ব্যাগটা পড়ে ছিল
ব্রিজের
ঠিক গোড়াটায়, একটু আড়ালে। অন্ধকার। তাই হয়ত কারুর খেয়ালে পড়েনি।
নইলে এখুনিই লোপাট। দেখেই বোঝা যায়, একটা দামী হ্যাণ্ডব্যাগ। লেদারের
মনে হচ্ছে। কালো রঙ, আলোতে আনলে চকচক করবে হয়ত। সন্ধ্যে নেমে গেছে ইতিমধ্যেই, কালো
কালো ছায়াগুলো এবার গাঢ় হতে শুরু করেছে। ব্যাগটা পড়ে আছে বেবাক। লোক আসছে যাচ্ছে, স্টেশনে কতই না হৈ-হট্টগোল। কারুর খেয়ালই নেই
সেদিকে। ব্যস্ততা। ২ নম্বর প্ল্যাটফর্মে ডাউনের গাড়ির খবর হল। ভিড় বেড়েই চলল
প্ল্যাটফর্মটার ওপর। ব্যাগটা তবু আছে, চুপচাপ। পেটে কি আছে তার? কে জানে?
মেয়েটা না বড্ড ভাবে। বড় শখ তার সে বড় বাড়িতে থাকবে। গাড়ি
থাকবে তার নিজের। অনেক দাসদাসী থাকবে। হুকুম পেলেই যারা ছুটবে, আদেশ শিরোধার্য। কিন্তু তার এই পোড়া কপালে কি
সেসব আছে? কেন যে এইভাবে জন্মানো? এই ভিখিরির জীবন! মা কাজ করে বাড়ি বাড়ি। মাস
গেলে কত যে ঢোকে সে হিসেব নেওয়ার ক্ষমতাও তাদের নেই। একবেলা ঠিকমত খেতে পায়। তো
পরেরটায় পেট চোঁ চোঁ। মা বলেছিল তার কাজে সাহায্য করতে। সে কি মেয়ে শোনে? তার না
বড় শখ সে অনেক বড় বাড়িতে থাকবে। মায়ের মতন কাজ করতে থাকলে সে তো নিজেই দাসী হয়ে
যাবে, তখন কাকে সে হুকুম করবে? কি করে হবে তার গাড়ি?
সে ওসব কাজ করেনি।
মায়ের ইচ্ছে মোতাবেক দু-ক্লাস পড়েছিল। তারপর থেকেই ফাঁকি শুরু। প্রথম প্রথম স্কুল
পালিয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা। আর সেই নিয়ে স্কুলের দিদিমণি একদিন চূড়ান্ত মেরেছিল
তাকে। স্কেলের বাড়ি নয়, ছড়ি দিয়ে মেরেছিল তার পায়ে। অনেকক্ষণ যন্ত্রণা সহ্য করেছিল
সে। তারপর আর পারেনি। দিদিমণির হাত জোরে কামড়ে দিল সে একসময়। দিদিমণির সে কি
চীৎকার! ব্যস, সেই যে পালিয়ে এল স্কুল থেকে। তারপর আর ওমুখো হয়নি সে।
মেয়েটা বসেছিল। তার
চোখে পড়েছিল সেই ব্যাগটা। একহাত
দূরে, ব্রিজের গোড়ায়,
ঝাপসা হয়ে এসেছে যেখানটায়। ভিড়, তবু বেশ কায়দা করে লুকিয়ে সে তুলে নিল সেটা। তারপর জামার কোঁচায় লুকিয়ে দে-দৌড়।
ভাগ্য তার ভাল, তাই
কেউ তাকে ঐ অবস্থায় দেখতে পায়নি। কিংবা দেখলেও অতশত বোঝেনি। নইলে...।
মায়ের বাড়ি ফেরার সময় হয়ে গেছে। দাদা
আর ভাই গেছে সুশীলদার বাড়ি। সুশীলদা লজেন্স বিক্রি করে আর দুই ভাই তার প্যাকেট
ভাঁজ করে। এতে অবশ্য রোজ রোজ তাদের অনেক লজেন্স খাওয়া হয়।
ঘরেতে ঢুকেই
ব্যাগটাকে খাটের তলায় চালান করে; বিমলটা মহাবদ। সব খোঁজ রাখে সে; তার মায়ের জন্যই অবশ্য তার এত
সাহস। বাড়িউলির ছেলে
কিনা। ‘কি র্যা, কই গেসিলি?’ মায়ের গলা শুনে
হঠাৎ যেন চমক লাগে মেয়েটার। সে এতক্ষণ অনেক কথা ভাবছিল। ঠিকমত গুছিয়ে উঠতে পারল না
সে, মায়ের গলা ফের, ‘অমন কি দ্যাখসিস! কই গেসিলি, জিগালাম যে। আমার হয়েছে মরণ। বাড়ি এসে দেখি
কেউ নাই’।
‘মা একখান ব্যাগ
পাইসি।‘ মেয়েটা কিছুটা ভয়গ্রস্ত।
‘কি কস?’ মা
অবাকপানা দৃষ্টি ছেড়ে বলে। মেয়েটা মাকে বলে যায় সব কথা, খুব গাঢ়ভাবে। সবটা শুনে মা
একটু সন্দিগ্ধ হয়ে ওঠে। ব্যস্ত হয়ে পড়ে ব্যাগটা নিজের চোখে দেখবার জন্যে। মেয়ে
ততক্ষণে সেটা বের করে এনেছে খাটের তলা থেকে। ‘কি আছে রে?’ মায়ের প্রশ্ন। ‘অত কি কি
না করে দ্যাখই না। ভেতরটা দেখলে চমকে উঠবা।‘ মা ব্যাগের চেনটা খোলে। দেখে দুটো সোনার
চেন, একটা হীরে বসানো কানের দুল, আর একটা আংটি – সোনার। এতপর্যন্ত যা ছিল তাই
দিয়েই অনেক টাকা পেত তারা। কিন্তু
ভগবান যব দেতা হ্যায় তো ছপ্পড় ভরকে দেতা হ্যায়। এর সাথে ব্যাগের আরও একটা পকেট আর তাতে নগদ একলক্ষ টাকা!
কিন্তু আশ্চর্যের
ব্যাপার! ব্যাগটা পেয়ে মায়ের মুখটা মোটেই খুশীতে ভরে উঠল না। বরং সে যেন আরো চুপসে
গেল। সহসা মায়ের থেকে প্রত্যাশিত কোন ভাব না দেখে মেয়েটা যারপরনাই স্তম্ভিত। কি হল
মায়ের? এত টাকা পেয়েও সে কি খুশী নয়? মেয়ের এই চিন্তা অমূলক। মা বলল, ‘তুই ব্যাগটা
রেইখ্যে আয়। যেখান থেকে পাইসিলি, সেইখেনেই রেইখ্যে আয়।‘ মায়ের কথায় আরোই বেকুব বনে
গেল সে। এ মায়ের কি হল? রোজদিন তাদের নুন পান্তা ফুরোয়,
আর এদিকে যত্তসব গা জ্বালানি ঢং!
কিন্তু মায়ের মনে তখন ভাসছে সেদিনের কথা। সেই লোকটার কথা...
লোকটা ছিল এক সাধারণ
কর্মচারি। নৈহাটি জুটমিল। নিত্যনৈমিত্তিক কাজ ছিল সেখানে। এমনই একদিন অফিসে গিয়ে সে দেখে
অনেক লোক জমা হয়েছে মিলের গেটটার কাছে। হিন্দিতে কিসব বাকবিতণ্ডা করছিল ওরা। লোকটা কাছে যেতেই
জানতে পারল – মিলের গেটে তালা ঝুলেছে। এরপর অনেক আন্দোলন হয়েছে, অনেক চিৎকার
চেঁচামেচিও। ফলটা হল – মিলের তালা আবার খুলেছিল। আবার আশার মুখ দেখেছিল ওরা।
কিন্তু তা দিন
দশেকের বেশি নয়। লণ্ঠনের তেল ফুরিয়ে এসেছে, শুধু আশায় তাকে জ্বালালে হবে না। শেষ
নেভার আগে দপ করে জ্বলে ওঠে সেটা। তারপর আবার অন্ধকার – চিরতরে। লোকটা বাড়ি এল,
একরাশ হতাশা নিয়ে। বাড়ির সামনের রোয়াকটায় বসে বিড়ি ফুঁকছিল সে। তাকে সেদিন কিছু জিগ্যেস করবার সাহস হয়নি ওদের। কিন্তু ও এরপর দেখেছে উদ্ভ্রান্তের মত লোকটাকে ঘুরে বেড়াতে।
ঠিক এমন সময় ওর জ্বর এল। আর এল তো এল,
কিছুতেই কমে না। ডাক্তার দেখে বলল, ‘মনে হচ্ছে টাইফয়েড হয়েছে। কিন্তু আমি ঠিক সিওর
নই। এই কতকগুলো টেস্ট লিখে দিলাম, এগুলো করিয়ে সামনের সপ্তাহেই দেখা করবেন’। কিন্তু
ব্যস, ঐ অব্দিই। টেস্ট হল না। আর ওষুধও পড়ল না পেটে। আর পড়বেই বা কি করে? সামান্য
বেঁচে থাকাটাও যে তখন ধার করে। যদিও ততদিনে মা বাড়ি বাড়ি কাজ ধরেছিল। আর লোকটা
চাকরি খুইয়ে তখন মুদির দোকানের কর্মচারি। এখন তাদের টাকার দরকার, বেশ কিছু টাকা।
অনেকগুলো টেস্ট করাতে হবে।
উপায়ান্তর না থাকায় এক বন্ধুর কাছে
গিয়েছিল লোকটা। একমাত্র মেয়ে। কি করে
অবহেলা করে সে তাকে? তো যার কাছে হাত পাততে সে গিয়েছিল সে তার ছোটবেলাকার বন্ধু,
যারা নাকি সবথেকে কাছের হয়। কিন্তু ব্যাপারটা অত মধুর হয়নি তার কাছে। প্রথমে সে তো দেখাই দিতে চায়নি। তারপর যা হোক
করে বাড়িতে ঢোকা গেল। বন্ধু গদিওয়ালা চেয়ারটাতে গা এলিয়ে গোল্ডেন ফ্লেকে একটা
সুখটান দিয়ে বলে, ‘নাও শুরু কর। তবে আমার কিন্তু ভাই সময় বেশি নেই। যা বলবার তাড়াতাড়ি বলতে হবে’।
মুখময় খোঁচা খোঁচা
দাড়ি, একটু হাত বুলিয়ে সে বলে, ‘আসলে হয়েসে কি জান তো। আমার মেইয়েডার খুব অসুখ। ডাক্তারে কইসে টাইফয়েড।
টেস্ট করতি হবে। আমি বলছিলাম কি, যদি
ক’টা টাকা ধার দিতি পার। আমি তোমার টাকা ঠিক শোধ করি দিব’।
বন্ধু খানিকক্ষণ চিন্তা করে। তারপর কপালে ভাঁজ ফেলে বলে, ‘দেখ এখন আমার নিজের কাছেই এখন বেশি টাকা নেই।
তুমি বরং কাল এসো। ঠিক আছে? আর কাল যদি না হয় রবিবার তো পাচ্ছই’। বন্ধুর কথাগুলো নির্দ্বিধায় নির্দয়ভাবে বেরিয়ে
আসে।
এখান থেকেও কিছু হল
না দেখে ওর বাবা বেশ নিস্তেজ হয়ে পড়ল। বাড়ি ফিরে ঘনঘন
পায়চারি আর মুখের দাড়িগুলোতে হাত
বোলাচ্ছিল সে বারবার।
তবু হাল সে যখন ধরেছে, ছাড়বে না সহজে। কথামত পরেরদিন সে আবার হাজির আগের ডেরায়। সেদিন বাড়িতে ছিল না কেউ। দ্যাবা-দেবী তখন অফিসে।
এক আশি বছরের বৃদ্ধা মা। বৃদ্ধাশ্রম থেকে কয়েকদিনের জন্য বাড়িতে এসেছেন।
আতিথেয়তাটা বেশ ভালই ছিল তার। চা পেল, পেল বিস্কুটও। মনটা ভারি খারাপ লাগছিল রুগ্ন
ছেলেদুটার আর জ্বরে-ধরা মেয়েটার কথা ভেবে। বুড়ি ফোন করল ছেলেকে, ‘কখন আসবি
বাবা? তোর একটা বন্ধু এসেছে, কি যেন নাম?’
-অ্যাঁ!
-অ্যাঁ! বলিস কি রে?
মিনিট দুয়েক পরে সেই বুড়ির গলাতেই কি
তেজ! ‘বেরিয়ে যাও বাড়ি থেকে, কোন আক্কেলে তুমি ঢুকেছ
এখানে?’ থতমত খেয়ে বিস্ময়ে তার যুক্তি, ‘আমাকে তো আজকেই আসতে বলেছিল অমুক। তাই দেখা করতে এসেছি’।
-‘না কেউ আসতে বলেনি। ব্যাটা
বেরও এখন’।
কিন্তু শূন্য হাতে
ফিরতে সে তো আসেনি। তার মেয়ের জীবন মরণ সমস্যা। কিছু তো একটা তাকে করতেই হবে। একটা
ছোট পাথরের মূর্তি। টিভির পেছনে পড়ে আছে অযত্নে। ধুলোমাখা, বোঝা যায় অনেকদিন কেউ
ব্যবহার করে না সেটা। অনেকক্ষণ ধরে নজর করছিল সে।
পরের দিন কাজের লোক
আসতেই হুলুস্থুলু কাণ্ড। কি হয়েছে, কি হয়েছে। না দশ বছর আগেকার সেই মূর্তিটা
হাওয়া, টিভির পেছনে ছিল ওটা। আসলে অন্য কারুর নজরেই আসেনি সেটা। ফেলে দেওয়া হয়েছিল
অপদার্থ হিসেবে। তাই কাজের মাসিরও একটা স্বপ্ন ছিল ওটাকে ঘিরে। কিন্তু কে তার সেই প্ল্যান ভেস্তে দিল? পেলে তাকে হুল না দিয়ে সে ছাড়বে না।
বুড়ি মা বলল, ‘এ
ক’দিন বাড়িতে তো কেউ আসেওনি রে। এক তোর ঐ বন্ধুটা...কি যেন নাম?’
নামটা মনে পড়তেই
চমকে উঠল গৃহকর্তা কাম বন্ধু।
জেলে যেতে পারত
বাবা। অন্তত কেসটা সেইভাবেই সাজানো হচ্ছিল। কিন্তু বাদ সাধল সেই বন্ধুই। বাড়িতে এসে সে মাতৃভাষায়, নানান অভিধায়
বর্ষণ করে গেল। যা কোনদিন তার ছেলেটা কিংবা মেয়েটা শোনেনি। অথচ বাবা তাদেরই সামনে অপমানিত হচ্ছে।
সেদিন রাতে খুব বমি
করল বাবা। কিছুক্ষণের মধ্যেই অজ্ঞান হয়ে যেতে লাগল। তারপর হঠাৎই হার্ট অ্যাটাক।
বাঁচানো যায়নি তাকে।
হাল্কা হাল্কা
স্মৃতি, খুব ধূসর। তবু এখনও আঁচড় কাটে তার মনে। মায়ের কথাগুলোতে তার মনে ছবি এঁকে
দিয়ে যায় কেউ। ‘তুই ওটা রেইখ্যে আয়। ওগুলোতে আমাদের কোন কাম নাই।‘ মায়ের সিদ্ধান্ত
দৃঢ়।
মেয়েটা তবু ভাবে।
তার যে শখ খুব বড় বাড়িতে সে থাকবে। অনেক টাকা ... অনেক স্বপ্ন যে তার। মায়ের
কথাগুলো এমন বিষমাখা কেন? না, কিছুতেই না। সে এই টাকাগুলো কিছুতেই ছেড়ে দেবে না। কাউকে জানাবে না সে।
গয়নাগাঁটি বিক্রি করে সে টাকা নিয়ে আসবে। অনেক টাকা আনবে। তারপর অনেক বড় বাড়ি করবে...
‘হ, সেই ভাল।‘ মেয়ের
কথায় অনেক ভর্সা পায় মা।
* * *
মেয়েটা চলে গেল। হাঁটতে হাঁটতে...। স্বর্ণকারের দোকান, তমুক জুয়েলার্স। একটা
মোটা গোঁফওয়ালা, হৃষ্টপুষ্ট চেহারা, গায়ের রঙ
অন্ধকার রাত।
একটু কাছে এগোতেই সে চিনতে পারে মৌয়ের বাবাকে। ও আগে যে বাড়িতে থাকত, সেখানের
প্রতিবেশী। স্বর্ণকার দোকানির সাথে বসে ল্যাদ খাচ্ছে। এখন সে এখানে কেন? মনটা
চিড়বিড়িয়ে ওঠে তার। কিচ্ছুটি করবার নেই। তার কেমন যেন ভয় ভয় করতে লাগল।
কারণ মৌয়ের বাবা
পুলিশে কাজ করে। গয়না বিক্রি করতে গেলেই কি না কি জিগ্যেস করবে।
পেটের কাছে একটা ব্যথা, ভয়ের ব্যথা। বুকে ধুকুপুকু। ‘এ লোকটা মহা খচ্চর,
পরে আসব’ মনকে বলতে থাকে সে। কিন্তু বারবার মনে হচ্ছে, গোঁফওয়ালাটা তাকেই যেন
দেখছে। দোকানের সামনে রাস্তা, রাস্তার ওপারে সে। সে দেখছে, ঘাড় ঘুরিয়ে অত কি দেখছে
রাস্তার এদিকে? খেয়াল পড়ে, হাতে তার ব্যাগ। ব্যাগটাই
কি দেখছে মৌয়ের বাবা?
লোকটা উঠে আসে। তারপর রাস্তায় নামল। রাস্তা পারও হল তারপর। ‘কি রে, কেমন আছিস? অনেকদিন তোকে
দেখিনি তো? বাড়ির খবর সব ভাল তো?’ মৌয়ের বাবার
এতগুলো কথাতেও
মেয়েটার মুখে রা কাড়ে না। অপ্রতিভ হয়ে সে মাথা নাড়ায়, সব ভাল।
সব ভাল। তারপর পা চালায়,
থানা।
* * *
‘কোত্থেকে বললি? ব্রিজের তলা থেকে? বাঃ, বেশ ভাল। তুই তো দেখছি গুড গার্ল। তা
নিয়ে এলি যে? ভাল লাগেনি বুঝি জিনিসগুলো? হাঃ হাঃ হাঃ।‘ পুলিশকাকুর হাসিতে কান্না
আসে তার। তবু ব্যাগটা দিতে পেরে কেমন যেন হাল্কা লাগে। মায়ের কথা শুনেছে বলে নয়,
মৌয়ের বাবা তাকে দেখেছে, অনেক লোকই তাকে দেখেছে...। একটা ভয় তো
তার ছিলই। বাবার
ঘটনাটা বারবার তাকে অন্য দুনিয়ায় নিয়ে যাচ্ছিল। বারবার বাধা পাচ্ছিল সে। হাজার হোক এও তো একটা চুরি।
থানা থেকে বেরোতেই ধাক্কা খেল সে একটা লোকের সাথে, ‘আঃ দেখে চলতে পারেন
না?’ ঝামটা দিয়ে ওঠে সে। মেজাজ যে তার এখন
তিরিক্ষে।
‘ওঃ সরি’। বলে লোকটা হন্তদন্ত হয়ে থানায় ঢুকে যায়। ভেতরে ঢুকে জিগ্যেস করে, ‘আচ্ছা, একটা মিসিং
ডায়রি করব।’
(২)
(দু’মাসের বেশি কেটে গেছে)
রুকুদের বাড়ি থেকে চিৎকারের আওয়াজ আসছে। আমার আপনার হয়ত তাতে খারাপ লাগতে
পারে। কিন্তু কিই বা আর করা যায় বলুন। আশেপাশের সকলে বলতে বলতে এখন যে যার মত কান
চাপা দিয়েছে। প্রথম প্রথম সত্যিই আমাদেরও সহ্য হত না, কি করে মারে? কি করে মারে
একরত্তি মেয়েটাকে? তবু মেয়েটাকেও দুষি। বলি কেন, কিসের পিরীতে সে এখান ছেড়ে নড়ে
না? আরে বাবা, এখন এই যুগে ঘর ঘর কাজের মাসি, পিসি, দিদি দরকার হয়ে পড়েছে। একটায়
না পোষালে অন্যটায় দেখতে ক্ষতি কি?
