“‘চয়নকে পাওয়া যাচ্ছে না, কেউ কি জানো ছেলেটা কোথায় গেল?’ মিলনার
প্রশ্নে সকলেই হতবাক। ‘এই তো কালই ও তোমাদের বাড়িতে কত
কাজ করল। তারপর কি হল, কোথায় গেল?’ পাড়াপড়শির মুখে এক কথা শুনতে শুনতে মিলনা একেবারে অস্থির। এদের কাজই এই,
শুধু প্রশ্ন আর প্রশ্ন, অথচ ছেলেটা যে
কোথায় গেল তার খোঁজ কারুর কাছেই পাওয়া যায় না। হন্যে হয়ে ঘুরতে থাকে মিলনা গ্রামের
আঁকাবাঁকা পথ ধরে, কাঁচামাটির রাস্তায় খালি পায়ে হাঁটতে
হাঁটতে বাতের ব্যথা শুরু হয়। সে আর বেশী এগোয় না। একবার জোরে শুধু চেঁচিয়ে ডাকে,
‘চয়-য়-য়-ন এ-এ-এ চয়-য়-য়-ন। কোথায় গেলি বাপ?’ মিলনার মোটা ফাটা গলার আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ে বিস্তীর্ণ মাঠ ধরে দূর হতে
দূরান্তরে। কিন্তু তবু সে পায় না কোন সাড়া।
খানিক খোঁজার পরও যখন চয়নকে পাওয়া গেল না মিলনাকে ফিরে আসতে
হল শূন্য হাতেই। চয়নের এই ব্যবহারে মনে মনে সে একটু ক্ষুণ্ণই হয়েছিল। তাদের বাড়িতে
এত বড় একটা অনুষ্ঠান, অথচ শেষবেলাতেই তার পাত্তা নেই? এটা সে মানতে পারে না
কিছুতেই। তার মনে একদিকে তাই দুঃখ, তেমনি অন্যদিকে আনন্দও বটে। আনন্দ কেন? বাঃ,
হবে না? আজ যে তার একমাত্র মেয়ে রূপার বিয়ে। একটু ভুল করলাম, বিয়ে ছিল কাল। আজ সে
যাবে শ্বশুরবাড়ি। সোদপুরে ওদের একটা ফ্ল্যাট আছে। আপাতত সেখানেই উঠবে তারা। তাদের
স্থায়ী ঠিকানা অবশ্য মুম্বাই। বর ইণ্ডিয়ান অয়েলের ইঞ্জিনিয়ার। প্রচুর মাইনে তার।
অর্থাৎ পাত্র যে খুব ভাল হয়েছে সে কথা বললেও খুব কম বলা হয়। এ গ্রামে এমন পাত্র
কস্মিনকালেও কারুর জুটেছে নাকি? একে তো এ এক অজ পাড়া গাঁ। তায় আবার রূপার বাবা
সামান্য ছুতোরের কাজ করে। মা সাধারণ গৃহবধূ। দুই দাদার একজন প্রাইমারি স্কুলে
ছাত্র পেটায়, থুড়ি পড়ায়। আর আরেকজন বাবার সাথে হাতুড়ি ঠোকে। এদের ঘরের মেয়ে বিয়ে
করে যাবে মুম্বাই? এখানে তো ভাল ছেলে মেলাই ভার। তবে রূপার ভাগ্যে সত্যিই হয়ত শিকে
ছিঁড়ত না, যদি না মাঝখান থেকে তার এক কাকা এসে পড়ত। তো সেই কাকার অফিসের এক কলিগের
সাথে রূপার না জানি কি করে দেখা হয়ে যায়। ঘটনাক্রমে সেই ভদ্রলোকও তাঁর ছেলের জন্য
পাত্রী খুঁজছিলেন। ব্যস, দেখামাত্র রূপার রূপে তিনি গেলেন মজে। একেই বলে প্রজাপতির
নির্বন্ধ।
তবু পাত্র যতই ভাল হোক আর যতই থাকুক সম্পত্তি, মেয়ের এই চলে
যাওয়ার সময়টা সব মায়ের কাছেই বড় দুঃখের। চোখের জল আর তখন বাঁধ মানে না। রূপার
অবস্থাও ওর মায়ের মতই। চোখের জলে কাজল, লিপস্টিক সব ধুয়ে সারাটা মুখে মাখামাখি।
ধরা ধরা গলায় মিলনা বলে, ‘কাঁদিস না মা, কালই তো যাব। অমন করে কাঁদতে নেই’। বাবা
দাঁড়িয়েছিল পিছন ঘুরে। রূপা তাকে ডাকতেই সে এদিকে ফিরে রূপাকে বুকে জড়িয়ে ধরে।
দুজনার মধ্যে কোন কথা হয় না; সবটাই বলে অশ্রু।
খানিকবাদে বেরিয়ে আসার সময় রূপা একটু উদ্বিগ্ন হয়ে মাকে
জিগ্যেস করে, ‘আছা, চয়ন কোথায় মা? ওকে তো দেখছি না?’ মাও ততোধিক চিন্তিত গলায় বলে,
‘কি জানি, আমিও তো কত খুঁজলাম ওকে। পেলামই না। কাল সারাদিন, সারারাত কাজ করে কোথায়
যে গেল, কে জানে’। রূপা অবাক হয়ে যায়, তারপর হতাশার শ্বাস ফেলে বাইরের দিকে তাকায়।
পাড়ার সমস্ত লোক এসে ভিড় করেছে। ছোট্ট ঘরেতে আর তিলধারণের
জায়গাও নেই। বাইরের ঘরে, বারান্দায়, উঠোনে – সর্বত্র লোক একেবারে গিজগিজ করছে। মাঠের
কাজ পর্যন্ত বন্ধ রেখে সব ছুটে এসেছে গাড়ি দেখতে, বড়লোক জামাই দেখতে। সুদর্শন যুবক
নব্যেন্দু, চেহারাটায় আভিজাত্যের ছাপ। তার হাত ধরে আই টুয়েন্টিতে উঠে বসে রূপা।
গাড়িতে বসে রূপা হাত নাড়ায় একবার। তারপর গাড়ির দরজা ‘ধপ’ করে বন্ধ হতেই গাড়ি দিল
দে ছুট। কাঁচাপাকা রাস্তা ধরে এগোতে থাকে, বাতাস ছোটে সোঁ সোঁ। দুধারে বিস্তীর্ণ
ধানী জমি, গাছপালা, বনবাদাড়, পুকুর, খাল, বিল, ছোট নদী, ঘুঁটে দিতে থাকা মেয়ে,
কাস্তে হাতে চাষী, বিড়ি টানা দোকানী – সবাই অবাক পানে তাকিয়ে থাকে গাড়িটার দিকে, আর
গাড়ির ভেতর থাকা তাদেরই ঘরের মেয়ে রূপার সৌভাগ্যের দিকে।
তবে রাস্তার পাশে ঐ যে একটা জঙ্গল দেখছেন, ওর সামনেই একটা
অশ্বত্থ গাছ। তার আড়ালে দাঁড়িয়ে বাইশ-তেইশ বছরের একটা ছেলে। রোগা পাতলা বেঁটেখাটো
চেহারা। তার বড্ড রাগ ধরে এই গাড়িটাকে দেখে। শুধু এই গাড়িটাই নয়, সমস্ত
সম্পদ-সম্পত্তি, টাকা-পয়সা – সবকিছুর উপর তার বিবমিষা আসে। আর যখন গাড়িটা ধীরে ধীরে তার দৃষ্টিপথের বাইরে চলে
যায়, হঠাৎই ঝাপসা হয়ে আসে তার চোখ দুটো। অশ্রু আর বাঁধ মানে না। যেন দুঃসহ
কোন কষ্ট সে সহ্য করে চলেছে। অথচ কেউ নেই তার। কেউ তাকে দেখে না, সবাই দেখে ঐ বড়োলোকি
গাড়ি।
এর ঠিক একবছর পর ম্যারেজ অ্যানিভার্সারিতে রূপারা ওদের
সোদপুরের ফ্ল্যাটে উঠেছিল। বছরের বেশীরভাগ সময়ই যেটা ফাঁকা পড়ে থাকে। সেবার তারা
গ্রামে যাওয়ার সময় পায়নি, কারণ নব্যেন্দুর ছুটি ছিল না। তাই রূপার মা-বাবাই
সোদপুরে গেছিল। মেঝেতে টাইলস, বাথরুম-রান্নাঘরে মার্বেল দেখে মিলনা তো হতবাক। তার
মনে পড়ে রূপার বিয়ের আগে ওর বাবা ঘরের মেঝে পাকা করেছিল, তাই দেখেই পাড়ার লোকেরা
বলত, করেছ কি হে প্যালার বাপ! একেবারে বড়লোক হয়ে গেলে যে!’ সেসব কথা শুনে নিজেদের
বেশ বড়লোক মনে করেছিল মিলনা। কিন্তু তার তো ধারণাতেই ছিল না যে কোন বাড়িতে এত বড়
বড় ঘর, টিভি, ফ্রিজ, কম্পিউটার এসবও থাকতে পারে। মিলনা তাই অবাক হয়ে যায়। সে আরও
অবাক হয় যখন সে লক্ষ্য করে বাড়িঘরের সাথে সাথে তাদের রূপাও অনেক বদলে গেছে। ওর
