‘প্রশান্ত পৌঁছেছে?’ টেনে টেনে কথাগুলো উচ্চারণ করে দৃপ্ত। পাশে মৈত্রেয়ী
দাঁড়িয়ে। উত্তর করে, ‘হ্যাঁ, এতক্ষণে মনে হয় পৌঁছে গেছে। একটু বাদেই ফোন করব’।
পাশ ফিরে শোয় দৃপ্ত। তার আর কথা বলার মত অবস্থা নেই। কিন্তু মনের
চিন্তাটা থেকেই যায় তেমনিই। উৎসব পত্রিকাটা কি
তার লেখাটা ছাপাবে? প্রশান্ত জেনে আসবে। দৃপ্ত অনেক সাধ করে পাঠিয়েছে লেখাটা। অনেক
দিন ধরে ভেবেচিন্তে যত্ন নিয়ে লিখেছে সে।
আপনারা হয়ত ভাবছেন এই দৃপ্ত আবার কে? কোন বড়সড় লেখক বোধহয়। কিন্তু তাহলে
একটু বেশিই চিন্তা করে ফেলেছেন। না দৃপ্ত কোন বড় লেখক তো নয়ই, এমনকি ওর এই লেখক
পরিচয়টাও বিশেষ বন্ধুবান্ধব ছাড়া আর কেউ জানে না। ওর দৌড় ঐ লিটল ম্যাগাজিন অব্দিই।
এক অজানা অখ্যাত শখের লেখক, কে তাকে পাত্তা দেবে?
কিন্তু ওর বড্ড ইচ্ছা, সে বড় কোন পত্রিকায় লেখে। সেইমত গতবছর সে উৎসব
পত্রিকায় তিনখানা লেখা পাঠিয়েছে। একটারও উত্তর আসেনি। আর আসবেই বা কেন? সে তো আর
কোন কেউকেটা কেউ নয়। তাই উৎসবের মত বাংলার একটা প্রথম সারির পত্রিকায় তার স্থান কি
করে হবে? এই কথাটাই বোঝানো যায় না দৃপ্তকে। সে ঠিক করে রেখেছে, তাকে বড় পত্রিকায়
লিখতেই হবে। আর তাছাড়া উৎসবে যে মানের লেখা ছাপায়, তার লেখা সে তুলনায় কোন অংশে কম
নয়। বরং অনেক ফালতু লেখাও সে পেয়েছে উৎসবে। কিন্তু তার
এইসব কথা কে শোনে?
শোনে শুধু একজন। সে প্রশান্ত। লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক কাম দৃপ্তর
বন্ধু। শুধু বন্ধু বলে নয়, একজন সম্পাদক হিসেবেও তার দৃপ্তর লেখা ভাল লাগে। আর তার
এটা মনেও হয়, দৃপ্তর লেখাগুলো লিটল ম্যাগাজিনের মত অস্থায়ী জায়গায় নয়, বরং কোন
একটা বড় পত্রিকার ঘরে সংরক্ষিত থাকাই উচিত। কিন্তু কে নেবে তার
লেখা? এখানেও যে চলে কম্পিটিশন, আর তার চেয়েও বেশি লবিবাজি।
তবু বলব, সবটাই ঠিক চলছিল। লিখতে লিখতে একদিন হয়ত দৃপ্তর কাছে একটা বড়
সুযোগ এসেও যেতে পারত। কিন্তু হঠাৎ দিক গেল ঘুরে। দৃপ্তকে মারণ রোগে ধরল। এই রোগের
কোন চিকিৎসা নেই। এমনকি তার রোগটা যে কি তাও ঠিকমত বোঝা যাচ্ছে না। সেদিন অফিস
থেকে ফিরে হঠাৎ বলল, ‘শরীরটা খুব দূর্বল লাগছে। খুব কষ্ট হচ্ছে’। এই ছিল শুরুটা।
সেদিনটা গেল। পরেরদিন অবস্থার আরও অবনতি হল। সক্কালবেলা তাকে হাসপাতালে
ভর্তি করান হয়। ডাক্তারেরা ঠিকমত বুঝেই উঠতে পারল না, রোগটা কি? এদিকে দিনকে দিন
তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে। এখন তো সে উঠে ঠিকমত দাঁড়াতেও পারে না।
বেডপ্যানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সবকিছুই শুয়ে। মাঝেই মাঝেই এখন স্যালাইন দিতে
হচ্ছে। আর পালস রেট নামছে ধীরে ধীরে। কিন্তু ক্রমাগত সেটা নামছেই। কি হল দৃপ্তর?