হু হু বাবা, সেও সেয়ানা মাল। দেখেছে বড় ঘর। দুচার পাইস এদিক ওদিক থেকে
ম্যানেজ করা যায়; ছড়িয়েই তো থাকে কত। এই যেমন আজকের বাণিজ্যে মিলেছে
একটা ঘড়ি, কম্পিউটারের পাশে পড়ে ছিল নয় নয় করে দশ বারোদিন। ফেড হয়ে গেছে গোল্ডেন
রিম, ব্যাণ্ডটাও ছেঁড়া, তবু তাই সই। দোকানে দিলে এখুনি সে তার একমাসের মাইনে
জুটিয়ে দেবে।
কিন্তু সেদিন হল চূড়ান্ত। রুকুর মেয়েটা ঘুমিয়ে ছিল খাটে। তার ওপর দায়িত্ব ছিল মেয়েটাকে দেখার। আসলে রুকুর মেয়েটা এখনও হামা দিতে
শেখেনি। ঘুম থেকে উঠেই তার কাজ হচ্ছে এদিকওদিক
এপাশওপাশ করা। এইভাবে সরতে সরতে সে খাটের একধারে চলে আসে। তারপর পপাত ধরণীতলে।
একবার নয় দুবার নয়, কম করেও চার পাঁচবার সে খাট থেকে পড়েছে। এখন আর
তাই রুকু মেয়েকে ছেড়ে যায় না। গেলেও ওর ওপর দায়িত্ব দেওয়া থাকে। যেমন আজ। রুকু
স্নান করতে গেছিল। তাই ও পাশে বসেছিল।
‘এই আমার পাজামাটা কোথায় রে?’ গলা শুনে সে ঠিক
বোঝে এটা মেসোর ডাক। তার জামাটা এক্ষুণি বের করে দিতে হবে। নইলে ক্যাটক্যাট
ক্যাটক্যাট করেই যাবে।
উফফফ বলে সে উঠে আলমারিটা যেই খুলেছে। অমনি ‘ধপাস’
করে শব্দ। তারপরেই শুরু বিকট আওয়াজে কান্না। কান্নায় চমকে উঠে দেখে রুকুর মেয়ে
মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। দৌড়ে গিয়ে সে কোলে তুলে নেয় বাচ্চাটাকে। কিন্তু ততক্ষণে তো যা হবার হয়ে গেছে। রুকু কোনরকমে ম্যাক্সি
গলিয়ে চলে এসেছে। স্নানের জল ঝরছে গা থেকে।
‘এ কি রে? কি করলি তুই? হতচ্ছাড়া। মেয়েটাকে দেখতে
বললাম, তুই সেটুকু কাজ পর্যন্ত ভাল করে করতে পারিস না?’
মেয়ে কেঁদে চলেছে তার মত। রুকু একের পর এক কিল চড়
লাথি ঘুসি যা পারে চালাতে থাকে ওর ওপর। একটাও বাইরে যায় না। মারতে মারতে হাতের কড়ে
আঙুলে, হাঁটুতে কালশিটে পড়ে যায় তার। সেদিন খুব কেঁদেছিল সে। তক্ষুণি ওবাড়ি ছেড়ে
চলে এসেছিল। আর যায় নি সে।
আসলে তার যে শখ ছিল সে অনেক বড় বাড়িতে থাকবে।
কিন্তু কি করে থাকবে? সেখানে তো কেউ তাকে চায় না। কেউ তাকে আশ্রয় দেয় না। এর চেয়ে
তার নিজের বাড়িই ভাল ছিল। হোক সে ছোট, কিন্তু তবুও অনেক ভাল। কথাগুলো এতদিনে মনে
হয় তার। আবার বাড়ির দিকে ফিরতে চায় সে। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। পশ্চিম আকাশে সূয্যি
তখন ডুবিডুবি।
সে বাড়ি পৌছল। কিন্তু বাড়িতে কেউ নেই। অরবিন্দ
পল্লীর এই গলিটাতে সারি সারি ছোট বাড়ি। এখনও কুঁড়েঘরের থেকে এগোতে পারেনি এরা।
পয়সাকড়ির অভাবেই। গলি শেষ হতেই একটা পচা ডোবা। তার ধারের বাড়িটাতে দরজা নেই।
জানলাগুলোর একটাও পাল্লা নেই। শিকগুলোও হাওয়া। কি করে হল এই অবস্থা?
মনে পড়ে মায়ের সাথে ঝগড়া করে বাড়ি থেকে চলে গেছিল
সে। আর করবে নাই বা কেন? কি সুন্দর একটা ব্যাগ সে পেয়েছিল। সেটা তো ধরতে গেলে
মায়ের জন্যই পুলিশের হাতে তুলে দিতে হয়েছে। তার না কত স্বপ্ন ছিল ঐ টাকাগুলো নিয়ে।
সেইদিনই বাড়ি ফিরে মায়ের সাথে তাই তার তুমুল ঝগড়া। তারপর বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছিল
সে। অনেক কষ্টের শেষে একটা কাজও পেয়েছিল রুকুদের বাড়ি। সেখানেই সে থাকত। সেখানেই
সে খেত। বড় বাড়ির মালিক তো আর সে হতে পারবে না। তাই সেই বাড়ির চাকর হয়ে থাকাও ভাল।
বাড়ির আর কোন খোঁজই আর নেয়নি সে। এখন চিন্তা হয় কি
করবে সে? কোথায় যাবে? কেই বা আশ্রয় দেবে তাকে?
ঠিক এমনই সময় কেউ তার কাঁধে হাত রাখল।
চমকে উঠে পিছনে তাকিয়ে সে দেখে অপরিচিত এক লোক।
মুখ ভর্তি কাঁচাপাকা দাড়ি, চোখে মোটা পাওয়ারের চশমা। রোগা টিঙটিঙে চেহারা।
মিটিমিটি হাসছে। তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে স্থির। মেয়েটা ভয় পেয়ে গেল। কে এই লোক?
কিন্তু সে কিছু বলবার আগেই লোকটাই বলে উঠল, ‘আমাকে
দেখে ভয় লাগছে? ভয় পেয়ো না। তুমি আমাকে চিনবে না। কিন্তু আমি তোমাকে অনেকদিন ধরে
খুঁজছি’। বলতে বলতে লোকটা ভাবের গভীরে ঢুকে যায় যেন।
‘একটা ব্যাগ। আমার ঐ ব্যাগটাতে অনেক টাকা ছিল,
অনেক গয়নাগাঁটিও। মেয়ের বিয়ের জন্যে নিয়ে যাচ্ছিলাম। কি করে জানি, ব্যাগটা পড়ে
গেল। পরে খুঁজেই পেলাম না। পুলিশ মিসিং ডায়রি করতেই দেখি ব্যাগটা সেখানে হাজির।
‘পুলিশকে আমি জিগ্যেস করি, কে দিয়েছে এই ব্যাগটা?
ওরা বলে, এইমাত্র একটা মেয়ে বেরিয়ে গেল – সেই তো দিয়ে গেল। আমি তক্ষুণি ছুটে
গেছিলাম। কিন্তু কোথাও পেলাম না তোমায়। এরপরেও তোমাকে খুঁজেছি।
‘খবর পেয়েছিলাম, তোমাদের বাড়িটা এখানেই। গত পরশুদিন আমি প্রথম এসেছিলাম এখানে। কিন্তু এসে দেখি,
তালা ঝুলছে। ভেবেছিলাম বোধহয় কিছুক্ষণ পর খুলবে। কিন্তু কোথায় কি? দুঘন্টা ঠায়
দাঁড়িয়ে থেকেও যখন কেউই বাড়িতে এল না। আমি চলে গেলাম।
‘কিন্তু আশা ছাড়িনি। প্রতিদিনই আমি আসতাম। কেন
জানি মনে হত, একদিন না একদিন দেখা ঠিক হবেই। কালও এসেছিলাম। কাউকে না পেয়ে ফিরে
গেছিলাম। পাশের বাড়ি থেকে খবর নিয়ে আজ জানলাম, এ বাড়িতে এক মহিলা থাকতেন। তার দুই
ছেলে আর এক মেয়ে। মেয়েটা কয়েকদিন আগে থেকে বেপাত্তা। হয়ত কোন ছেলের সাথে পালিয়েছে।
আর ছেলেদুটো তো কাজের জন্য কোথায় গেছে তার ঠিক নেই। মা এই বাড়িতে একা একা ছিল।
তারপর একদিন সেও যে কোথায় চলে গেল কেউ জানে না।
‘আমি আজকে ফিরেই যাচ্ছিলাম। হঠাৎ এ বাড়ির সামনে
কাউকে দেখে আমার ভারি অবাক লাগে। তাই দেখতে এলাম। এসে দেখি, হ্যাঁ তুমিই তো।
তোমাকেই তো আমি থানায় দেখেছিলাম। মনে আছে?’
প্রশ্ন করে থেমে যায় লোকটা। মেয়েটা আস্তে আস্তে
মাথা নাড়ায়, ‘হুম, আমিই ব্যাগটা থানায় দিয়ে এসেছিলাম’।
লোকটা আনন্দে জড়িয়ে ধরে মেয়েটাকে, ‘সোনা মেয়ে,
লক্ষ্মী মেয়ে তুমি। তোমায় অনেক অনেক আশীর্বাদ করছি। তুমি অনেক বড় হবে। অনেক’।
তারপর একটু থেমে বলে, ‘তুমি যে আমার কি উপকার করলে তা তো জানই না। মেয়ের বিয়েটা যে
দিতে পেরেছি সে তো তোমারই জন্য। ভগবান তোমার কল্যাণ করবেন মা’।
কিন্তু মেয়েটা তখন ভেবে চলেছে অন্য কথা। সে যে
ব্যাগটা থানায় দিয়েছে, সে তো তার মায়ের কথাতেই। মা তাকে না বললে লোকটা তো কোনদিনও
ঐ ব্যাগটা পেত না। তাই যা কৃতিত্ব, তা তো তার মায়ের।
লোকটা বলে, ‘কি ভাবছ অত?’
মেয়েটা শুষ্কভাবে বলে, ‘আমার মা কোথায়? খুঁজে
পাচ্ছি না। মাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে জানেন?’
লোকটা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর সে কথার উত্তর
না দিয়েই বলে, ‘তুমি এখন কোথায় থাকবে?’
মেয়েটা নিরুত্তর। তাকে দেখে লোকটা বলে, ‘এসো আমার
সাথে। আমার স্ত্রী তোমাকে দেখতে পেলে খুব খুশি হবে’। এই বলে সে মেয়েটার হাত ধরে,
তাকে নিয়ে এগোতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে
তারা বেরিয়ে যায় গলিটা ছেড়ে। মেয়েটা তখনও ভেবে চলেছে তার মায়ের কথা। কিন্তু কি আর হবে ভেবে। যা হবার তা তো হয়েই
গেছে। আর আজ হয়ত এখান থেকে সে চিরদিনের মতই চলে যাচ্ছে। তার পাড়া, তার
প্রতিবেশী...
মেয়েটা লোকটার পিছু পিছু চলতে থাকে নির্বাক। বড়
রাস্তায় এসে পড়ে তারা। লোকটা দেখে মেয়েটা তার সাথে কিছুতেই সহজ হতে পারছে না। সে
বলল, ‘আমার ঘরে থাকতে তোমার কোন অসুবিধা হবে না। অনেক বড় বাড়ি আমার। অনেক ঘর।
গাড়িও আছে। তুমি আমার ঘরে কাজ করবে। সেখানেই থাকবে। আর চিন্তা কি? আর ইচ্ছে হলে
নিজের বাড়িতে এসে দেখে যাবে, তোমার মা এল কিনা। কেমন?’ মেয়েটা তবু নিরুত্তর। এক পা
এক পা করে সে হেঁটে চলেছে। অত্যন্ত ধীরে ধীরে।
হঠাৎ পেছন থেকে কার ডাক। মেয়েটার নাম ধরে ডাকছে।
সুতীক্ষ্ণ গলার আওয়াজ। মেয়েটা চেঁচিয়ে উঠল, ‘মা ডাকছে’। এই বলে সে লোকটার হাত ছাড়িয়ে ছুটে যেতে লাগল তার বাড়ির গলির দিকে। যেখান থেকে
তার মায়ের গলা আসছে।