কাজেকর্মে, চলনে-বলনে একটা বেশ করিৎকর্মা ভাব এসেছে। যেন তাদের সেই রূপা আর নেই।
রূপার একটা কথা মিলনার কানে বেশ বাজে, যখন মেয়ে তাকে বলে, ‘কিচেনটা বেশ বড় তাই
না?’ ‘কিচেন?’ হায় রে! এই মেয়েই কিনা আট বছর পর্যন্ত রান্নাঘরকে ‘আন্নাঘর’ বলত।
তারপরে রান্নাঘর বলতে শিখলেও মাঝেমাঝে ইচ্ছে করেই পুরনো অভ্যাস সে বদলাত না। ছোটবেলাকার
ভুল ইচ্ছা করেই করত আর তারপরেই সে খিলখিল করে হেসে উঠত।
‘কি ভাবছ, মা?’ রূপার প্রশ্ন। মিলনা তার দিকে তাকিয়ে স্নেহের
হাসি হেসে বলে, ‘কিছু না সোনা, তোর এই ঘর ভাল লেগেছে, এতেই আমার শান্তি’।
সেদিনটা কাটল বেশ মজায়। ভিডিও ক্যামেরায় বাড়ির সকলের ছবি তোলা
হল। রূপার বাবা কি মিলনার কেউই বুঝতে পারছিল না, ভিডিও কিভাবে হচ্ছে। তারপর এল ই
ডি কম্পিউটারে যখন ভিডিওটা দেখানো হল, মিলনা তো বিস্ময়ে হতবাক। মেয়েকে আস্তে করে
সে জিগ্যেস করে, ‘আমাদের ছবি টিভিতে দেখাচ্ছে কি করে রে?’ রূপা হাসি চাপতে পারে
না। মাকে সে বুঝিয়ে দেয়, ‘মা! এটা টিভি নয়, কম্পিউটার। আমাদের ছবি ভিডিও করা হল
তো, এখন কম্পিউটারে দেখাচ্ছে’। মিলনা খানিকক্ষণ বোঝার চেষ্টা করে বলে, ‘অ,
কম্পিউটার। ওই একই হল, একরকমই তো দেখতে সব’। মিলনার কথায় সবাই হেসে ওঠে জোরে। শুধু
একজন ছাড়া, সে হল নব্যেন্দুর বাবা। কি করেই বা সে হাসে? সে যে ইতিমধ্যেই নাক ডাকতে
শুরু করেছে। বড্ড ঘুমকাতুরে কিনা।
দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর বাড়ির সকলে তখন একটু তন্দ্রামগ্ন,
রূপা আর মিলনার সেটাই সময় নিজের মত করে একটু গল্প করার। নিজের বাড়ির কথা, গ্রামের
কথা শুনতে শুনতে আবার সে ফিরে যায় সেই সে পুরনো দিনে। যেখানে ছিল তার ছোটবেলা, তার
বন্ধুবান্ধব, তার পাড়া-প্রতিবেশী। সে জিগ্যেস করে, ‘আচ্ছা মা, চয়ন আর আসে? ওর সাথে
তো দেখাই হল না আর?’
মিলনা ঠোঁট উল্টে বলে, ‘কোথায় আর আসে? তোর বিয়ের পর থেকেই তো
একেবারে ডুমুরের ফুল হয়ে গেছে। কিছু বলতে গেলেই বলে, এখন সময় নেই। এমন ভাব করে যেন
আমরা পর।
-‘তোমরা ওকে বকাঝকা করো নি তো?’
-‘কই না তো? আর আমাদের বকাই যেন শুনছে! দেখতিস তো, কাউকে
পাত্তা দিত? কারুর কথা গায়ে মাখত? কিন্তু এখন দেখলে বুঝবি, ও একেবারে বদলে গেছে।
বাড়িতে একাএকাই থাকে, কারুর সাথে আর তেমন মেশে না, কথা বলে না’।
-ভারী অদ্ভুত তো?’
‘কে অদ্ভুত?’ পিছন থেকে কে যেন বলে ওঠে। রূপা চমকে উঠে পিছনে
তাকিয়ে দেখে নব্যেন্দু। তারপর সে আবার বলে, ‘অনুপ্রবেশের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী’।
-‘আরে ধুর! এস। ঘুম হল না?’ মিলনা জানতে চায়। ঠোঁট উল্টে মাথা
নাড়িয়ে নব্যেন্দু বুঝিয়ে দেয় দুপুরে ঘুমোনো তার স্বভাব নয়। তারপর সে বলে, ‘কার কথা
হচ্ছিল?’
রূপা বলে, ‘ঐ আমার একটা বন্ধুর কথা, চয়ন। তোমায় বলেওছিলাম ওর
কথা’।
নব্যেন্দু ভুরু কুঁচকে জিগ্যেস করে, ‘কে বলতো? নামটা শোনা
শোনা লাগছে।’
রূপা বলতে থাকে চয়নের কথা। ছোটবেলায় মেয়েলি স্বভাবের জন্য
লোকে যাকে ‘লেডিস চিনি’ বলে ডাকত। ভারী লাজুক। যখন ওর সাথে রূপার পরিচয় হয় তখন সে তিনে পা দিয়েছে, আর
রূপা সাড়ে চার। বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে সে ডাকত, ‘লুপাদিদি, এ লুপাদিদি। খেলতে আবি
না?’ ‘লুপাদিদি’ বাড়ি থেকে বেরোলে দুজনে দিত দে ছুট। বিস্তীর্ণ মাঠ ধরে, আল বেয়ে
দৌড়ত তারা, তারপর খুনসুটি করত, মারামারি করত। আবার পড়ে গিয়ে একজনের কেটেছড়ে গেলে
অন্যজন ধুয়ে দিত বোসেদের পুকুরের জলে কিংবা গাঁদা পাতার রস লাগিয়ে দিত কাটা
জায়গায়। বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হয়ে যেত ছ’টা কি সাড়ে ছ’টা। ওরা শুনতে পেত, চয়নের মায়ের
গলা, ‘চনু, অ্যা চনু। শীগগির ঘরে আয়। নয়ত আজ তোরই একদিন কি আমারই একদিন। বলেচি না, পাখিরা বাড়ি ফেরার আগে ঘরে ডুকবি?
কথা কানে যায় না বুঝি? ডাঁড়া, তোর হচ্চে’।
আর ছিল পুতুল খেলা। সে খেলাতেই কেটে যেত দিনের প্রায় অর্ধেক।
পুতুলকে স্নান করানো, খেতে দেওয়া, ঘুম পাড়ানো – কাজ কি আর একটা! ‘ওঃ, এই ছেলেটাকে
নিয়ে আর পারা যায় না’। বড়দের মত করে চয়নকে শাসন করত রূপা। তারপর পুতুল ঘুমিয়ে পড়লে
চয়নকেও নিজের কোলে রেখে সে ঘুম পাড়াত।
কোথায় হারালো সেই দিনগুলো, ভাবতে ভাবতে রূপা বিভোর হয়ে যায়।
যেন একটা অনির্দেশ্য আকর্ষণ তাকে নিয়ে যেতে চায়, সেই হলুদ দুপুরে, তার সেই
ছোটবেলাটায়।
এইভাবেই তারা বড় হয়ে গেছিল নিতান্ত সরলভাবে, অত্যন্ত
সাধারণভাবে। স্কুলটা ছিল বেশ দূরে, পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগত সাইকেলে। কাছেপিঠে কোন
স্কুল ছিল না যে। একের পর এক ক্লাস পেরিয়ে গেল তারা। ওয়ান, টু, থ্রি করতে করতে
একসময় চয়নের ক্লাস ইলেভেনে ওঠার সময় হল। মনে পড়ে, সেদিন মাধ্যমিকের রেজাল্ট নিয়ে
বাড়িতে আসছে, দূর থেকে চয়নের নজরে আসে বাড়ির সামনে বেশ কিছু জটলা। আর একটু এগিয়ে
এসে সে শুনতে পায় তার মায়ের কান্নার আওয়াজ। গলা ফাটিয়ে চীৎকার করে কাঁদছে তার মা।
এমন কি হল যে মা কাঁদছে? একরাশ কৌতুহল নিয়ে দৌড়ে যায় চয়ন। ভিড় ঠেলে কিছুটা এগিয়েই
দেখে বাবার শায়িত দেহটা, সাদা চাদরে ঢাকা আশিরনখ। পেছন থেকে কে যেন বলে, ‘একটা
ট্রাকের সাথে ধাক্কা লেগে...। বড় ভাল ছিল গো লোকটা’।
বাবা চলে যাওয়ার কিছুদিন পরেই ওদের অবস্থা খারাপ হয়ে যায়।
বাবার দোকানটা বেচে কিছু টাকা পাওয়া গেল। ওর মায়েরও মাথার রোগ হল। এখন এই রোগকে
বলে ডিপ্রেশন। ওরা গ্রামের লোক, ঘটনাটাও অনেক আগের, তাই ওরা এইসব রোগ সম্বন্ধে
কিছুই জানত না। একদিন কাউকে কিছু না বলে কয়ে ওর মা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ব্যস, সেই
যে গেল, আর কোনদিনও ফিরল না। অনেক খোঁজাখুঁজি করা হয়েছিল। কিন্তু সবটাই বৃথা।
একটা কষ্ট যেন রূপার বুক চিরে বেরিয়ে আসতে চায়। সে ক্ষণিকের
জন্য থেমে কিছুটা দম নিয়ে নেয়। তারপর সে অবাক হয়ে লক্ষ্য করে, তার চোখদুটো জলে ভরে
উঠেছে।
পরের দিনই ওদের মুম্বাইয়ে ফেরার পালা। ফ্লাইটে সেভাবেই বুক
করা ছিল। মুম্বাইয়ে পৌঁছে রূপার মাথায় একটা প্ল্যান কাজ করল। সে ঠিক করল ওদের
ম্যারেজ অ্যানিভার্সারিটা এখানেও আরেকবার হবে। হোক না তা দিন তিন-চার পর। ক্ষতি কি
একটা গেট টুগেদারে? বিয়ের প্রথম বছর বলে কথা; ইয়ার বন্ধুদের সাথে একটু ফষ্টিনষ্টি
হবে না, তাই কি হয়? প্রস্তাবে রাজী হয়ে নব্যেন্দু বলে, ‘বেশ তো। সানডেতেই হোক
তাহলে?’ রূপা ফেটে পড়ে আনন্দে। নব্যেন্দু জিগ্যেস করে, ‘তোমার সেই বন্ধুকে ডাকবে
না?’ রূপার ভুরু কুঁচকে যায়, ‘কে বল তো?’
-‘আরে ঐ চয়ন না কি যেন নাম বলেছিলে?’
রূপা হো হো করে হেসে ফেলে। তারপর বলে, ‘আরে ছাড়ো তো। ও আসবে
এখানে? ওর মত মুখচোরা তো গ্রাম থেকে বেরোতেই ভয় পায়’।
চয়নের নাম বলতেই তার আবারও মনে আসে সেই সব দিন। চয়নের মা চলে
যাওয়ার পর থেকেই ওর মধ্যে একটা পরিবর্তন এসেছিল। সে একদিন ছবি আঁকতে শুরু করল।
অনেক ছবি আঁকত সে। ছবির কতকগুলো বইও জোগাড় করেছিল কোত্থেকে। সেই বই দেখে আঁকত,
তারপর মন থেকে আঁকা শুরু করল সে।
‘বললে বিশ্বাস করবে না, কি সুন্দর যে হত সেসব ছবিগুলো। মনেই
হত না ওর আঁকা। যেন কোন সত্যিকারের শিল্পীই এঁকেছে মনে হত। কিভাবে এত ভাল আঁকত ও
জানি না। তবে মনে হয় মানুষ খুব দুঃখ পেলে তবেই এত ভাল সৃষ্টি করতে পারে’।
নব্যেন্দু মৃদু হেসে বলে, ‘ভাল বললে তো? তুমি তো কবি হতে
পারতে?’
রূপা ওর কথায় কোন উত্তর না দিয়েই বলে চলে, ‘আর করত বাগান।
বাগানে নানান ধরনের ফুলগাছ লাগাত। কি সুন্দর বাহারি ফুল ধরত তাতে। দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। গোলাপ, টগর,
রজনীগন্ধা, ইনকা, ডালিয়া তো থাকতোই, সঙ্গে থাকত আরো কত নাম না জানা ফুলের গাছ।
ভারি ভাল লাগত বাগানটা’।
একদিন সে রূপাকে জন্মদিনে একটা ছবি এঁকে উপহার দিয়েছিল।
ছবিটায় ছিল - রূপার বিয়ে হচ্ছে, সে তার বরের সাথে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে। ছবিটা দেখে
রূপা এমন রেগে গিয়েছিল যে সে সেটা ছিঁড়েই ফেলল সেদিন। কিন্তু আজ তার মনে হয়, ওটা
না ছিঁড়লেই ভাল হত। বড় সুন্দর এঁকেছিল সে ছবিটা।
পাড়ার লোকেরা বলত, ‘কিসব ফালতু কাজে সময় নষ্ট করছিস। তার চেয়ে বাপের দোকানটা দেখলে তো
পারতিস’। লোকের কথায় পাত্তাই দিত না সে। বাবার দোকান বেচার টাকাতেই তার তখন চলে
যেত। ধীরে ধীরে এমন হল যে সে ভাবতে লাগল, সে বড় শিল্পী হবে। কিন্তু বসে খেলে জমানো
টাকাই বা আর কতদিন চলে? ভাঁড়ারে তো একদিন না একদিন টান পড়বেই। আর পড়লও তাই। তার
ফলটা কি হল? আজ চয়ন একটা সামান্য দোকানের কর্মচারী। বাগানও গেল, আঁকাও গেল।
কথাগুলো বলতে বলতে থামে রূপা। নব্যেন্দু ওর কাঁধে একটা হাত
রেখে বলে, ‘পুরনো দিনের কথা মনে পড়লে কষ্ট লাগে রূপা। ছাড় ওসব’। রূপা তার কথা যেন
শুনতে পায় না। বড্ড অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে সে।
গেট টুগেদার হওয়ার কথা ছিল রবিবার। শনিবার একটা পার্সেল এল
ওদের বাড়ি। রূপা ভাবল, আজ আবার কি এল পার্সেলে? বোমাটোমা নেই তো আবার? নব্যেন্দু
তখন বাড়ি ছিল না। সইসাবুদ করে নিয়ে পোস্টম্যান চলে গেল। একরাশ কৌতুহল নিয়ে রূপা
পার্সেলটা খুলতেই দেখে প্যাকেটে মোড়া একটা কাঠের ফ্রেম। প্যাকেট খুলতেই বেরিয়ে পড়ে
ফ্রেমে বাঁধা একটা জলছবি। জলছবিতে এক স্বামী তার স্ত্রীর দিকে একটা নীল গোলাপ
বাড়িয়ে ধরেছে। স্ত্রীর হাতেও সেই একই ফুল, সে তার স্বামীকে উপহার দিচ্ছে। কিন্তু
সবথেকে আশ্চর্যের ব্যাপার যে এই ফুলদুটো কিন্তু ছবিতে আঁকা নয়, বাস্তব। উজ্জ্বল নীল রঙের গোলাপ দুটো
ছবির সাথে কি সুন্দরভাবে আটকানো রয়েছে। রূপার চোখদুটো জুড়িয়ে যায়। সে নীল গোলাপ যে
দেখেনি তা নয়, কিন্তু এ অন্য জাতের গোলাপ। অনেক বড়, আরো অনেক সুন্দর। কি অপূর্ব এর
গন্ধ। কোথায় আজকের এই রুম ফ্রেশনার! রূপার মন মেতে ওঠে এই ফুলদুটোর বর্ণে-গন্ধে।
কিন্তু কে পাঠালো এত সুন্দর এই ফুলদুটো? পার্সেলটার ভেতরে সে
ভাল করে খুঁজে দেখল কিছু আছে কিনা যা দিয়ে সে বুঝতে পারে এটা কার উপহার? কিন্তু
পার্সেলে আর কিছুই ছিল না।
নব্যেন্দু অনেক রাত করে ফিরল সেদিন। এই ছবিটা দেখেই সে মুগ্ধ
হয়ে যায়। অবাকপারা হয়ে সে ছবিটার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘অসাম, ফুলদুটো রিয়েল হওয়াতে
ছবিটা আরো ভাল লাগছে। কিন্তু কে দিল সেটাই বুঝতে পারলে না?’
রূপা বলে, ‘আমার মনে হয় ঐ পাগলাটাই দিয়েছে’।
-
‘কে?’
-
‘কে আবার, চয়ন। ও ছাড়া কেই বা আর আমায় এই
গিফট দেবে বল? আমার কোন বন্ধু বা কোন পরিচিতই এত সুন্দর ছবি আঁকতে পারে না’।
-
‘বড় ভাল ছেলেটা’।
পরেরদিন নব্যেন্দু এই ছবিটাকে ড্রয়িংরুমের শোকেসের ওপর রেখে
দিল যাতে সকলের নজরে পড়ে। আর পড়লোও তাই। কেউ এর তারিফ না করে পারল না। একজন বলল,
‘দিস ইজ আ ওয়ার্ক অফ আর্ট’। আরেকজন তাকেই সায় দিয়ে বলে, ‘সে আর বলতে? এই ফুলটাও
খুব রেয়ার। আমার এক বন্ধুর নার্সারিতে দেখেছিলাম, খুব যত্ন না নিলে এর গাছ বাড়ে
না। কে দিয়েছে এই গিফট, রূপা?’
রূপা ছোট্ট করে বলে, ‘আমার এক বন্ধু’। লোকটা বলে, ‘কোথায়
থাকেন তিনি? তাঁকে দেখার খুব ইচ্ছা হচ্ছে আমার। নিশ্চয়ই খুব বড় আর্টিস্ট’। উত্তর
মেলবার আগেই নব্যেন্দু ঘরে ঢোকে। গমগমে গলায় বলে, ‘সেলিব্রেশানের সময় হল এবার’।
সেদিনটা সকলের সাথে পরিচয় করে, হৈ-হুল্লোড়ে বেশ ভালই কাটল
রূপার। দুদিন পরে ধীরে ধীরে ছবির ফুলদুটো শুকিয়ে গেল। ছবিটাকে এখন আর তত ভাল লাগে না। রূপা বুঝেছিল যে এটা
চয়নই তাকে দিয়েছে, কিন্তু নাম তো ছিল না তাতে। তাই রূপার মন থেকে
সন্দেহটা কিছুতেই দূর হচ্ছিল না। সে ঠিক করল বাড়িতে ফোন করবে, তারপর চয়নের সাথে
যোগাযোগ করে নেবে। তাহলেই বোঝা যাবে চয়নই তাকে সেই উপহার দিয়েছিল কিনা।
বাড়িতে নতুন ফোন নেওয়াতে এই সুবিধাটা পাওয়া যায়। যখন-তখন বাড়িতে
ফোন করে বাড়ির খোঁজ খবর নিতে পারে সে। ফোন করল সে বাড়িতে। মার গলা আসে, ‘হ্যালো’।
-
‘হ্যালো, মা। কেমন আছো তোমরা?’
-
‘ভালই আছি মা। তোরা কেমন আছিস?’ মায়ের গলাটা
কেমন একটু বিষণ্ণ শোনায়।
-
‘আমরাও ভাল আছি। তোমার শরীর খারাপ নাকি?’
রূপার প্রশ্নে মা একেবারে ভেঙে পড়ে, ‘জানিস তো মা, চয়ন মারা
গেছে’।
রূপা চমকে ওঠে, চিৎকার করে বলে, ‘কি বলছ কি তুমি? কি করে?’
-
পাগল ছেলের কাণ্ড আর কি! ক’দিন আগে ওনার শখ
হল উনি ফুলগাছ লাগাবেন। চারা এনে বসাল ফুলগাছ। কত যত্ন, কত পরিশ্রম করে কি সুন্দর
ফুল ধরাল তাতে। তুই যদি দেখতিস তো চমকে উঠতিস। আমিও তো গ্রামের মেয়ে, কিন্তু অত
সুন্দর রঙবেরঙের ফুল আমিও কোথাও দেখিনি। ভোররাত থাকতে উঠে গাছের চর্চা করত। বাধা
দিতে গেলেই বলত, এছাড়া আর সময় কোথায় বল। সারাটা দিনই তো দোকানের কাজে থাকতে হয়। আর
এই কনকনে শীতে কাজ করলে যা হয়। নিউমোনিয়া ধরে গেল। আমিও বাতের ব্যথায় আর দেখতে
যেতে পারতাম না। একদিন তোর বাবা গিয়ে দেখে ছেলেটা জ্বরে কাতরাচ্ছে। সুজন ডাক্তারকে
খবর দিতেই ডাক্তার বলল আর কিছু করার নেই। রোগ অনেক বেড়ে গেছে। কোন আশা নেই। কাল
বিকেলে...। বড্ড খারাপ লাগে রে।
একটু দম নিয়ে মা আবার বলতে শুরু করে, ‘শেষ দিনগুলোয় ও তোর কথা
খুব বলছিল। হয়ত দেখতে চাইছিল তোকে। মুখ ফুটে তো কিছু বলে না। হ্যালো হ্যালো, রূপা
আছিস তো ফোনে?’
কেউ সাড়া দেয় না। দেবে কি করে? ফোন ফেলে রূপা যে তখন বালিশে
মুখ গুঁজে কাঁদছে। অঝোরে কেঁদে চলেছে সে এক নামহীন, পরিচয়হীন ব্যর্থ শিল্পীর
জন্য”।
গল্পপাঠ অনুষ্ঠানটি এখানেই শেষ হল।” বক্তার গাম্ভীর্যপূর্ণ
দৃঢ় কণ্ঠস্বর যে কোন শ্রোতাকেই মুগ্ধ করে। আবহসঙ্গীতের উপস্থিতি ও নাট্যধর্মী
উপস্থাপনা গল্পের মাধুর্য এতটাই বাড়িয়ে দিয়েছিল যে শ্রোতারা একেবারে নিশ্চুপ। শুরু
হল হাততালির পালা, হলঘর গমগম করতে থাকে। নমস্কার করে বেরিয়ে যান বক্তা।
এবার এক টাকমাথা প্রৌঢ় ভদ্রলোক মঞ্চে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর
বক্তৃতাটাই ছিল শেষ অনুষ্ঠান। তিনি শুরু করলেনঃ-
“ এই হল আমাদের ফল্গুধারার ইতিহাস। এটা কোন গল্প নয়, বরং দশ
বছর আগে ঘটে যাওয়া এক চরম সত্য ঘটনা। এই ঘটনাটার পরেই রূপা মানে রূপাগ্নি মৈত্র এই
ফল্গুধারার পরিকল্পনা করেছিল। ফল্গু নদী যেমন মাটির তলা দিয়ে বয়ে যায়, কেউ তাকে
দেখতে পায় না। তেমনি যেসব শিল্পীরা চিরকাল অন্তরালে থেকে যান, সামনের সারিতে এসে
দাঁড়াতে পারেন না তাঁদের জন্যই তৈরি হয়েছিল আমাদের এই এনজিও প্রতিষ্ঠান, রূপাগ্নি
মৈত্র আর নব্যেন্দু মৈত্রের মানসপুত্র ‘ফল্গুধারা’। আজ এখানে বেশ কিছু ছবি ও
স্থাপত্য আপনারা দেখেছেন। এগুলো অত্যন্ত মূল্যবান, এর কিছু কিছু বিক্রি করা হয়।
কিন্তু বেশীরভাগই সংগ্রহ করে রাখা হয়।
তবে একটা কথা না বলে পারছি না, এই প্রতিষ্ঠানটিকে চালানোর পথটা
প্রথমে কিন্তু খুব একটা মসৃণ ছিল না। বিশেষতঃ আর্থিক অভাবেই এই প্রতিষ্ঠান একসময়
বন্ধ হয়ে যেতে বসেছিল। একে টিকিয়ে রাখার জন্য রূপা-নব্যেন্দুকে অনেক পরিশ্রম করতে
হয়েছে। আজ এই দশ বছর পরে এই প্রতিষ্ঠান প্রথম সরকারী স্বীকৃতি পেল। আমরা এই ক’বছর
চেষ্টা করে গেছি গ্রামেগঞ্জে গিয়ে বিভিন্ন শিল্পীদের খোঁজ করবার। যারা হারিয়ে গেছে, যাদের কেউ নেই তাদেরকে নতুন আলোয় সকলের
সামনে তুলে ধরতে চেয়েছি আমরা। আমরা অনেককেই প্ল্যাটফর্ম দিতে পেরেছি, তাদের অনেকেই
আজ চিত্রকর কিংবা স্থপতি বলে খ্যাতি পেয়েছেন। এতে আমরা গর্বিত। আর শুধু আমরাই কেন?
এ তো প্রথমে সাধারণ মানুষের অনুদানেই চলত। আপনাদের সাহায্য না পেলে তো আমাদের এই
উদ্যোগ পুরোপুরিই ব্যর্থ হত। তাই আপনাদের আন্তরিক শ্রদ্ধা নিবেদন করি।
আর কোন ‘চয়ন’ তৈরি হোক এটা আমরা চাই না, যেমন চায়নি
রূপা-নব্যেন্দুও। আমাদের সৌভাগ্য, দীর্ঘদিন যাবৎ আবেদন করে অবশেষে আমরা সরকারী
অনুদান পেতে সক্ষম হয়েছি। আশা রাখি, ভবিষ্যতে ‘ফল্গুধারা’ আরো এগিয়ে যাবে। হারাতে
থাকা নাম-পরিচয়হীন শিল্পীরা তাদের মূল্য খুঁজে পাবেন। আপনাদের সহযোগিতাও একান্ত
কাম্য। না হলে আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাকে আমরা বাস্তবায়িত করতে পারব না। আপনাদের
সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমার এই ছোট্ট বক্তব্যটি শেষ করলাম। নমস্কার”।
আমি গিয়েছিলাম এই অনুষ্ঠানে। নব্যেন্দু আর রূপাগ্নিকে আমি
চিনি। তাই বুঝতে পারলাম যে গল্পটা পাঠ করল সে রূপা আর শেষের বক্তৃতাটা দিল
নব্যেন্দু নিজে। কিন্তু কথায় বা বক্তৃতায় তারা কখনোও তাদের নাম ব্যবহার করেনি।
কিন্তু কেন? শুধু সেটাই বুঝলাম না। তবে মনে হয় যে ওরাও নিজেদের প্রকাশ করতে
চায় না, ফল্গু নদীর মত ওরাও চায় নিজেদের অলক্ষ্যে রেখে কাজ করে যেতে। ওরা তো আর সেলিব্রিটি
নয়, ওরাই আসল শিল্পী। শিল্পীকে গড়ে তোলাই যাদের শিল্প।
- ঐশিকা বসু।
২৯শে জানুয়ারি, ২০১৪।