ট্রেনকে ঘিরে রণক্ষেত্র। আর তার জেরে কেউ
কেউ আহত, এমনকি এখন তো শুনছি একজনকে ট্রেন থেকে ফেলেও দেওয়া হয়েছে। শেষের কথাটার
সত্যতা কতখানি জানি না, তবে এহেন ঘটনা দেখে তো আমি স্তম্ভিত। সত্যি কথা বলতে কি
এরকম একটা সাধারণ ঘটনাকে ঘিরে এমনিধারা অসভ্যতামি শুরু হবে তা তো আর সভ্যদেশে বসে
ভাবা যায় না।
এবার আসি আসল ঘটনায়। ঘটনাটা হয়ত আজকের,
কিন্তু এই ঘটনার মূল বীজ মাটিতে ফেলা হয়েছিল আজ থেকে প্রায় বছর পাঁচেক আগে।
তৎকালীন রেলমন্ত্রী শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (যিনি কিনা এখন পশ্চিমবাংলার
‘মা-মাটি-মানুষের’ সরকারের মা) ফলাও করে রেল বাজেটে ঘোষণা করলেন লেডিস
স্পেশাল/মাতৃভূমি লোকাল নামে একধরনের বিচিত্র ট্রেন চালু করা হবে যাতে কোন পুরুষ
যাত্রীই প্রবেশাধিকার পাবে না। এতে হবে কি স্ত্রীলোকদের যাদের এতদিন কেবল মাত্র
দুটো কামরার মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখতে হত, তারা এখন গোটা ট্রেনটায় বসে বসে মায়
শুয়ে শুয়েও দিব্যি যাত্রা করবেন। সত্যি তো, মহিলাদের ট্রেনে করে যেতে কত কষ্ট হয়
না! তাই তো এই ব্যবস্থা। সবাই বলে উঠল ধন্য ধন্য! দুহাত তুলে ভোট দিল তারা
দেবীরূপা থুড়ি মাতৃরূপা ‘মা-মাটি আর মানুষকে। আর দিদিমণি দুহাত তুলে সকলকে
আশীর্বাদ করে বললেন জয়স্তু। বাংলাকে পাঁচ বছরে শ্মশান, মাপ করবেন স্বর্গ বানিয়ে
ছাড়ব।
এখন তো হল মেয়েদের জয়জয়কার। বেড়ালকে, মানে
এই মাতৃভূমিকে এই দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে সযত্নে লালন পালন করে বড় করে তোলা হল। এরপর
দাবী করা হল বেড়াল মেরে ফেলা হবে। কি সাঙ্ঘাতিক কথা একবার ভেবে দেখেছেন? মাতৃভূমিতে
এবার যে ছেলেদের প্রবেশাধিকার দিয়ে দিল। সাধের স্বর্গরাজ্য যে এবার যায় যায়। একে রক্ষা
করা তাই যেকোন বীরাঙ্গনার প্রাথমিক ও পবিত্র
কর্তব্য বলে মনে হতেই পারে। সত্যিই তো, এত বড় অন্যায় কি করে মেনে নেওয়া সম্ভব?
ছেলেদের সাথে কি মেয়েরা যেতে পারে নাকি? চলছে না, চলবে না। একবার উঠুক ছেলেরা,
দেখে নেব। মেয়েরাও কি কম নাকি। তারাও যে পুরুষের থেকে কোন অংশে কম নয় তা তারা
দেখিয়ে দেবেই। ব্যস, শুরু হল যুদ্ধ।
এই হল মোদ্দা ঘটনা। এখন তো হাড়ে হাড়েই টের
পাওয়া গেল পুরুষদের চেয়ে মেয়েরাও কিছু কম নয়। এমনকি নারীর প্রতি সম্মান রাখতে
(পড়ুন বাচ্চার বায়না মেটাতে) নারীগাড়ির প্রস্তাবিত পরিবর্তনও স্থগিত হয়ে গেল। রেল
কর্তৃপক্ষ ভয়ে সরে গেল নাকি মেকি কান্না থামাতে তাদের চুষিকাঠি দিল তা বোঝা গেল
না। তবে যেটা হল তাতে লাই পেল মেয়েরা। মওকা বুঝে এবার তারা দাঁও মারল আরো জোর।
আগের দিন হল, শিয়ালদা মেন লাইনে, এবার হল বনগাঁ লাইনে। রানাঘাট লাইনের মেয়েরা তাদের
দাবী আদায় করে ছেড়েছে। তাই এবার বনগাঁ লাইনের মেয়েরাই বা ছাড়ে কেন? তারা এবার আরো
একদাগ এগিয়ে দাবী করল, নয় বগি মাতৃভূমিতে তাদের বপু আঁটছে না, তাদের দরকার বারো
বগি। কিন্তু চুষিকাঠি এবার আর অত সহজে মিলল না। তাদের দাবী শুনে, না তাদের পাত্তা
দিল রেল, না দিল পুরুষেরা। রাগে-অভিমানে তপ্তা নারী শুরু করে দিল দফায় দফায় অবরোধ।
পুরুষেরা বলল, তুই খালি একা অবরোধ করতে পারিস নাকি, দেখ কেমন আমরাও পারি। ব্যস,
আবার অবরোধ। দুই পক্ষে খণ্ডযুদ্ধ। হায় হায় হায়, এ কি দেশে আমরা বাস করি।
আমি বলি, যারা এই অবরোধগুলো করছেন তারা
একবার হাওড়া লাইনকে দেখে শিখুন। সেখানে হয়ত কিছু কম যাত্রী যাতায়াত করে। কিন্তু সেখানেও
মাতৃভূমি লোকাল আছে। তাতে নির্দিষ্ট কামরায় পুরুষ যাত্রীরা উঠতেই পারে। কিন্তু
নারীগাড়ি রক্ষা করার জন্য সেখানকার যাত্রীদের এমন অসভ্যতা করতে দেখা যায়নি। আরে
বাবা, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই তো যাত্রী, আর যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্যের প্রয়োজনীয়তাটাও
তাই সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এই যুক্তিতে হয়ত ভোটপাখি ধরা পড়বে না। কিন্তু বাস্তব
সত্য এটাই। আর দিকদারী এখানেই
যে যার প্রতি পক্ষপাতিত্ব করা হয়, তারা কিছুতেই যুক্তিকে আমল দেয় না। তারা শুধু
গায়ের জোর ফলায়। এতে কোনদিন ভাল হতে পারে না। সাধারণ নিত্য যাত্রীদের (যারা
সংখ্যায় অনেক বেশি) হয়রানির শিকার হতে হয় মাত্র কয়েকজনের দুর্বিষহ স্বার্থপর
দাবীতে। তাই লেডিস স্পেশাল নিয়ে এই বাঁদরামির প্রতি চূড়ান্ত ধিক্কার জানাই। এই
ট্রেন নিয়ে মেয়েরা যতই চেঁচাক না কেন। একটা লেডিস স্পেশালের জন্য যে কত মানুষের
সেদিন দূর্ভোগ পোয়াতে হল তা বলে বোঝাবার মত নয়। আর তা কখনোও ক্ষমার্হও নয়। আর এই
ধরনের স্বার্থপর শয়তানীকে প্রশ্রয় দিয়ে রেলকর্তারা পূর্বোক্ত বেড়ালকে আরো বড় হতে
দিলেন। মন্ত্রীকে এতে হয়ত খুশি করা গেল। কিন্তু এর ফল আবার যে ভবিষ্যতে মিলবে না
তাই বা কে বলতে পারে?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন