্ছে।
কিন্তু
আমার ভাগ্য ভালই বলতে হবে। প্রথম কয়েকজনের মধ্যে থেকেই আমি সিলেক্টেড হয়ে গেলাম।
টিসিএস – টাটা কনসাল্টেন্সি সার্ভিস। সেখানে অ্যাসিস্ট্যান্ট সিস্টেমস্
ইঞ্জিনিয়ারের পোস্ট। বছরে সাড়ে তিন লাখের প্যাকেজ। আনন্দে নেচে উঠেছিলাম সেদিন।
বাবা বলেছিল, ‘দেখ, কেন আমি এত করে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হওয়ার কথা বলতাম। এখন
বুঝছিস তো, এই বুড়ো মানুষটা কিছু খারাপ বলেনি সেদিন।
বাবা-মাকে
প্রণাম করলাম আমি।
সেদিনই চিরশ্রীকেও ফোন করে সব
জানিয়েছিলাম। ও তো শুনেই বলল, ‘রিএলি? দারুণ খবর তো? এই জানিস, কিছুক্ষণ আগেও আমি
তোর কথাই ভাবছিলাম। যাই হোক, কনগ্র্যাচুলেশন্স। আর কি করছিস আজ? চল না লাইব্রেরীতে
যাই’। আমিও ওর কথায় তৎক্ষণাৎ রাজী হয়ে গেলাম। বস্তুত, আমার আর চিরশ্রীর জয়েন্ট পড়া
থেকে শুরু করে অনেক উপলক্ষ্যেই আড্ডা মারবার ঠেক ছিল লাইব্রেরী।
কিন্তু তখনও তো জানতাম না, এরপরেও কপালে
কি লেখা আছে? ফোর্থ ইয়ারে পাশ করে বেরোনোর পর যথানির্ধারিত টিসিএসে আমার ট্রেনিং
শুরু হল। এখানে নয়, যেতে হল গুয়াহাটি। ট্রেনিং পিরিয়ড ছিল ছ’মাসের। তারপর চাকরিতে
জয়েন করলাম। এবার পোস্টিং খাস কলকাতায়। কিন্তু হলে কি হবে, বাড়ি থেকে যাতায়াত করার
কোন সম্ভবনাই ছিল না। কারণ অফিস খুলত ন’টায় আর ছুটি সাতটায়। কিন্তু বিভিন্ন কারণে
সেটা রাত ন’টা এমনকি দশটা পর্যন্তও গড়াত। অফিস থেকে ছুটি পাওয়াটা সহজ ছিল না বড়।
‘কেন?’ স্যামকাকা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে
তাকিয়ে থাকে।
স্বদেশ বলতে থাকে, ‘সব শালা ঐ চন্দনদার
জন্য। ও ছিল আমাদের প্রোজেক্ট ম্যানেজার। সাতটার সময় ছুটি সে জানে, ঠিক ছ’টা সাড়ে
ছ’টা নাগাদ এমন একটা কাজ ধরিয়ে দিত যাতে সাতটার মধ্যে বেরোতে না পারি।। আর ঐ কাজ
করবার পর ভিড় ট্রেনে বাসে বাদুড়ঝোলা হয়ে বাড়ি এলে দুদিনেই কেলিয়ে পড়তাম। আর এদিকে
দমদমে আমাদের একটা ফ্ল্যাট কেনাও ছিল। অপ্রয়োজনে ওটা পড়েই থাকত। এখন ওটা প্রয়োজনে
তাই আমিই ব্যবহার করতে লাগলাম। বাড়ি ফেরার ক্লান্তিটাও রইল না। আর আমার সময়ও অনেক
বাঁচল।
দুঃখের
বিষয় কি জানেন, প্রথম কয়েকদিন অফিস করেই বুঝে গিয়েছিলাম এখানে আমি বেশিদিন টিকতে
পারব না। একদিনের ঘটনা বলি। সেদিন ভারত-পাকিস্তানের ম্যাচ ছিল। আমি তো নিজের কাজেই
তখন ব্যস্ত। যেহেতু নতুন, তাই নিজের কাজগুলোই ভাল করে রপ্ত করে উঠতে পারিনি। মাঝে
মাঝে সিনিয়রদের কাছে হেল্প চাইতাম। যদিও বিশেষ একটা সাহায্য আমি কারুর কাছ থেকেই
পাইনি। আর চন্দন তো অসুবিধার কথা শুনলেই বলত, ‘অত ভাববার কি আছে? গুগল ইট’। যাই
হোক, তো সেদিন কাজ করছি। হঠাৎ পেছন থেকে চন্দনদা এসে বলল, ‘এই শুনছিস, আমার একটা
কাজ করে দে তো। আমি এই প্রোগ্রামিংটা করছিলাম, অনেকটাই হয়ে গেছে। তুই বাকিটা করে
দে। আমার একটা অন্য জায়গায় কাজ আছে’। রোয়াবী গলায় এসব বলে সে আমার উত্তরের অপেক্ষা
না করেই হনহন করে বেরিয়ে গেল। পাশের ঘরে শুনলাম ও আরেকজন বন্ধুকে বলছে, ‘চ, তো
ইন্ডিয়া কেমন ব্যাটিং করছে দেখে আসি’।
আমি
তো এদিকে হতভম্বের মত বসে। কি করব কিছুই মাথায় ঢুকছে না। নিজের কাজই এখনও ভাল করে
শিখে উঠতে পারিনি তো অন্যের কাজ। পরে বুঝেছিলাম, এসব আমাকে অপদস্থ করার চেষ্টা।
আমি একাজটা ঠিকঠাক না করতে পারলে আমাকে সিনিয়রের কাছে অপমানিত হতে হবে। এতে আমার
উন্নতি আটকাতে পারে। কি আর করি, পাশে একটা দিদি বসে কাজ করছিল। ওকেই বললাম সব।
কিন্তু সেও তো তার নিজের কাজে ব্যস্ত। আমাকে কাজ বোঝাবে, তার সে সময় কোথায়? তবু
তাকে ভালই বলতে হবে। দশ-পনেরো মিনিট পর সে বলল, ‘কই দেখি, কি দিয়েছে তোকে?’
এরকম
নানাধরনের অত্যাচার তো ছিলই। এরই মধ্যে একদিন হিউমিলিয়েশনের চূড়ান্ত হল। সেদিন
প্রোজেক্টের জন্য বেরিয়েছিলাম বালিগঞ্জের একটা অফিসে। সেখান থেকে কাজ সেরে বেরোতে
বেরোতে রাত বারোটা হয়ে গেল। ফ্ল্যাটে যখন পৌছলাম ঘড়ি বলছে পৌনে দুটো। ফ্ল্যাটের
কেয়ারটেকার রামদাকে ফোন করে দিয়েছিলাম। তাই রাত্তিরটা আর রাস্তায় কাটাতে হয়নি।
রাতে রান্নাবান্নার গল্পই নেই। কয়েকটা বিস্কুট, মুড়ি আর একটু বাসি তরকারি ফ্রিজে
রাখা ছিল তাই সাঁটিয়েই দিলাম ঘুম।
ঘুম
ভাঙল আটটা। সকালের জোগাড়যন্ত্র সেরে, স্নান খাওয়া করে বেরিয়ে অফিস পৌছলাম সোওয়া
ন’টা। আর দিন খারাপ থাকলে যা হয়, ঢোকার মুখেই পড়লাম এক্কেবারে গ্রুপ লিডারের
সামনে।
-
আজ দেরী কেন?
-
আসলে স্যার, স্নান
করার জল ছিল না। তাই জল তুলে আসতে হল।
-
ওসব বাজে ওজর আমি
শুনতে চাই না। তোমার ঘরে জল ছিল না বলে অফিস সেটা সাফার করবে কেন? ফালতু লেট লতিফ
স্টাফের দরকার নেই আমার। ইনডিসিপ্লিনড্ স্টাফ সব। ... আমি প্রায় জনা শ’য়েক লোকের
সামনে এইভাবে অপমানিত হয়ে চলেছি আর আমার অফিস কলিগরা সব দেখছে, শুনছে। সত্যি বলছি
এত বড় অপমান আমাকে কেউ কখনও করেনি। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল যেন ছুটে পালিয়ে যাই।
ইচ্ছা করছিল, চাকরি ছেড়ে দিই। কিন্তু কোথায়ই বা পালাব আর চাকরি ছাড়লে করবটাই বা
কি?
দিশাহীন হয়ে পড়লাম আমি। এখন কি করব? এ
চাকরি যে আমার জন্য নয় সে আমি যথেষ্টই বুঝেছি। আর এই অপমান দিনের পর দিন সহ্য করে
আর থাকা চলে না। কিন্তু অন্য কোথাও ঠাঁই না পেলে এ ছাড়িই বা কি করে? ভেবে ভেবে কোন
কূলকিনারা পাচ্ছিলাম না তখন। অবশেষে বাড়িতেই সব খুলে বললাম। মা-বাবা কিছুটা বুঝতে
পেরেছিল আগে থেকেই। হয়ত আমার আচার-আচরণ থেকেই কিছু কিছু আঁচ করতে পেরেছিল তারা।
কিন্তু সমস্তটা অনুপুঙ্খ শোনার পর মা-বাবা দুজনেরই মুখ গেল গম্ভীর হয়ে। বাবা বলল,
‘কিন্তু বিকল্প কিছু একটা করার আগে একটা চাকরি হঠ করে ছেড়ে দেওয়াটা উচিত হবে না। এতে
কোন লাভ নেই। অন্য চাকরি দেখবি দেখ। কিন্তু এটা এখনই ছাড়িস না।
মা
বলল, ‘তবে অন্য কোন চাকরি মানে কিন্তু সরকারি চাকরির কথাই ভাব এখন। আমার মনে হয়
সরকারি চাকরির পরীক্ষাগুলো দিতে থাক।
বাবাও
তাতে সায় দিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, তাই ভাল। কোন একটা ভাল ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়ে যা।
তারপর ভাল করে প্রিপারেশন নে’।
চিরশ্রীকেও
সব জানালাম। ও তখন এম.টেক ফার্স্ট ইয়ার। অবশ্য ওকে আমি মাঝেসাঝেই ফোনটোন করে
অফিসের অনেক ঘটনা বলতাম। আর ও-ও আমাকে অনেকদিন ধরেই অন্য রাস্তা খোঁজার কথা বলছিল।
আর এদিন সব শুনে ও বলে, ‘ভাল ডিসিশন সন্দেহ নেই। কিন্তু তুই চাকরি করে পড়ার সময়
পাবি?’
আমি
একটু ভেবে বললাম, ‘বের করে নিতে হবে। ফ্ল্যাটে ফেরার পর যেটুকু সময় পাই, তাই কাজে
লাগাতে হবে’। ও বলল, ‘কিন্তু কোন ইনস্টিটিউটে ভর্তি হবি ঠিক করেছিস?’
আমি
বলি, না এখনও ঠিক হয়নি। তারপর ওকে বললাম, ‘এই, তুই একটা খোঁজ এনে দে না। ভাল কোন একটা সংস্থা, যেটা বেশি টাকাও নেয় না আবার ভাল পড়ায়’। ও হাসে আমার কথা শুনে, ‘তুই
কোথায় পড়বি তাও আমাকে জোগাড় করে দিতে হবে? কুঁড়ে কোথাকার!’ আমি কৃত্রিম রাগের সুরে
বলি, ‘যাঃ তোকে কিছু করতে হবে না’। ও এবার হি হি করে হেসে ফেলে। তবে মুখে এসব বলেও
এরপর ওই কিন্তু আমায় একটা ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের খোঁজ এনে দিয়েছিল।
একবার
নয়, দুবারের চেষ্টায় পেয়েও গেলাম একটা চাকরি। এত সহজেই যে একটা সরকারী চাকরি পেয়ে
যাব তা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনি। এস.এস.সি পরীক্ষা দিয়ে পেলাম এম.টি.এসের
চাকরি। আমায় তখন আর দেখে কে? কল লেটার হাতে আসা মাত্রই টি.সি.এসে নাচতে নাচতে
ইস্তফা দিয়ে এলাম। ইচ্ছে ছিল, চন্দনদাকে একবার ধন্যবাদ দিয়ে আসি। বস্তুত ওদের
ব্যবহারের জন্যই তো শাপে বর হল। আখেরে লাভই হল আমার। যাই হোক, সেসব আর করিনি।
মেডিকেল টেস্ট হল, ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট নেওয়া হল। পুলিশ ভেরিফিকেশন অবশ্য পরে
হবে। আগে চাকরিতে জয়েন।
জয়েন
করবার আগের দিন চিরকে ফোন করলাম। এত বড় সারপ্রাইজটা এতদিন লুকিয়ে রেখেছিলাম শুনে ও
তো রেগে টং। বলে, ‘যাঃ, তোকে কনগ্র্যাচুলেশনস জানাব না। পাজি একটা!’ ওর অভিমানে
প্রলেপ লাগিয়ে দিলাম। বললাম, ‘আরে বাবা, তোকে আগে বললে কি কাণ্ডই যে বাধাতিস তা কি
আর জানি না। জনে জনে ডেকে পাড়ায় চাউর করে দিতিস। বলা যায় না, নৈহাটির হয়ত আর একটা লোকেরও জানতে বাকি থাকত না যে স্বদেশ
নামে একটা ছেলে চাকরি পেয়েছে’। ও আমার কথা শুনে হি হি করে হাসে। তারপর বলে, ‘মাসের
প্রথম মাইনে পেলে আমায় কি দিবি?’ আমি কিছুক্ষণ চুপ। অস্বীকার করব না, সেদিন সত্যিই
ইচ্ছা করছিল, ওকে সামনে থেকে দেখি। ওর হাত দুটো ধরে বলি, ‘তুই যা চাস, সেদিন আমি
তাই এনে দেব চির। শুধু তুই আমার সাথ ছেড়ে যাস না’। কিন্তু এইসব আবেগের কথা আমার
মুখে ফোটে না, তাই তখন ওকে কোনরকম ভণিতা না করেই বললাম, ‘সেদিনই দেখা যাবে’। ও
এবার হাসতে হাসতে বলে, ‘তাহলে এবার তুই সেই চন্দনদার হাত থেকে ছুটি পেলি বল’। আমিও
স্বস্তির হাসিতে জবাব দিলাম, ‘তা আর বলতে। চল আজ লাইব্রেরী যাই। অনেকদিন যাওয়া
হয়নি’।
সরকারি
চাকরি তো এবার জুটল। এখন নিশ্চিন্ত। না না বিয়ে টিয়ে করার কথা ভাবছি না। পরের দিন
থেকেই লোকে দেখি দেখা হলেই বলতে শুরু করে দিয়েছে, ‘কনগ্র্যাচুলেশনস’। এদের মধ্যে
অনেকেই আছে যারা রাস্তায় দেখা হলে আমার সাথে ভাল করে কথাও পর্যন্ত বলত না। এই যেমন
আমাদের পাশের বাড়ির সত্যজেঠু। সেদিন অফিসে যাচ্ছি। হঠাৎ পথ আগলে দাঁড়াল। বলে, ‘কি?
ভাল খবর শুনেছি তো। এবার একদিন খাওয়াতে হবে কিন্তু’। ওনার কথার মধ্যে না ছিল কোন
দরদ, না ছিল আন্তরিকতা। আমি হেসে জবাব দিলাম। ভূমিকা শেষ করে এবারে এলেন আসল কথায়।
‘জানো তো বাবা। তোমার বোন তো একদম পড়াশুনো করে না। মানে কিভাবে কি পড়লে ভাল হয় বল
তো? ওকে সেইমত বোঝাতে হবে। এই চাকরির পড়াশুনো তো পুরো আলাদা’। বলতে গেলে ওনার কথা
শুনে আমার হাসিই পেল। ওনার নিজের মেয়ে টুয়াকে উনি আমার বোন বলছেন। তা ভাল। কিন্তু
এমন বোন থাকার চেয়ে না থাকাই ভাল যার সাথে আমার বছর দশেক কথা নেই। অনেক ছোটবেলায়
একবার না দুবার মাঠে গিয়ে ওর সাথে ফুটবল খেলেছিলাম। তারপর তো কবে সেসব চুকেবুকে
গেছে। এখন মাঝে মাঝে হাফ প্যান্ট পরে কলেজে যেতে দেখি। ব্যস, সম্পর্ক ঐ পর্যন্তই।
তাকে বোন সম্বোধনে হাসি না পেয়ে পারে?
স্যামকাকা
এদিকে অধীর, ‘হাঃ হাঃ। তা ঠিক। কিন্তু তারপর কি হল বল?’
স্বদেশ বলে, ‘তারপরের ঘটনাও খুব একটা
সুখের নয় কাকা। এখানেও সেই বিসমিল্লায় গলদ। আসলে তখনও তো জানতাম না, এখানেও কপালে
কি লেখা আছে? এও জানতাম না, এই চাকরিও নিতান্তই স্বল্পায়ূ। এতটা বলে একটা
দীর্ঘশ্বাস ফেলল স্বদেশ।
স্যামকাকা বলে, ‘কেন কি হয়েছিল? চাকরি
করোনি তারপর?’
মাথা নাড়িয়ে স্বদেশ বলে, ‘নাঃ, ঠিক ছাড়িনি
এখনও। তবে আর ও অফিসমুখো হব না ঠিক করেছি’।
স্যামকাকা বলল, ‘কেন?’
স্যামকাকার মুখের দিকে তাকিয়ে স্বদেশ বলল,
‘দেখো স্যামকাকা, প্রথমত আমি অফিসে ঢোকার আগে পর্যন্ত জানতাম না যে কিসের চাকরি আমি
পেতে চলেছি। গ্রুপ সি পোস্ট – এটুকু পর্যন্তই জানতাম। আর দ্বিতীয়ত, এখনকার দিনে
একটা সরকারি চাকরি হল হাতে চাঁদ পাওয়ার থেকেও কিছু বেশি। তাই সেই জিনিস আমি ছাড়ি
কি করে? অন্তত নিজেকে একেবারে বেকার করে দিয়ে? এই দুটো কারণেই আমি কেবল এই অফিসে
চাকরি করছি।
কিন্তু কেন? সরকারি চাকরি ছাড়বার কথা ভাবছোই
বা কেন?
কিছুক্ষণ কিসব ভেবে নিয়ে হাল্কা শ্বাস
ফেলে স্বদেশ বলে, ‘তাহলে শোন। আমার চাকরি হয়েছিল ইনকাম ট্যাক্সে। কল লেটারে
ধর্মতলার অফিসে জয়েন করতে বলেছিল। প্রথম দিন যেদিন অফিসে পৌছলাম, দেখি দশতলা উঁচু
প্রকাণ্ড বিল্ডিং। সামনে লেখা আয়কর ভবন। পাশের দেওয়ালে বিরাট বড় একটা অশোকস্তম্ভ।
আমাকে জয়েন করতে বলা হয়েছিল দোতলায় চোদ্দ
নম্বর ঘরে। বড়বাবু তখনও আসেনি। সে না এলে তো জয়েনিং হবে না। তাই বাইরে করিডরটায়
পায়চারি করছিলাম। সেখানে কতকগুলো বেঞ্চ পাতা। সেখানে আমার মত বয়সী কতকগুলো
ছেলেমেয়ে গল্প করছে। হয়ত ওরাও আমার সাথে জয়েন করতে এসেছে। ওদের একজনের সাথে কথা
বলতে যাব, এমন সময় হঠাৎ নোটিশ বোর্ডটায় চোখ পড়ল। সেখানে বড় বড় করে লেখা – DUTIES OF MTS. দেখে তো আমার কৌতুহল এক লহমায়
দ্বিগুণ বেড়ে গেল। সত্যি কথা বলতে কি, এতক্ষণ পর্যন্ত আমি জানতামও না, এম.টি.এস
হিসেবে আমার কাজটা কি? শুধু এর পুরো নামটাই জানতাম – মাল্টি টাস্কিং স্টাফ।
কিন্তু নোটিশ বোর্ড দেখে তো আমার চক্ষু
চড়কগাছ। হেন কাজ নেই, যা এম.টি.এস দের করতে হয় না। আর কাজও সব তেমনি। ফাইলপত্তর
সাজিয়ে রাখা, চেয়ার-টেবিল পরিষ্কার করা, ঘর ঝাঁট দেওয়া, বাথরুম পরিষ্কার করা, অফিস
থেকে অফিসে চিঠি বয়ে নিয়ে যাওয়া, অফিসের সামনে বাগান থাকলে মালীর কাজও করতে হতে
পারে, ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকলে গাড়ি চালাতে হবে – ওফফ্। আর বলতে পারছি না। পরে জেনেছিলাম, ঐ গ্রুপ ডি পোস্ট তুলে দিয়ে তাদের সকলকেই এম.টি.এসের আওতায় এনেছে।
আর নামেই করেছে গ্রুপ সি।
তবুও আটকায়নি আমার। ভাবলাম আগে জয়েন তো
করি, তারপর দেখা যাবে। অন্যান্য যারা আমার মতই এই পোস্টে জয়েন করতে এসেছে তাদের
কথা শুনে মনে হল, হয়ত আমাদের মত লেখাপড়া জানা ছেলেদের বেল অ্যাটেন্ড করা, চা করা –
এসব কাজ হয়ত করতে হবে না। যাই হোক, কয়েকদিনের মধ্যেই আমার ফাইনাল পোস্টিং হয়ে গেল
ঐ বাড়িরই ন’তলায়। প্রথম দু-তিনদিন ভালভাবে কাটল। আমাকে বিশেষ কোন কাজ করতে হত না।
সার্ভিস বুকে অফিসারের সই করবার দিন অফিসার বিপ্লব স্যার বলেছিল, দেখো স্বদেশ,
আমাদের অফিসে দুজন গ্রুপ ডি স্টাফ আছে। তারা থাকলে তোমার চিন্তা নেই। কিন্তু না
থাকলে তোমাকে একটু দেখতে হতে পারে। আসলে বড়সাহেব বেল বাজালে অ্যাটেন্ড করতে হয় তো,
তাই’। এই বলে কিছুক্ষণ উনি আমার সার্ভিস বুকটা ভাল করে দেখে নিলেন। তারপর বললেন, বি
টেক পাশ করে এম.টি.এসের চাকরি! নাঃ, স্বদেশ এ চাকরি তোমার জন্য নয়। তুমি ভাল করে
পড়াশুনো করে চাকরির পরীক্ষা দাও তো। এখানে পড়ে থেকো না যেন। তাহলেই শেষ। সত্যি
তোমাদের মত ভাল ভাল ছেলেরা...
আসলে আমার সাথে যারা এই চাকরিতে ঢুকেছে,
তাদের সবাই মিনিমাম গ্র্যাজুয়েট। একজন দুজন আছে তো এমনও আছে যারা মাস্টার ডিগ্রী
হোল্ডার। তাই যখন আমরা নিজেদের কাজ সম্বন্ধে জানতে পারলাম, তখন মনটা যে কিভাবে
ভেঙে গেল তা বলে বোঝানো যাবে না। সম্রাট তো মাথায় হাত দিয়ে বলছিল, ‘কি লাভ হল এত
পড়াশুনো করে?’ সম্রাটের নেট পাশ করা আছে। কলেজ সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা হচ্ছে না
প্রায় ন-দশ বছর। তাই ও একটা কলেজে পার্টটাইম চাকরি করত।
কিন্তু আমি নিজে যেন কোন কথাতেই স্বান্তনা
পাচ্ছিলাম না। নিজেকে বেয়ারার সমতুল করে কিছুতেই ভাবতে পারছিলাম না আমি। তবু পড়ে
থাকতে হবে এখানেই, এভাবেই। এই নিয়েই ছিলাম। প্রথম তিন-চারদিন নির্বিঘ্নেই কাটল।
বেল অ্যাটেন্ড করার দুজন পিওন ছিল। তারাই সব সামলাচ্ছিল। এরপরে একদিন কি কারণে
জানি না, ঐ দুজন স্টাফের দুজনেই কামাই করল। এখন সকালের দিকে নিয়মমাফিক আমাদের
বড়োসাহেব বেল দিয়ে দিয়েছে, তাকে চা করে দিতে হবে। কিন্তু কেউ নেই। অগত্যা চা করার
চাকরি আমাকেই করতে হল। মনে আছে, সেটাই ছিল আমার প্রথম অন্যের জন্য এভাবে চা করে
দেওয়া। লজ্জায় যেন আমার মাথাটা হেঁট হয়ে যাচ্ছিল। এদিকে আমাদের অফিসের ইন্সপেক্টর
শশাঙ্কদা বলছে, ইস্ এই ছেলেটাকে চা করতে হচ্ছে! ওনার কথাগুলো তখন আরো বিষের মত
জ্বলছিল। তবু সবটা মেনে নিচ্ছিলাম। যাক, একদিন চা করে দিয়েছি। কিন্তু তখনও তো
জানতাম না, এরপর আমার জন্য কি অপেক্ষা করে আছে।
বেল অ্যাটেন্ড করার জন্য ঘরে ঢুকে বসতে
পারিনি। বাইরে যেখানে গ্রুপ ডি স্টাফেরা বসে সেখানে বসেছি। দুপুরের দিকে একটা বেল
পড়ল। অমনি ছুটে গেলাম স্যারের ঘরে। আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন,
‘আপ মেরা এ টিফিন বক্স আচ্ছা করকে সাফা কর দিজিয়ে তো’। কথাটা শুনেই আমার মাথাটা
কেমন দপদপ করতে লাগল। মুখ থেকে প্রায় বেরিয়ে যাচ্ছিল, ‘আপনার টিফিন বক্স আমি মাজব
কেন? আমি তো কারুর পার্সোনাল কাজ করতে বাধ্য নই। নিজের কাজ নিজে করতে পারেন না?’
কিন্তু নিজেকে কোনরকমে সামলে নিলাম। সেদিনই প্রথম চা করা, আর সেদিনই প্রথম অন্যের টিফিন
বক্স পরিষ্কার করলাম। ইস্, কি নোংরা সেই বক্স। অন্যের এঁটো খাবার হাত দিয়ে ঘষে পরিষ্কার করতে
হচ্ছে। তাও যদি নিজের কোন লোক হত। ছিঃ। নিজেকেই কেন জানি না, খুব ছোট মনে হতে লাগল। এই বলে কিছুক্ষণ থামল স্বদেশ।
তারপর আবার শুরু করল, ‘সেইদিনই একটা চিঠি
লিখে দিলাম। জানিয়ে দিলাম, আমার পক্ষে এইসব কাজ করা সম্ভব নয়। তাই আমি আর আপাতত
অফিস কন্টিনিউ করতে চাই না। চাকরি ছাড়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু আমি ছ’মাস
একটানা উইদাউট পে হিসেবে থাকতে পারি। কিন্তু তার মধ্যে একটা ধান্দা কিছু করতে হবে।
কিন্তু তবুও ভাবনা আমার পিছু ছাড়েনি।
জানো, স্যামকাকা, একটা হতাশাবোধ নিরন্তর আমার ভেতরে কাজ করে যায়। কি করব আমি? আমি
কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। নিজের কোন ভবিষ্যত দেখতে পাচ্ছি না সামনে’। এই বলে স্বদেশ
মাথায় হাত দিয়ে মাথা নীচু করে বসে রইল।
পিছন থেকে স্যামকাকা তার পিঠে হাত রাখে। মোলায়েম
স্বরে বলে, ‘তোমার কোন চিন্তা নেই স্বদেশ, আমি তোমায় কাজ দেব। তুমি করবে?’
স্যামকাকার কথায় সে ধীরে ধীরে মাথা তোলে।
অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, ‘তুমি? কিন্তু তুমি কে? কি কাজ দেবে তুমি?’
স্যামকাকা বলতে থাকে, ‘দেখো স্বদেশ, আমি
আমেরিকার ডালাস থেকে আসছি। আমি অমুক কোম্পানীর এইচ. আর। আমাদের গ্রুপ
রিক্রুটমেন্টের একটা অভিনব উপায় বার করেছে। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে, ফোন ট্যাপিংয়ের
মাধ্যমে আমরা ট্যালেন্ট সার্চ করি। তোমার
সাথে চিরশ্রীর কথা চলত, সেসব আমরা ট্যাপ
করে অ্যানালিসিস করেছি। তা থেকে তোমার ট্যালেন্ট স্কোর বার করেছি। তোমাকে অভিনন্দন,
তুমি এতে পাশ করেছ। আমাদের কোম্পানীতে তুমি সিলেক্টেড হয়েছ। তাই স্যাটেলাইটের
মাধ্যমে তোমার অবস্থান খুঁজে বের করেছি আমরা। তোমার ইন্টারভিউ হল এতক্ষণ। খুব ভাল
লাগল তোমার কথা শুনে। তুমি সত্যি কথাকে খুব গুছিয়ে বলতে পার। অপরিচিত লোকের সঙ্গে
তোমার মেশবার ক্ষমতাও খুব ভাল। তাই তোমাকে আমরা আমাদের কোম্পানীর অমুক পোস্ট অফার
করছি। তুমি চাইলে এই কাজ করতে পার।
তারপর একটু থেমে স্যামকাকা বলে, ‘কি যাবে
না? আমি তোমাকে নিয়ে যেতেই তো এসেছি। এসো আমার সাথে। এই বলে স্যামকাকা স্বদেশের
হাতটা টেনে ধরে।
-
কিন্তু এখন... এখন
কোথায় যাবো?’ স্বদেশ ইতস্তত করতে থাকে। চেয়ার ছেড়ে উঠতে চায় না সে। কিন্তু
স্যামকাকা তার হাত ধরে টানতে থাকে ক্রমাগত। আর বলতে থাকে, ‘চল আমার সাথে, কত সুখ
সেখানে। সেখানে কি আর টাকায় মাইনে হয়, হয় ডলারে। সে তুমি গেলেই বুঝবে।
স্বদেশ তবু মানতে চায় না। কি করে সে এভাবে
অন্য দেশে চলে যেতে পারে? এখানে তার মা রয়েছে, বাবা রয়েছে। ওদের একলা ফেলে সে চলে
যায় কি করে? কি করে সে ছেড়ে যাবে এত বন্ধু, এই পরিবেশ। এখানকার আকাশ, বাতাস হঠাৎ
করে যেন খুব আপন মনে হয় স্বদেশের। হোক এখন রাতের আকাশ কালো, তবু যেন তা কালো নয়,
গাঢ় নীল বলে মনে হয় তার। মনে আছে, ছোটবেলায়
সে পড়েছিল, ‘বাদল করেছে, মেঘের রঙ ঘন নীল’। বাবাকে সে তখন জিগ্যেস করেছিল, মেঘের
রঙ ঘন নীল হয় কি করে? বাবা উত্তর দিয়েছিল, ‘হয়ত বাস্তবে তা হয় না। কিন্তু কবির
কল্পনায় তা নীল লাগে’। কবির কল্পনাকে তখন বুঝতে পারেনি স্বদেশ। আজ বোঝে, কবির
কল্পনায় কালো মেঘ, কালো রাতও কত পবিত্র হয়ে উঠতে পারে। রাতের এই মাথা ধরানো ঝিঁ
ঝিঁর ডাক এক লহমায় যেন মধুর তানের মত বাজে তার কানে। সে ভাবতে থাকে, যেখানে আমি বড়
হলাম, শিক্ষা পেলাম সেই দেশে না থেকে আমি বাইরের দেশের জন্য কাজ করব? তাহলে দেশের
বিরুদ্ধে বেইমানি হবে? সে স্যামকাকাকে বলে দিল, না কাকা, আমার যাওয়া হবে না।
এবার
স্যামকাকা কিছুটা কঠোর হল। যেন স্বদেশের মনের কথাগুলো পড়ে নিয়ে সে বলতে লাগল,
‘দেখো স্বদেশ, মানছি তুমি বড়ো হয়েছো এখানেই। শিক্ষা দীক্ষাও পেয়েছো এই দেশেরই
পরিমণ্ডলে। ইঞ্জিনিয়ার হয়েছ তুমি। কিন্তু তার বিনিময়ে সেই দেশ তোমায় কি দিয়েছে?
তোমার কি মূল্যায়ন করেছে তোমার দেশ? প্রথমে তো একটা আউটসোর্সিংয়ের চাকরি। সেখানে
গাধার মত খাটনি, অপমান আর মাস মাইনে সেই তুলনায় কিছুই নয়। আর পরেরটায় তো, ছোঃ। সে
আর না বলাই ভাল। তবুও তুমি এদেরই কাছে পড়ে থাকতে চাও? এত বোকা তুমি?
স্যামকাকার কথায় তক্ষুণি কোন উত্তর জোগাতে
পারল না স্বদেশ। কিছুক্ষণের জন্য সে যেন কিছুটা বিহ্বল হয়ে পড়েছিল। নিজের স্বপক্ষে
আর কোন যুক্তিই সে আনতে পারছিল না। সে কেবল এটা বিশ্বাস করে যে সে তার মেধা শুধু
নিজের দেশের কাজেই লাগাবে। বাইরের দেশ তা থেকে
উপকৃত হবে কেন? কিন্তু তার দেশ কি সেকথা বোঝেনি?
ঠিক
এই সময়েই স্যামকাকা তার হাত ধরে আবার জোরে একটা হ্যাঁচকা টান মারল। স্বদেশ যেতে
চায় না। কিন্তু স্যামকাকাকে সে আটকাতেও পারছে না। টানা-হ্যাঁচড়ার
ফলে ডান হাতটায় বেশ লাগছে তার।
হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে যায় স্বদেশের। দেখে মা
তার ডান হাতটা ধরে টানছে, ‘কি রে, এখনও ঘুম ভাঙল না? ওঠ্, ওঠ্ বলছি’। স্বদেশ
দেখে সে তার পড়ার টেবিলটার ওপরেই মাথা গুঁজে ঘুমিয়ে পড়েছিল। মনে মনে ভাবল, ‘যাক
স্যামকাকা তাহলে আসেনি। আমেরিকায় আর যেতে হবে না তাহলে।
কিন্তু সেই মূহুর্তেই তার চোখ গিয়ে পড়ল
বিশাল বড় হ্যাভারস্যাকটার ওপর। খাটের পাশে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা। মনে পড়ল, কালই
গোছগাছ সব শেষ করে রেখেছিল তার মা। বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে স্বদেশের। তাহলে
স্যামকাকারাই জিতে গেল। পারল না, তার দেশ তাকে যোগ্য সম্মান দিয়ে ধরে রাখতে। কষ্ট
হয় তার, বড্ড কষ্ট...
এমন সময় পাশের ঘর থেকে মা আবার চেঁচায়,
‘কি রে, উঠলি? আমার আর বাবার কিন্তু স্নান করা হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি মুখ চোখ ধুয়েই
নে। তারপর স্নানে যা। সাড়ে ন’টার সময় ফ্লাইট সে খেয়াল আছে?
স্বদেশ ঘড়ির দিকে তাকায়, দেখে ছ’টা বেজে
পাঁচ মিনিট। নাঃ এবার উঠতেই হবে। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিতে হবে। তাকে যে যেতেই হবে
ডালাস, আমেরিকা। সেখানে অপেক্ষা করে আছে মোটা মাইনের চাকরি।