গতকাল একটা ভাল
সিনেমা দেখলাম। মাটি। আজকের দিনের পরিপ্রেক্ষিতে এই সিনেমাটাকে একটা ইতিহাসচর্চারই
সামিল বলে মনে করা যেতে পারে। যদিও সেই হিসেবে ‘ইতিহাসচর্চা’ কথাটা যতটা ভাবগম্ভীর
এবং বস্তুনিষ্ঠ, তার ধারেকাছেও এই সিনেমা যায় না। বরঞ্চ এই ছবি অনেক বেশি
আবেগপ্রবণ। আসল কথা, সিনেমার দাবি তার দর্শকের কাছে আর তাই দর্শকের রুচিকে পাত্তা না
দিলে চলে না। তবে সেদিক থেকে আর পাঁচটা ঝালমুড়ি সিনেমার থেকে এদের কাজ যথেষ্টই এগিয়ে
রয়েছে। ঝালমুড়ির মত দ্রুত মিইয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা এতে দেখিনে।
এবার আসি মূল গল্পটাতে।
গল্পটির কেন্দ্রীয় চরিত্র একজন মহিলার – নাম মেঘলা। সে কলকাতা নিবাসী। কিন্তু তার
পারিবারিক ইতিহাস পড়ে রয়েছে বাংলাদেশের ঢাকা শহরের একদা একটি বনেদী বাড়িতে। ৪০০
বছরের বেশি প্রাচীন ইতিহাস রয়েছে সেখানে। মেঘলা তার ঠাকুমার ব্যক্তিগত রচনা থেকে
সেই ইতিহাস সম্বন্ধে অবগত হয়। সে জানতে পারে, তাদের পরিবারের প্রভূত বৈভব ছিল,
তাদের সম্পদ ছিল অগাধ। তাদের বাড়িতে দুর্গাপুজো হত, সেখানে একটি নাটমন্দির ছিল। ’৪৬ সালের দাঙ্গার সময়কার ভয়াবহ চিত্র না থাকলেও তার কিছু
আঁচ দর্শক পাবেন মেঘলার ঠাকুমার বর্ণনা থেকে। বাইচ প্রতিযোগিতা নিয়ে
হিন্দু-মুসলমান ঝামেলা, ফুটবল প্রতিযোগিতায় মুসলমানের ছেলের দল ভাঙা প্রভৃতি ঘটনা
থেকেই এটা বোঝাবার চেষ্টা করা হয়েছে দ্বিজাতি তত্ত্ব সেকালের মানুষের মনকে কিভাবে
আচ্ছন্ন করে রেখেছিল।
মেঘলা যখন তার
বন্ধুর বিয়েতে এল ঢাকা শহরে, এয়ারপোর্ট থেকে তাকে বন্ধুর বাড়িতে নিয়ে এসেছিলো এক
বিশিষ্ট ভদ্রলোক যার নাম জামিল, লোকের কাছে সে পরিচিত জামিলভাই বলে। মেঘলা যখন দেখলো
তাদের সেই সুপ্রাচীন ঐতিহ্যবাহী বাড়িটায় (যার অস্তিত্ব কেবলমাত্র তার ঠাকুমার
লেখায় এবং তার নিজের কল্পনার বাইরে অবলুপ্ত) আজ অন্যের অবস্থান, তখন সে বড় আঘাত
পেল। সে ভাবতে লাগল তাদের নিজেদের বাড়ি দখল করে আজ অন্য মুসলমান সেখানে ঘাঁটি
গেঁড়েছে। সে আরো আঘাত পেল যখন সে জানল তার সম্প্রতি পরিচিত হওয়া জামিলভাই-ই সেই
বাড়িতে বসবাস করছে। তাদের পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি ত্যাগ, তার ঠাকুমার সম্ভাব্য
হত্যা এবং তাদের ঐ পরিবারের ওপর সমস্ত বঞ্চনা এবং অন্যায়ের কারণস্বরূপ সে ঐ লোকটাকেই
ঠাহর করল। সে লোকটাকে মনে মনে অত্যন্ত ঘৃণা করতে লাগল।
মাটি সিনেমার একটি দৃশ্য |
কিন্তু সত্য তা
বলে না। ইতিহাস পর্যবেক্ষণ আমরা করি ঠিকই, কিন্তু তাতেও থেকে যেতে পারে বিস্তর
গলদ। কারণ ইতিহাস আবেগকে সহ্য করে না। তাই জামিলভাই বলে, ‘আপনার এই দেশটা সম্বন্ধে
একটা ইল্যুশন আছে’। সেই ইল্যুশনকে ঝেড়ে ফেলাই হল এই সিনেমার মূল প্রাণ। যখন কোন
ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে মেঘলা জামিলকে কটূকথা শোনায়, তখন কিন্তু জামিলভাই রাগ করে
না। বরং মেঘলার অন্তঃস্থল থেকে বেরিয়ে আসা রাগটাকে সে যত্ন নিয়ে দেখে এবং
পরিমার্জনা করে দেয় তার দৃষ্টিভঙ্গীর ত্রুটিগুলি।
দর্শকেরা অনেকেই
আছেন, যাদের ইতিহাস কিংবা পারিবারিক ইতিহাস মেঘলার ইতিহাসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
তাদেরও মনে হয়ত মেঘলার মত কোন ইল্যুশন রয়েছে বাংলাদেশ সম্বন্ধে। সেটাকে কাটানোই এই
সিনেমাটার মূল প্রতিপাদ্য। আমার ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গীতে অন্তত তাই মনে হয়েছে। ইতিহাসকে
আবেগ দিয়ে না দেখে সত্যকে সৎপথে দেখবার সাহস দেখিয়েছেন ছবিটির যুগ্ম পরিচালক শৈবাল
বন্দ্যোপাধ্যায় এবং লীনা গঙ্গোপাধ্যায়। এ কারণে তাঁরা দুজনেই ধন্যবাদার্হ।
আমার
ব্যক্তিগতভাবে সর্বশ্রেষ্ঠ লেগেছে আদিল হুসেনের অভিনয় যিনি জামিলভাইয়ের চরিত্রে
ছিলেন। তাঁর ব্যক্তিত্ব, চেহারা, কথাবার্তা – সবকিছুতেই তিনি যেন অন্য সব
অভিনেতাদের থেকে ছাপিয়ে গেছেন, যেমনটা জামিলভাই ছাপিয়ে গেছেন তার কাজের জন্য। তবে
চেহারায় আর চরিত্রের সঙ্গে সবথেকে ভাল মানানসই হয়েছে অপরাজিতা আঢ্যের চরিত্রটি
যিনি কুমুদিনী দেবী অর্থাৎ মেঘলার ঠাকুমার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। বনেদী বংশের
গৃহিণী হিসেবে ওঁর চেহারাটা এককথায় লা-জবাব। মেঘলার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন পাওলি
দাম। তিনিই এই সিনেমার প্রোটাগনিস্ট। সেই দিক থেকে তাঁর চরিত্র অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ। সেই গুরুত্বটা দিয়েই তিনি যথেষ্ট দক্ষতার সাথে অভিনয় করেছেন। মেঘলার
বন্ধু জিনিয়ার চরিত্রে মনামী ঘোষ এবং জামিলের মায়ের চরিত্রে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের
অভিনয় যথেষ্ট প্রশংসার দাবী রাখে। বাকী চরিত্রগুলোও খারাপ নয়।
এই ছবির
গানগুলোও মোটামুটিভাবে উপযুক্ত স্থানেই রয়েছে। তবে প্রার্থনা সঙ্গীত হিসেবে ‘ও
আমার দেশের মাটি’ গানটায় দেখলাম স্কুলের অনেক মেয়েই গানটা গাইছিল না, তারা খেলা
করছিল। এটা একটু হাস্যকর হয়ে গেল। আর অতজন মেয়ে প্রার্থনা সঙ্গীত গাইছে সেখানে
স্পষ্টভাবে কি করে জামিলভাইয়ের গলা শোনা গেল এবং মেঘলার কান্না শোনা গেল, সেটাও
কিন্তু অজ্ঞাত রয়ে গেল। আমার তো মনে হয় ঐ গানটাকে পুরোটা না দিলেই ভাল হত। আর শেষ
বিয়ের গানটাও একটু যেন কৃত্রিম বলেই মনে হল। যেন দর্শকের মনোরঞ্জনের জন্যই
নির্মিত। তাছাড়া জামিলের এক কথায় কিভাবে হিন্দুর ছেলে আর মুসলমানের মেয়ের বিয়ের রফা হল
সেটাও ঠিকমত বোঝা গেল না। গ্রামের লোকের অসন্তোষ কি শুধু একা জামিলভাইয়ের কথাতেই
ঠাণ্ডা হয়ে গেল? প্রতিপত্তিওয়ালা লোকেদের ঝামেলা লাগাতে দেখি, ঝামেলা থামানোটা
কিন্তু সত্যিই কঠিন কাজ।
ভুলত্রুটি সব
জায়গাতেই থাকবে। তবে একথা বলতে দ্বিধা নেই যে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এই ধরনের একটা
ছবি কিন্তু যথেষ্ট মর্যাদার দাবী রাখে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন