আলাপ
কেমন আছেন সনৎ মণ্ডল? প্রশ্নটা জিগ্যেস
করতে গিয়েও থমকে যেতে হল। কারণ, এই প্রশ্নটা এখন ন্যাকামির মত শোনায়, ওর কাছেও আর
আমার নিজের কাছেও। সেই কারণেই আর জিগ্যেস করব না। সামনে দেখা হয়ে গেলেও ওকে এড়িয়ে
চলার চেষ্টা করব আর একান্তই যদি তা না পারি, চোখাচোখি যদি হয়েই যায় তবে
একগাল একটু হেসে চলে যাব আর তারপর মনে মনে বড়জোর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলব।
কিংবা ধরা যাক, যদি কিছু কথা হয়েই যায়,
তাহলেও কখনো জিগ্যেস করব না, আচ্ছা আপনার ছেলেটা তো...। তেমনি ‘বৌদি কেমন আছে’
বলেও কথা বাড়াব না। আর ‘কোথায় চললেন?’ জাতীয় প্রশ্ন? হা ঈশ্বর, ওসব কথা বলতে গিয়েও
যেন আমার মুখে কথা আটকে যায়। আর যদি ভুলবশত জিগ্যেস করেও ফেলি, তাহলেও, জানি, সনৎ
মণ্ডল আমার কথার উত্তর দেবে না। খুব বেশি হলে একগাল হেসে চলে যাবে আর মনে মনে
বলবে, ‘শ্যালাঃ’।
কারণ আমি জানি সনৎ মণ্ডল কেমন আছে। আমি
জানি সনৎ মণ্ডলের ছেলে কেমন আছে। ওর বাড়ির খবরও আমার জানা। তাছাড়া সনৎ মণ্ডল এখন কোথায় চলেছে এবং তার এক ও একমাত্র গন্তব্য এখন
কি তাও আমার অজানা
নয়।
কারণ আমি যে জানি, ওদের পথধর্না আজ নিয়ে
মোট তিরাশি দিন পূর্ণ করল।
ধীর ও মধ্যলয়
(১)
সনৎ মণ্ডলের সাথে আমার বহুদিনের আলাপ।
প্রথমে পাড়ায় খেলতাম, পরে ও আমার সাথেই কলেজে ঢুকেছিল। তিন বছরের বি.এ, দুবছর পড়েই
পড়াশুনা বন্ধক রাখল ভবিষ্যতের কুলুঙ্গিতে আর নেমে পড়ল কাজে। তাতে লাভের লাভ এই হল
বাড়ি বাড়ি কাজ করার হাত থেকে মা রেহাই পেল, আর সে রেহাই পেল পড়াশুনার হাত থেকে।
তারপর থেকে আমাদের মধ্যে বিশেষ একটা সাক্ষাৎ হয়নি। একবার শুনেছিলাম সে কোন একটা
ক্যাটারিং এজেন্সিতে কাজ নিয়েছে, তারপর শুনেছিলাম একটা বিয়ে করেছে, তারপর
শুনেছিলাম সে ক্যাটারিংয়ের কাজ ছেড়ে অন্য কোথাও চাকরি নিয়েছে। তারপর বহুদিন ওর কোন
খবর পাইনি। এখানে থাকত না সে, বাসাবদল করেছিল ওর মা মারা যাবার পর। পরে আবার সে এখানে আসে।
আর এরপরেই একটা
অঘটন ঘটল।
(২)
সনৎ মণ্ডলের
চাকরিটা গেল চলে। গুঞ্জনটা চলছিল আগে থেকেই। কিন্তু হঠাৎ
এভাবে কাউকে তাড়িয়ে দেওয়া বেআইনি। তাই কথাটা সহজে বিশ্বাস করতে পারেনি ওদের কেউই।
গত চোদ্দোটা বছর ওরা যে পত্রিকার হয়ে কাজ করেছে, সেই ভূমিপুত্র পত্রিকাকে কি করে
অবিশ্বাস করবে তারা? সনৎ মণ্ডলের নিজের, তার স্ত্রীর এবং তার একমাত্র ছেলের সমস্ত
ভরণপোষণ তো হয়েছে ভূমিপুত্রের হাত ধরেই। তারা শুনছিল, পত্রিকার অবস্থা খারাপ,
বিক্রিবাটা যথেষ্ট কমেছে। আর নিচু তলার শ্রমিক হওয়ার “অপরাধে” তাদের
পজিশনটাও কিছুটা ঢিলে।
তবুও সে বিশ্বাস করতে পারেনি, বেআইনিভাবে,
কোনরকম পূর্ব নোটিশ ছাড়া তাকে এবং শ্যামলকে এবং রঞ্জিতকে এবং আরো জনা কুড়ি
শ্রমিককে কার্যত মুখের ওপর বলে দেওয়া হবে, ‘বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমাদের বর্তমান নীতি
অনুযায়ী আমরা কিছু কর্মী সংকোচন করছি এবং আপনাদের আর এখানে প্রয়োজন নেই’। কিছুক্ষণ
কথাগুলোর কোন মানে খুঁজে পায়নি ওরা। শ্যামল বলতে গেছিল, কিন্তু হঠাৎ এভাবে...। তার
কথা শেষ করবার আগেই তাকে সরাসরি এইচ আর এ.-এর সাথে যোগাযোগ করতে বলা হল। এইচ.আর.এ
ভদ্রলোক খুব ভাল। খুব
মিষ্টি করে তিনি বললেন, খুব খারাপ লাগছে,
আমরা একটা পরিবারের মত এখানে ছিলাম। কিন্তু কর্ণধারের যা ডিসিশান তা তো মানতেই
হবে। এই বলে তিনি প্রত্যেককে একটা করে চিঠি ধরিয়ে দিলেন যাকে বলে লেটার অফ
টারমিনেশান।
পত্রিকার ঘর থেকে বেরোতেই শ্যামল একেবারে
ফেটে পড়ল। দু অক্ষর থেকে চার অক্ষর হয়ে তার কথাবার্তার কোন মাথামুণ্ডু রইল না।
ভদ্রলোকেরা এসব শুনলে কান চাপা দেবেন নির্ঘাত। সনৎ মণ্ডল বলে, ‘কিন্তু কোম্পানির কি অবস্থা এতই খারাপ যে এতদিন কাজ করবার পরেও আমাদের
এইভাবে তাড়িয়ে দেওয়া হল?’ জিজ্ঞাসাটা ছিল তার সকলেরই উদ্দেশ্যে, শ্যামলই উত্তরটা
দিল, ‘সব শালা ধাপ্পাবাজি! গত কয়েকদিন ধরেই তো শুনছিলাম পুরোনো লোক ছাঁটাই করে নতুন লোক নেবে।
ওনাদের এখন তরতাজা প্রাণ চাই, আমাদের দিয়ে আর চলছে না। তা আমরা কি এবার ঘাস খেয়ে
থাকব? শালাঃ....।’
এখন দুশ্চিন্তা মনের প্রতিটা কোণায় কোণায়
ঢুকে তার সকল সজীবতাকে মৃত করে দিতে চায়। শ্যামল বলল, ‘আমরাও ছাড়ব না। এর শোধ
তুলব’। কিন্তু শোধ তারা তুলবে কি করে? সম্বল কি আছে তাদের? পত্রিকার ঘর থেকে
বেরিয়ে আসার পর একটা চিঠি আর বকেয়া চারমাসের মাইনের সামান্য একটা ভগ্নাংশ বাবদ
হাজার পাঁচেক টাকা বই তো তাদের আর কিছুই নেই। হয়ত এ মাসটা তাতে চলে যাবে, হয়ত এরই
মধ্যে জুটেও যাবে অন্য কোথাও একটা চাকরি, আর তার ফলে হয়ত তাদের একেবারে পথে বসতে
হবে না... ইত্যাদি আরো অনেক অনেক ‘হয়ত’র চিন্তা নিয়ে, সামনে একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
এবং একটা দোদুল্যমান বর্তমানকে সঙ্গে করে তারা অর্থাৎ সনৎ মণ্ডল এবং শ্যামল হাজরা
এবং রঞ্জিত মিস্ত্রী এবং আরো বিশজন শ্রমিক এগিয়ে চলল।
সনৎ মণ্ডলের মনে তখন ভাসছিল তার ছেলের
মুখখানা।
(৩)
দিন পাঁচসাত হল
ছেলেটার জ্বর। প্রথমে
ভেবেছিল সাধারণ সর্দিজ্বর, আপনা থেকেই সেরে যাবে। তাতেও যখন সারেনি, ডাক্তারের
কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সেদিন। ডাক্তার
বেশ কিছু টেস্ট দিয়েছিল। তাতে প্রায় হাজার খানেক টাকার ধাক্কা। শুনেই একটু পিছিয়ে
এসেছে সনৎ মণ্ডল। ‘সব টেস্ট একবারে না করলে হয় না স্যার?’ ডাক্তারকে এ কথা বলতেই
উনি হাত তুলে দেন, ‘তাহলে আমার আর কোন দায়িত্ব নেই। আমি লিখে দিচ্ছি। আপনি
হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিন’। কিন্তু, সরকারী হাসপাতালে পড়ে থাকার চেয়ে আপাতত
বাড়িতে পড়ে থাকাটাকেই শ্রেয় বলে মনে করল সনৎ মণ্ডল। এটা সে কোন খেয়ালের বশে করল তা
জানি না। হয়ত সরকারী হাসপাতালের প্রতি তার এতটুকুও ভক্তি ছিল না। কিংবা হয়ত সে
ছেলের জ্বরের গুরুত্ব বোঝেনি। বা, অন্য কাজের চাপে সময়ও পেল না সে। তবে কল্পনা
কিন্তু সেদিনই বলেছিল, ‘হাসপাতালে ভর্তি করে দিলেই ভাল হত না?’ সনৎ বলল, ‘আর দুদিন
অপেক্ষা কর না।’
যাই হোক,
বাড়িতেই থাকুক আর যেখানেই থাকুক, জ্বর কিন্তু পিছু হটল না। আজ দুপুরবেলা সে আবার
সশরীরে এসে হাজির এবং তাপমাত্রা বাড়তে বাড়তে ছুঁয়ে ফেলল একশো দু ডিগ্রী। কল্পনা আর
থাকতে পারল না। তার ইচ্ছে হল এখনই সে তার বুবুনকে বুকে করে হাসপাতালে ছুটে যায়।
ছেলেকে একবার মাথা ধুইয়ে দিল সে, তারপর আধঘণ্টা ধরে মাথায় জলপট্টি লাগিয়ে চলল।
তারপর প্যারাসিটামল। অবশেষে মিনিট চল্লিশ বাদে স্বল্প ঘাম দেখা দিল।
ছেলেটা রুগ্ন
হয়ে গেছে মারাত্মক। শরীর দুর্বল, মুখে অরুচি, দেখলে মায়া হয়। তবু চিকিৎসাটা ঠিকমত
হচ্ছে না। টেস্টগুলো করা হচ্ছে না। নিজের ভেতরে চূড়ান্ত একটা অস্থিরতা টের পেল
কল্পনা। তার মন উতলা হয়ে পড়ছে, উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছে, তবু কেন যে কথা কানে নিচ্ছে না
সনৎ মণ্ডল! ভাবতেও আশ্চর্য লাগে তার, নিজের ছেলেটাকে কি সে ভালবাসে না? ‘তুমি কি
নিষ্ঠুর!’ এই বলে ওর সাথে একরাশ ঝগড়াই করেছিল সে গতকাল। সনৎ মণ্ডল বলেছিল, ‘আর
একটা দিন দেখো না। এই সময়কার জ্বর এমনিতেই সেরে যায়। আর যদি না সারে তবে টেস্টগুলো
না হয় শনিবার করাবো’। এই
বলে পরিস্থিতি সামাল দিতে গেছিল সে। বলেনি, চার মাসের বকেয়া মাইনেটা যদি কাল পেয়ে
যাই, এর ওর কাছে আর হাত পাততে হবে না। আজ দেব, কাল দেব করে মাইনে দেওয়ার দিন শুধু
পিছিয়েই যাচ্ছে কর্মকর্তারা আর আজ যাব কাল যাব বলে দিন শুধু পিছিয়েই চলেছে সনৎ
মণ্ডল। যদিও কথাগুলো কল্পনা সব জানে না।
কিন্তু আর নয়,
সনৎ রাজী হলে ভাল। নতুবা, কাল সকালেই সে নিজে বুবুনকে নিয়ে যাবে ডায়াগনস্টিক
সেন্টারে। আর কাউকে তার দরকার নেই। দরকার পড়লে ঘরের থেকে সে টাকা নিয়ে যাবে। জিনিসপত্র
বিক্রিবাটা করে হোক, বন্ধক রেখে হোক, যেভাবে হোক টাকা সে আনবেই আর টেস্টগুলো করাতে
যাবেই। মনে মনে সে একেবারে স্থিরপ্রতিজ্ঞ হয়ে নিল। আর তখনই বাড়িতে এসে হাজির হল সনৎ মণ্ডল।
(৪)
সনৎ মণ্ডল সেদিন
ফিরেছিল রোজকার সময়ের কিছু আগেই। অন্যদিন হলে চমকে উঠত কল্পনা। কিন্তু ছেলের জন্য
বেশ কিছুটা উদ্বেগ এবং তার জেরে স্বামীর সঙ্গে গতকাল থেকে তার মনে একটা চাপা
বিরাগ। তাই সে যেন সব দেখেশুনেও কিছু খেয়াল করতে পারল না। কিন্তু সত্যি বলতে গেলে সনৎকে দেখে মনে হচ্ছে
না এই লোকটাই আজ সকালে স্নান খাওয়া করে, চুল পরিপাটি করে আঁচড়ে, সদ্য কাচা
জামাপ্যান্ট পরে এই বাড়ি থেকেই বেরিয়েছিল। সনৎ মণ্ডল এখন কিছুটা ন্যুব্জ –
ক্লান্তির ভারে। সারাটা মুখে তার অবসাদের ছাপ স্পষ্ট, চোখের তলায় অবসন্নতা, মাথার
কয়েকটা পাকা চুল বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে – বয়সটা যেন আরো বছর দশেক বাড়িয়ে তুলেছে।
তবুও সনৎয়ের
হাবভাবে একটা অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ্য করেছিল বৈকি কল্পনা। কিন্তু সে তার দুর্বলতা
প্রকাশ করল না তখনই। কিংবা ভেতরের যথেষ্ট আশঙ্কাটা সে বাইরে প্রকাশ করতে দিল না।
সনৎ মণ্ডল জুতো
খুলে ঘরে এসে হাতলভাঙা চেয়ারটার ওপরে ধপ্ করে বসে পড়ল। হাতের ব্যাগটা ঘরের এককোণে
এমনভাবে ছুঁড়ে দিল যেন ডাস্টবিনে ফেলা হল পরিত্যক্ত আবর্জনা। তারপর শুধু স্থির
দৃষ্টিতে চেয়ে রইল চটা-ওঠা মেঝেটার দিকে। উল্টোদিকে একটা কোণ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে
কল্পনা। হাতের নখ খুঁটছে
আর মাঝে মাঝে আড়চোখে জরিপ করছে সনৎকে আর প্রতীক্ষা করে চলেছে – নিশ্চয়ই কিছু একটা
বলবে সনৎ মণ্ডল। নিস্তব্ধতার মধ্যে সিলিং ফ্যানের একটা ঘস্ঘস্ আওয়াজ তার
বিরক্তিকর লাগে। একসময় তাই ধৈর্যের বাঁধও ভাঙল। সে বলে উঠল, ‘কি হয়েছে তোমার? কথা
বলছ না কেন?’
ওর কথা শুনে সনৎ
যেন হঠাৎ অন্য জগত থেকে নিজের ঘরটায় ফিরে আসে, সে বলে, ‘নাঃ, কিছু না তো!’
কল্পনা একটু
অসহিষ্ণু হয়ে পড়ে, ‘তা কিছু যদি না-ই হবে, তো অমনভাবে বসে আছো কেন?’
এবার ধীরে ধীরে
মুখ তোলে সনৎ মণ্ডল। অসহায়ভাবে কল্পনার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আমার চাকরিটা চলে গেছে
জানো’। যেন হঠাৎ একটা জোর ধাক্কা খেল কল্পনা। সনৎ মণ্ডল বলতে থাকে, ‘বেশ কিছুদিন
ধরেই কানাঘুষো শুনছিলাম। সেল কমে আসছে। কিন্তু এভাবে হঠাৎ করে সব গোলমাল হয়ে যাবে...’। নিজের মনেই কথাগুলো ঠিকমত গুছিয়ে উঠতে পারল না
সনৎ। তারপর অধৈর্যের মত চেয়ার ছেড়ে উঠে জামা গেঞ্জি খুলে সে ছাদে চলে যায়।
কল্পনা কাঠের
পুতুলের মত দাঁড়িয়ে থাকে। এ ঘরে বুবুন জ্বরের ঘোরে ঘুমোচ্ছে, ওদিকে সনৎ এনেছে
দুঃসংবাদ। সে বুঝতে পারে না কোনদিকে তার এখন যাওয়া উচিত। ছেলের গায়ে হাত দিয়ে দেখে
জ্বরটা আগের থেকে বেড়েছে, আবার কিছুক্ষণ জলপট্টি দিতে হবে।
(৫)
ন্যাড়া ছাদের
একটা কিনারায় দাঁড়িয়ে সনৎ মণ্ডল একটা সিগারেট ধরাল। সারাটা আকাশ আজ মেঘে ঢাকা।
চাঁদ তো নেই-ই, একটা তারাও নেই গোটা আকাশে। তবু পূর্ব দিকের একটা কোণ ঘেঁষে ঝিকমিক
করছে একটা নক্ষত্র, খুব উজ্জ্বল। কোন জ্যোতিষ্ক ওটা? সমস্ত মেঘের কালো ভ্রূকুটিকে
উপেক্ষা করে কোন শক্তিতে ওর আলো পৃথিবীর বুকে নেমে আসার সাহস পেল? সনৎ মণ্ডল
তাকিয়ে থাকে ঐ তারাটার দিকে।
গোটা বিশ্বটার
মাঝে তার মনে হতে থাকে কেবল সে আছে, আর আছে ঐ তারাটা। যদি সত্যিই এমনটা হত, তো
খুবই ভাল হত। এত ঝামেলা থাকত না তাহলে। কিন্তু বাস্তব যে তা নয়। সেখানে যে তার
চাকরি নেই, তার কোনো সম্বল নেই। আর কল্পনা এই কথাটাকে কিভাবে নেবে কে জানে? ও কি
ভাববে, তার স্বামী সহায়সম্বলহীন? আর তাই কি তাকে সে অপাংক্তেয় বলে মনে করবে?
সত্যিই তো কোন কাজেই লাগবে না সে এ সংসারে। একটা অপদার্থ লোক মনে হয় তার নিজেকে।
নিজের উদ্দেশ্যে
সে যত পারে ততরকম গালি দিতে থাকে। আর এর সাথে সাথে তার মধ্যে একটা অবসাদমিশ্রিত
ক্ষোভ তৈরি হয়। কিন্তু সেই ক্ষোভটা প্রকাশ করবার কোন জায়গা নেই। সে যে এখানে এখন
একা। সে ভাবে হাইরোডের ধারে চলে গেলে কেমন হয়? আজ এখনই কিছু কিনতে যাবার অছিলায় হাইরোডের
ধারে যদি সে চলে যেতে পারে, যদি সেই সময় সে রাস্তা দিয়ে দ্রুত গতিতে ছুটে আসতে
থাকে একটা লরি, যদি সেই লরির ড্রাইভার গাড়িটাকে হঠাৎ থামাতে না পারে আর সেই সময়ই
দেখতে পায় একটা পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ বছরের ব্যক্তি তারই গাড়ির সামনে এসে পড়েছে, তাহলে
কেউ কি ভাববে না এটা একটা সুইসাইড নয়, অ্যাক্সিডেন্ট মাত্র? আর তাহলেই একমাত্র সনৎ
মণ্ডল বেঁচে যাবে, মরে গিয়ে বাঁচবে সে এই নষ্ট ঘৃণিত পৃথিবীটার হাত থেকে।
এমন সময় সনৎ
মণ্ডল টের পেল তার পাশে কেউ যেন এসে দাঁড়িয়েছে। পাশ ফিরে সে দেখে কল্পনা। আবছা
আলোয় মেশানো অন্ধকারে তাকে স্থির কোন মূর্তি মনে হচ্ছে। কল্পনা ধীরে ধীরে বলে,
‘তুমি বেশি টেনশন কোরো না। কিছু একটা ঠিক হয়ে যাবে। অন্য কোথাও একটা চেষ্টা কোরো।
আর আমিও যদি পারি...’ কল্পনার কথা শেষ হতে না দিয়ে সনৎ বলে ওঠে, ‘তুমি আবার কি
করবে?’ কল্পনা বলে, ‘কেন? আমি কি তোমায় সাহায্য করতে পারি না? ছোট বড় যা হোক কোন
একটা কাজ যদি জোটাতে পারি, যদি তোমার তাতে কিছু সুরাহা হয়’।
কিছুক্ষণ
নিস্তব্ধতা। কল্পনার কথাগুলো সনৎয়ের মনটাকে মথিত করে তোলে। বড় নিশ্চিন্ত লাগে তার।
সে বলে, ‘বুবুনের শরীর কেমন?’ কল্পনা জানায়, ‘আগের মতই আছে। মাঝে মাঝে জ্বর আসছে।
তারপর সে আবারও বলে, ‘তুমি একা একা থেকো না। দরকার হলে আমার বাবার সঙ্গে পরামর্শ
করে নিও। দেখো, কিছু একটা ঠিক হয়ে যাবে’। এই বলে কল্পনা চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ তার
হাতটা টেনে ধরে সনৎ। বলে, ‘তুমি কোথায় যাচ্ছো? এখানেই থাকো না’। সে আবার বলে,
‘একটা কাজ আমি জুটিয়েই ছাড়ব। শুধু সময় লাগবে...। সে ক’টা দিন তুমি ধৈর্য ধরতে
পারবে তো?’ কল্পনা কিছু বলে না। সে সনৎয়ের হাতটাকে নিজের হাতের মধ্যে চেপে ধরে আর
পরম আশ্বাসে সনৎ মণ্ডলের বুক চিরে বেরিয়ে আসে একটা দীর্ঘায়িত শ্বাস।
ঠিক এই সময়ই এল
ফোন। ফোন করেছে শ্যামল হাজরা। এখন শ্যামল? কি ব্যাপার? প্রায় মিনিট দেড়-দুইয়ের
মধ্যে সাড়া হয়ে গেল কথা। জানা গেল, শ্যামল ঠিক করেছে যারা ভূমিপুত্র থেকে ছাঁটাই
হয়েছে তারা কাল তার বাড়িতে আসুক, একটা জমায়েত হোক। তারপর তারা নিজেরাই ঠিক করবে
কিভাবে তারা এগোবে, কিভাবে তারা বিক্ষোভ শুরু করবে। শ্যামলের পরিকল্পনা সনৎয়ের কাছ
থেকে শুনে কল্পনা কোন তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানাল না। খানিকক্ষণ বাদে সে বলে উঠল,
‘বলছি, বুবুনের শরীরটা কিন্তু সত্যিই ভাল ঠেকছে না। ওর টেস্টগুলো এবার না করালেই
নয়’। সনৎ বলে, ‘বেশ তো, যা কিছু টাকা হাতে এসেছে তা দিয়েই না হয় কাল ডায়াগনস্টিক
সেন্টারে নিয়ে যাব।’ তারপর কিছুক্ষণ থেমে সনৎ জিগ্যেস করে, ‘আর তোমার যে মাঝে মাঝে
মাথা ঘোরে, সেটা কেমন আছে?’ কল্পনা জানায়, ওসব নিয়ে ভাবতে হবে না। আমি ভাল আছি’।
সনৎ ওর কথাগুলোই শোনে, কিন্তু ওর চাপা কান্নাটা টের পায় না সে। অন্ধকারে চাপা পড়ে
যায় কল্পনার না-বলা কথাগুলো।
এমন সময় টিপ টাপ
করতে করতে, বেশ জোরে নেমে এল বৃষ্টি। সনৎ বলে, চল চল, তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকি’। কিন্তু
কল্পনা যেতে চায় না। সে বলে, ‘অনেকদিন তো ভিজিনি। আজ একটু ভিজি’।
ঠিক এমন সময়
বুবুনের ডাক শুনতে পেল ওরা। ছেলে তো ঘুমিয়েই ছিল। তবে হঠাৎ কি কোন সমস্যা হল?
বৃষ্টিতে ভেজা হল না। তড়িঘড়ি ছাদ নেমে গেল কল্পনা আর সনৎ মণ্ডল। বৃষ্টি শুধু
ছাদটাকেই ভেজাতে লাগল।
দ্রুতলয়
এরপর কেটে গেছে
আরো দিন তিনেক। সনৎ মণ্ডল সেদিন অনামিকা হাসপাতালের সামনে একটা গোল্ডফ্লেক ধরিয়ে
ইতস্তত পায়চারী করছিল। বলে নেওয়া ভাল, এই তিনদিনে বেশ কিছু পরিবর্তন হয়েছে। এই
যেমন শ্যামল হাজরার বাড়িতে বসে তারা ঠিক করেছিল যে ভূমিপুত্রর বিরুদ্ধে তারা
রাস্তায় ধর্না দেবে। একটা মঞ্চ তৈরি করে সেখানে বিক্ষোভ জানাবে এবং দরকার পড়লে
অনশনও করবে তারা। সোৎসাহে যোগ দিয়েছিল সনৎ মণ্ডল। সে হয়ত ভেবেছিল দেখাই যাক না
ভূমিপুত্র তাদের বিক্ষোভের জেরে পিছু হটে কিনা। কিংবা চাকরি না দিক, বকেয়া
টাকাটুকু অন্তত মেটাক ওরা। আর বিক্ষোভে একান্তই যদি কাজ না হয়, তখন একটা অন্য কিছু
না হয় করা যাবে।
কিন্তু সনৎ
মণ্ডল আজ ধর্নায় যেতে পারেনি। কথার খেলাপ? নাঃ, আসলে যাবেই বা কিভাবে? একজন বাবা
কিভাবে তার মুমূর্ষু সন্তানকে বাড়িতে রেখে অন্য কাজে যেতে পারে? ছেলের জ্বর কমবার
কোন লক্ষণই দেখা যায় নি। টেস্ট রিপোর্ট দেখে স্থানীয় ডাক্তার এবার ‘অবস্থা
ক্রিটিকাল’ বলে হাত তুলে দিয়েছে। অগত্যা হাসপাতাল। আজ অবস্থা এতটাই সংকটজনক যে
কিছুতেই স্থির থাকতে পারছে না সনৎ আর কল্পনা। তার পাঁচ বছরের ছোট্ট ছেলেটার আজ
মাল্টি অর্গান ফেলিওর। জ্বরের প্রকোপে সঠিক চিকিৎসার অভাবে শরীর ক্ষয়ে যেতে যেতে
একের পর এক অঙ্গ নষ্ট হয়ে গেছে। তাই এখন ডায়ালিসিস চলছে তার।
সনৎ মণ্ডলের
সিগারেটটা মুখে ঢোকে না বিশেষ, হাতেই পুড়তে থাকে। তবু তার খেয়াল আসে না। অথবা
হাতটাকে সিগারেটের ছ্যাঁকায় পোড়াতে তার খুব ভাল লাগে। সে তো অন্যায় করেছে,
ছেলেটাকে দীর্ঘদিন বাড়িতে ফেলে রেখে, মেডিকেল টেস্ট না করে কি দোষ করেনি সে?
কিভাবে নিজেকে সান্ত্বনা দেবে? এখন সমস্ত হাতটা পুড়ে গেলেও যে তার মন শান্ত হবে
না।
এমন সময় খেয়াল
আসে পাশের দোকানটা। একটা ছোট দোকান। মূলত চাকরি বাকরির পরীক্ষার বই, ম্যাগাজিন
ইত্যাদি রয়েছে সেখানে। ধোপদুরস্ত প্যান্ট শার্ট পড়া একটা ভদ্রলোক তার ভুঁড়ির পেছন
পেছন এসে ভূমিপুত্র পত্রিকার একটা কপি চাইল। লোকটা বোধহয় দোকানীর পরিচিত।
পত্রিকাটা কিনতে কিনতে সে একথা সেকথা বলতে বলতে হঠাৎ প্রশ্ন করে বসল, ‘তা চলছে
কেমন ভূমিপুত্র? শুনছি নাকি মার্কেট এখন ডাউন?’
দোকানী তার পানে
লাল করা দাঁত বের করে জানাল, ‘না না, দারুণ চলছে। এই দেখুন না, বিশ কপি এনেছিলাম,
এক্কেবারে শেষ। এইটেই শেষ কপি ছিল। তাও আপনারই জন্য রেখে দিয়েছিলাম। না হলে আরো
দুজন চেয়ে ফিরে গেছে’।
লোকটা বলল, ‘তা
আর হবে না, টপিক কি দিয়েছে দেখতে হবে তো? ভূমিপুত্র বলে কথা! কতদিনকার পত্রিকা! এ
যদি ডুবে যায়, তবে বঙ্গ সংস্কৃতিই একেবারে অচল...’ লোকটা আরো কিছু বলছিল। কিন্তু
সনৎ আর সেদিকে মনোযোগ দিতে পারল না।
সে হঠাৎ দেখল
কল্পনা এগিয়ে আসছে হাসপাতালের গেটের দিকে। সে নিজে তড়িঘড়ি ওর কাছে এগিয়ে যেতেই
দেখল, কল্পনার চোখ দুটো ভয়ানক উদ্ভ্রান্তের মত লাগছে। মুখ পুরো ফ্যাকাসে হয়ে
গেছে। সনৎ কিছু বলতে যাবে, তার আগেই একটা তীব্র আর্ত চিৎকারে সে ভেঙে পড়ল সনতের
বুকের ওপরে। তারপর লুটিয়ে পড়তে লাগল মেঝেতে। সনতেরও তখন আর তাকে তোলার ক্ষমতা নেই।
কল্পনার চোখ মুখের ইশারাতেই সে বুঝে নিয়েছে তার ছোট্ট সোনা বুবুন আর নেই।
কিন্তু সনৎ কল্পনাকে
জোর করে তুলল না। কল্পনা চিৎকার করে কাঁদছে, আর বলছে, ‘কোথায় গেল আমার ছেলে, কোথায়
গেল? তবু তাকে কোনরকম সান্ত্বনা দিল না সে। ছুটে চলে গেল ঐ ভদ্রলোকের কাছে যে
লোকটা এইমাত্র ভূমিপুত্রের একটা কপি কিনল। তার হাত থেকে ছিনিয়ে নিল সে কপিটা। পত্রিকার প্রচ্ছদ পুরো লাল রঙের। স্কেচে আঁকা
মার্ক্সের একটা ছবি রয়েছে তাতে। ওপরে বড় বড় হরফে লেখা – গরীবের মার্ক্স।
টুকরো টুকরো করে
ছিঁড়ে ফেলল সনৎ ঐ পত্রিকার প্রচ্ছদটা। লালরঙা পাতার টুকরোগুলো ছড়িয়ে পড়তে লাগল
সারাটা রাস্তা জুড়ে। শুধু ঐ ভদ্রলোক নয়, রাস্তার প্রায় সবাই অবাক বিস্ময়ে দেখল
সনতের এই পাগলামি। সনৎ কেন হঠাৎ এমন আচরণ করল, তারা কেউই বুঝতে পারল না। বুঝতে
পারল শুধু কল্পনা। রাস্তার ওপরে আধবসা অবস্থায় কিছু দূর থেকে একমাত্র সে-ই দেখতে
পেল, লাল প্রচ্ছদের টুকরো নয়, তার সামনের রাস্তাটা শত শত হিংস্র আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত
রক্তাক্ত হয়ে পড়ে রয়েছে।
: সমাপ্ত :
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন