ভারতীয় সাহিত্যিকদের পুরস্কার ত্যাগের
একটা রেওয়াজ দেখা যাচ্ছে। এটা হয়ত ভাল একটা দিক। কারণ আজ ভারতের পরিস্থিতি সত্যিই
উদ্বেগজনক বলে মনে হচ্ছে। সারাটা দেশ জুড়ে শাসকদল যেরকম ন্যক্কারজনকভাবে ধর্মীয়
উন্মাদনা সঞ্চারে পরোক্ষে সাহায্য করে যাচ্ছে তাতে দেশে একটা বড়সড় বিস্ফোরণ না হলে
বোধহয় তারা থামবে না। ভাবা যায়! ভারতের মত দেশের একটা জাতীয় রাজনৈতিক দল, যারা
কিনা শাসনক্ষমতার শীর্ষে, তারা একটা নির্দিষ্ট ধর্মের ধ্বজাধারীদেরই তোল্লা দিয়ে
যাচ্ছে। আর হবে নাই বা কেন? ভোট যে বড় বালাই। দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু। তাই
হিন্দুতোষণের পালে আরো বেশি করে হাওয়া লাগানো চাই। তাতে হয়ত ভোট বাড়বে শাসকের।
কিন্তু এই সাম্প্রদায়িকতার বীজ যে আগামীদিনে আমাদের মত সাধারণ শাসিতদের অক্ষত
রাখতে পারবে, তার নিশ্চয়তা কোথায়? দেশে আগুন জ্বলে উঠলে, মারা যে পড়ব আমরাই।
অন্যদিকে, এই ‘হিন্দু জাগরণ’এর দিনে বলির
পাঁঠা হচ্ছেন, যাঁরা প্রশ্ন করতে পারেন, সর্বপ্রথম তাঁরাই। সে তার নাম কালবার্গই
হোক, কি গোবিন্দ পানসারে। প্রথম ঘা’টাই পড়ল এমন এক জায়গায় যেটা মানুষের স্বাধীনতার
একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ – মতপ্রকাশে স্বাধীনতা। যদি শাসকদলই একটা নির্দিষ্ট
ভাবাদর্শের বশবর্তী হয়, তাহলে কি করে এ দেশে চিন্তার স্বাধীনতা থাকতে পারে? আর যদি
তা নাই থাকে, তবে ভারতকে আর আমরা গণতন্ত্রই বা বলি কি করে? এ যে সংবিধান বিরোধী
কাজ। শাসকদল তো ভারতেরই সরকারকে গঠন করেছে। সরকার গঠন করার আগে তো তারা ঘটা করে
শপথও পাঠ করেছে। কিন্তু তারপরও তারা কি করে দায়িত্বজ্ঞানহীনের মত বন্দুকের গুলিতে
স্বাধীনমত প্রকাশের মুখে কুলুপ এঁটে দিতে পারে? জানি না বাবা, এ কি ধরনের
দ্বিচারিতা!
দুঃখের হলেও একথা সর্বজনস্বীকৃত যে বিশ্ব হিন্দু
পরিষদ কিংবা শিবসেনারা শাসকদলের মদতপুষ্ট এবং তাদেরই গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সাথী। কিন্তু
এইসব সাথীদের অত্যাচারে এদেশে এখন তো সুস্থভাবে টেকা দায় হয়ে পড়েছে। এমনই ভয়ঙ্কর
এবং বিপজ্জনক এই দল যে তারা তাদের সংগঠনের বন্ধু শাসকদলকেও কোন তোয়াক্কা করে না!
তাদের কথা না শোনার ফল কুলকার্নিকে ভুগতে হয়েছে। ভারতের মুখে কালির ছিটে পড়েছে
তাতে। পরিস্থিতি যখন এতটাই ভয়ঙ্কর, তখন আমাদের মত সাধারণ মানুষ যে এদের কাছে কতটা
অসহায় তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে সাধারণ মানুষের কাছে আর যাই থাক না থাক,
ভোটটা আছে – এটাই বাঁচোয়া। কিন্তু যে শিবসেনা তাদের ভাবগত বন্ধু শাসককেও পাত্তা
দেয় না, (কুলকার্নিকাণ্ডে যা প্রমাণিত) তাদের নিয়ন্ত্রণে আনাটাই বোধহয় শাসকদলের
উচিত কাজ হবে। নইলে এ যে একটা ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের জন্ম দিতে চলেছে। এটা ভাববার বিষয়
বৈ কি! এটা প্রতিবাদ করবার বিষয় বৈ কি! আর তাই তো ঠিক সময়ে সাবধান বাণী শোনাচ্ছেন,
সাহিত্যিকরা, কেবলমাত্র এঁদের কাছ থেকেই এই ব্যবহার আশা করা যায়। কারণ আমরা চিন্তা
করতে পারি কালকের কথা, কিন্তু এঁরা যে পারেন আগামী বছরের কথা। তাই দেশের এই
দুর্দিনে এই লেখক/সাহিত্যিকরাই যদি না এগিয়ে আসেন, আমাদের কালো ভবিষ্যতকে চোখে
আঙুল দিয়ে না দেখিয়ে দেন, তাহলে আসবে কারা? এই দৃষ্টিকোণ থেকে এঁদের ব্যবহার
কাঙ্খিত। অতএব এঁদের এই কারণে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট না করাই ভাল। আবার, এই পুরস্কার
ত্যাগের মধ্য দিয়ে এঁরা শুধু এঁদের প্রতিবাদটুকুই করছেন না, বরং দেশের ভবিষ্যত
সম্পর্কে প্রশ্ন করবার একটা অবকাশ এঁরা সাধারণ মানুষের মনে তৈরি করে দিচ্ছেন। এটাই
তো জনগণের প্রকৃত সেবা। লেখককুল আমাদের দৃষ্টি খুলে দিয়েছেন। তাঁরা পথ দেখাচ্ছেন
আমাদের – কোন পথে আমরা চলতে পারি। কিভাবে আমরা শাসকদলের হিন্দু তোষণ আর
ভেদবুদ্ধিতে প্ররোচনার বিরুদ্ধে নিজেদের ঐক্যবদ্ধ করতে পারি। কিভাবে আমরা সমস্ত
রকম অপপ্রচার বুজরুকির মুখোশ খুলে দিতে পারি।
সেই পথ হল একটাই – সম্মিলিত প্রতিবাদ।
তবু লেখকদের যেন আরো একটা দায় থেকে যায়।
আসলে তাঁরা তো লেখক, সাহিত্যিক – তাই তাঁদের কাছ থেকে আমাদের চাওয়াটাও আরো বেশি।
একথা মানি যে, প্রতিবাদ করবার জন্য পুরস্কার ত্যাগ ছাড়া দ্বিতীয় কোন রাস্তাই
তাৎক্ষণিকভাবে তাদের সামনে ছিল না। কিন্তু
পরবর্তীদিনে তাঁরা যেন এই ইস্যুটাকে কেন্দ্র করে কালজয়ী সাহিত্য রচনা করেন। যা ভবিষ্যতে এই ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টির প্রাক্কালেই আমাদের সতর্ক করে
দিতে পারে। মনে রাখতে সাহায্য করে, আজকের দিনগুলির এই বিষময় জ্বালাকে। তবেই
প্রতিবাদ সার্থক হবে। আর আমার মনে হয়, প্রতিবাদের এর চেয়ে শক্তিশালী উপায়, আর এর
থেকে কার্যকরী পন্থাও লেখকদের কাছে আর দ্বিতীয়টি নেই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন