নতুন দিল্লীর গত কয়েকদিন আগে যে তিনজন
শিশু অনাহারে মারা গেল, তাদের দায়িত্ব নেবে কে, এ নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন উঠছে। এখন
কথা হল, আমরা যারা সামাজিক প্রাণী তারা কিন্তু আমাদের সামাজিকতার দায়টা কোনভাবেই
এড়িয়ে যেতে পারি না। হ্যাঁ, মানছি দিল্লী বিধানসভা কেন্দ্র থেকে মঙ্গল সিংয়ের
বাড়ির দূরত্ব ১০কিমির বেশি নয়। কিন্তু তাই বলে তিনজন শিশু অনাহারে মারা যাবে এটাকে
তার পারিপার্শ্বিক সমাজ কিভাবে বরদাস্ত করতে পারে? নিজের দায় কিভাবে ঝেড়ে ফেলতে
পারে সে?
রিপোর্টে জানা যাচ্ছে, গত আটদিন ধরে তিনটি
শিশুই অভুক্ত অবস্থায় পড়েছিল। তাদের ডায়রিয়া হওয়ার কারণে তাদের মা তাদের কিছুই
খেতে দেয়নি। পেশায় রিক্সাচালক তার বাবার রিকশা চুরি যাওয়ায় এক অর্থে আয়ের সংস্থান
ছিল না। কিন্তু বাবা মঙ্গল সিংয়ের ছিল মদের নেশা। ফলে এটা হতেও পারে যে মদ খাওয়ার
পয়সা রাখতে বাবা মেয়েগুলোর দিকে ফিরেও তাকায়নি। মনে রাখতে হবে, তিনটি শিশু মারা
যাবার পর থেকে বাবা কিন্তু বেপাত্তা। ফলে বাবার চরিত্র এখানে সম্পূর্ণরূপে
দোষমুক্ত কিনা এ ব্যাপারে আমাদের সন্দেহ থেকেই যায়। তবুও বলব, দুবার পোস্টমর্টেম
করেও যখন তিনটি শিশুর পেটেই দানাপানির কোন সন্ধান পাওয়া গেল না তখন কি তাদের কথা
ভাববার মত কারুরই সময় কিংবা সুযোগ হয়ে ওঠেনি? ওরা তো থাকত বস্তিতে, আর সেখানে তো
দুটো বাড়ির মধ্যে দূরত্ব বিস্তর নয়? ফলে আমার মনে হয় সমাজেরও কিছু অপূর্ণ দায়
এখানে রয়েই গেল।
তৃতীয়ত এখন যেটা ভাবা হচ্ছে, শিশু তিনটির
বাবা গত সোমবার গরম জলের সাথে তাদের এমন কিছু ওষুধ খাইয়েছিল যাতে তারা অসুস্থ হয়ে
পড়ে। বড়মেয়ে মানসী স্কুলে গেলে সে সেখানেও মিড ডে মিল খেতে অস্বীকার করে। এটাও
কিন্তু যথেষ্ট উদ্বেগজনক ব্যাপার। জানা গেছে, বড় মেয়ের অ্যাকাউন্টে ১৮০০৳ ছিল। তারপরেও কেন
তাদের অভুক্ত থাকতে হল? আর তাছাড়া এত কিছুর পরেও বাবা কি করছিল? মায়ের না হয়, বোঝা
গেল, মানসিক রোগ আছে। কিন্তু বাবা কিভাবে তার দায়িত্ব ভুলতে পারল এবং আশ্চর্যজনক
ভাবে মেয়েদের মৃত্যুর সময়ে সে নিখোঁজ হয়ে গেল? আশা করি, দিল্লী পুলিশ এ ব্যাপারে
যথাসাধ্য তদন্ত চালাবে।
কিন্তু এটাও অস্বীকার করবার কোন উপায় নেই
যে, দেশে নয় নয় করে বেশ কয়েকটা অনাহারে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে গেল। এই সেদিন যেমন ঘটল
ঝাড়খণ্ডে। মীনা মুশার এবং সাবিত্রী দেবী দুজনেই মারা গেল অনাহারে। সাবিত্রী দেবীর রেশন
কার্ড ছিল না, পেনশন কার্ডও ছিল না। ফলে তাকে মরতে হল অনাহারে। আমাদের দেশে এমন
হাস্যকর শোচনীয় ঘটনাও ঘটে। মনে রাখতে হবে, ২০০০ সালে এই ঝাড়খণ্ড রাজ্যটাকে সৃষ্টিই
করা হয়েছিল এর দারিদ্র্য এবং অনুন্নত অবস্থাকে ইস্যু করে। সুতরাং সেই রাজ্য
সৃষ্টির ১৮ বছর পরে অনাহারে মৃত্যুর ঘটনা যথেষ্টই ভয়াবহ। কিন্তু আমি বলব, আমরা
যারা সমাজে বাস করি, সেই সকল সাধারণ মানুষও, যারা অনাহারে রয়েছে তাদের পাশে সদিচ্ছা
নিয়ে এগোতে পারি। পারি না?
মনে করুন, আমি দেখলাম আমার পাশের বাড়ির
লোকটা না খেয়ে আছে বেশ কিছুদিন। আমি নিজে একা না হোক, পাড়া থেকে চাঁদা তুলে তার
গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করে দিতে পারি। কিংবা কোন এনজিও সংস্থাও সেই কাজটা করতে
পারে। আর এটা তো আমাদের সামাজিক দায়িত্বও বটে। একটা মানুষ দীর্ঘদিন ধরে অনাহারে
ভুগে মরে যাবে আর পাশের লোক হিসেবে আমি সেটা সহ্য করে যাব আর মুখে বুলি ঝেড়ে যাব,
সরকার কিছু করছে না? হ্যাঁ, মানছি, সরকারের দায়িত্ব এখানে সিংহভাগ রয়েছে। কারণ
তারা আমাদের রক্ষা করবার জন্য, আমাদের পরিসেবা ঠিকমত দেওয়ার জন্য আমাদের কাছ থেকে
কর নিচ্ছে। কিন্তু তাই বলে প্রাথমিক ভাবে আমাদের সামাজিক কাজটা করতে বাধা কোথায়?
আমাদের দেশে কেন শুধু রাজনৈতিক তরজা চলে, কাজের কাজ করবার মত লোক পাওয়া যায় না
সেটাই শুধু বোঝা যায় না। দুঃখটা এখানেই।