বয়সও যে তার খুব বেশি তাও নয়। গত অগাস্টে সে চল্লিশে পড়েছে।
এর মধ্যে সে লিখেছে বারোটা গল্প, আর কিছু কবিতা। সবকটারই স্থান হয়েছে
লিটল ম্যাগে। বেশিরভাগই প্রশান্তর পত্রিকায়। কিন্তু শেষ তেরো নম্বর গল্পটা সে
প্রশান্তকে দেয়নি। দিয়েছে উৎসব পত্রিকায়। যদিও সেটা নিয়ে যাওয়ার ভার পড়েছে
প্রশান্তরই।
এদিকে প্রশান্ত তার বন্ধু। দৃপ্তর এই সময়ে তার পাশে কেউ নেই যে একটু
হেল্প করবে। মৈত্রেয়ী একা হাতে আর কত সামলাবে? তাই হাসপাতালে বিভিন্ন কারণে
ছোটাছুটিও করতে হচ্ছে প্রশান্তকে। একটা মানুষকে এই সময়ে সেবাশুশ্রূষা করাও কি কম
খাটনি নাকি? তাই এখন উৎসবের অফিসে যাওয়া মানে সময় নষ্ট করারই নামান্তর। কিন্তু
দৃপ্তকে সেসব বোঝাবে কে? সে গোঁ ধরেছে এখুনিই তাকে যেতে হবে। পাণ্ডুলিপিটা
সম্পাদকের হাতে দিয়ে জেনে আসতে হবে এটা ছাপানো হবে কি হবে না? অগত্যা বন্ধুর কথায় সে উৎসবের অফিসে যেতে বাধ্য
হল। ঠিক করল, সেখানে গিয়ে সে সম্পাদককে রিকোয়েস্ট করবে। দেখাই যাক না কি হয়?
দৃপ্তর জীবনের আর হয়ত কোনই আশা নেই। তার এই শেষ ইচ্ছাটুকুর কি একটুও মূল্য কেউ
দেবে না?
অফিসটা বেশি বড় নয়। সামনেটায় একটা লন। সামনে একটা রিসেপশনের মত কাউন্টারও
রয়েছে। আর তার পাশ দিয়ে গেলেই একটা কাঁচের ঘর, দরজার সামনে লেখা - ঠেলুন। ঠেলে
ঢুকতেই কম্পিউটারের সামনে বসা ভুঁড়িওয়ালা লোকটা জিজ্ঞেস করে, ‘কি ব্যাপার?’ গলাটায়
বেশ কর্কশভাব স্পষ্ট।
প্রশান্ত সম্পাদককে তার সমস্ত কথা বলে। তারপর
ব্যাগ থেকে পাণ্ডুলিপিটা বের করে তার দিকে বাড়িয়ে দেয়। একটু অনিচ্ছা সত্ত্বেও
লোকটা সেটা নেড়ে চেড়ে দেখে। তারপর দু-একটা পাতা উল্টেই একটা বেল টেপে।
বেলের আওয়াজ শুনে দরজা ঠেলে ঘরে আসে একটা অল্পবয়েসী ছেলে। তার দিকে লোকটা
পাণ্ডুলিপিটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘পড়ে দেখো তো। আমাদের পত্রিকায় দেওয়া যাবে কিনা?’
তারপর প্রশান্তর দিকে ফিরে বলে, ‘আপনি একটু ঘুরে আসুন। এখন ওর হাতে কাজ
আছে। কাজ মিটিয়ে আপনার গল্পটা ও পড়ে দেখবে। এই ধরুন আধঘণ্টা’। একটু থেমেই সে আবার
বলে, ‘ও-ই সব সিলেকশনের কাজগুলো করে’। প্রশান্ত নিজের পরিচয় দিয়ে আর বলেনি যে সেও
একটা পত্রিকা চালায়, আর সেখানে লেখাগুলো সে নিজেই বাছাই করে। কি লাভ বলে? সে তো
লিটল ম্যাগাজিনের বেশি আর কিছু চালায় না। কতই বা আর লেখা জমা পড়ে তাতে। বরং এসব
বললে ফালতু একটা বিতর্ক বাধবে।
সে বেরিয়ে গেল অফিস থেকে। কিছু টুকটাক কেনাকাটি ছিল। বাড়ির জন্য এক কেজি
চিনি নিয়ে যেতে হবে। আর তার সাথে মুসুর ডাল। এইসব করতে করতে আধঘণ্টা নয়, কেটে গেল
একেবারে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। দ্রুত পা চালিয়ে সে ঢুকল আবার উৎসবের অফিসে।
অফিসে ঢুকে এবার আর সম্পাদকের সাথে দেখা হল না। সামনেই একটা বেঞ্চে বসে
ছিল সেই ছেলেটা, গল্প সিলেকশনের দায়িত্ব যার হাতে। সে প্রশান্তকে ইশারায় ডাকে।
তারপর বলে, ‘শুনুন, আপনিই একটু আগে গল্প দিয়ে গেছিলেন না?’ প্রশান্ত মাথা নাড়িয়ে
বলে, ‘হ্যাঁ। ওটা কি সিলেক্টেড হয়েছে?’
‘প্রশান্ত এখনো ফোন করল না?’ একটু কথা বলেই হাঁপিয়ে ওঠে দৃপ্ত। তার
চোখদুটো একেবারে ঘোলাটে হয়ে আসছে। জিভ বেরিয়ে আসছে মাঝে মাঝেই। এটুকু একটা কথা
বলেই সে হাঁপাতে থাকল। মৈত্রেয়ী বলে, ‘পৌঁছেছে তো অনেকক্ষণ। এখনই করবে হয়ত’। কথাটা
শেষ না হতেই তার মোবাইলটা বেজে উঠল।
ফোনটা হাতে তুলে সে বলে, ‘হ্যাঁ প্রশান্ত বল কি খবর? ও আচ্ছা, আচ্ছা। ঠিক
আছে। হ্যাঁ রাখ। আর তাড়াতাড়ি চলে এস। এখানে কাজ আছে’।
‘কি...কি বলল গো? প্রশান্ত কি বলে?’ দম নিতে নিতে কোনরকমে বলে ওঠে দৃপ্ত।
মৈত্রেয়ী মৃদু হেসে বলে, ‘তোমার লেখা সিলেক্টেড হয়েছে। ওদের খুব পছন্দ
হয়েছে লেখাটা’।
‘আঃ, কি শান্তি!’ যেন বুক থেকে একটা পাথর নেমে গেল তার। এখন সে
নিশ্চিন্ত। বুকে হাত বোলাতে বোলাতে সে মনে মনে বিড়বিড় করতে লাগল। তারপর মৈত্রেয়ীর
দিকে তাকিয়ে কিসব বলতে চেষ্টা করল। মৈত্রেয়ী বলে, ‘কি? কিছু বলবে?’
কানটা তার মুখের কাছে নিয়ে গিয়ে কথা শুনতে হয়। সে বলছে, ‘জানলাটা খুলে
দাও না। বড্ড ভাল লাগছে এখন। আঃ, কি শান্তি!’ মৈত্রেয়ী জানলাটা খুলে দিতেই একটুকরো
রোদ এসে দৃপ্তর গায়ে লাগে। শীতের মৃদু রোদ। বড্ড ভাল লাগে তার। বিছানায় মড়ার মত
শুয়ে আছে দৃপ্ত। কিন্তু তার চোখদুটো খুব উজ্জ্বল লাগছে এখন। এতক্ষণ তো এমনটা
লাগছিল না।
* * *
এর প্রায় মিনিট পঞ্চাশ বাদে হন্তদন্ত হয়ে যখন প্রশান্ত হাসপাতালের ঘরে
ঢোকে, তখন মৈত্রেয়ী সাদা কাপড়ে ঢাকা একটা ডেডবডির ওপরে মুখ ঢেকে কাঁদছে। দৃপ্ত
মারা গেছে। কথাটা বারবার বাজতে লাগল প্রশান্তর। তারও দুচোখ ভ’রে জল আসতে লাগল।
ইতিমধ্যে ঘরে আরও অনেকে এসে গেছে। এরা বেশিরভাগই দৃপ্তদের আত্মীয়স্বজন।
খানিকবাদে নিজেকে সংবরণ করে মৈত্রেয়ী প্রশান্তকে বলেছিল, ‘তোমার ফোনটা পেয়ে ও খুব
খুশি হয়েছিল। ও বোধহয় ভাবতেও পারেনি ওর লেখা ওরা নেবে। কিন্তু জানো, ও খুব আশা করেছিল।
যাক, মানুষটা অন্তত একটা শান্তি নিয়ে যেতে পারল’।
মৈত্রেয়ীর কথা শুনে প্রশান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, তারপর বলে, ‘ওর লেখা
ওরা নেয়নি মৈত্রেয়ী। আমি ওটা বানিয়ে বলেছি’। একটু থেমে সে আবার বলে, ‘কি লাভ যাবার
বেলায় একটা মানুষকে কষ্ট দিয়ে? তার চেয়ে একটা মিথ্যে নিয়ে মরাও অনেক ভাল। তাই না?’