ট্রেনে যেতে যেতে শুনছিলাম, পকেটমারের
কাহিনী। এক পকেটমার কিভাবে চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে আর তারপর তার ভাগ্যে কি পরিমাণ গণধোলাই
পড়ে – তারই ইতিহাস। ওরা বলছিল, যেভাবে ট্রেনের লোকগুলো চোরটাকে মেরেছে তাতে আমরাও
নাকি মরে যেতাম। মাটিতে ফেলে ওকে প্রায় আধঘণ্টা পিটিয়েছে। শুনছিলাম আর মনে মনে
কেবল ভাবছিলাম একটাই কথা, এই পকেটমার, যে হয়ত নিজের একদিনের গরিবি ঘোচাতে দশ বিশ
টাকা চুরি করেছিল, তাকে একলা পেয়ে যত সব বীরপুঙ্গবরা কতই না সাহসিকতার পরিচয়
দেখাচ্ছে। আর যখন দেশের বড় বড় রাষ্ট্রনায়করা নিজের দেশটাকেই কর্পোরেটের হাতে বিক্রি
করে দেয় তখন কোথায় থাকে এদের বীরত্ব? বরং তারা তো আবার সেই নেতাগুলোকেই ভোট দেয়,
যারা দেশের সবথেকে বড় সর্বনাশ করে চলেছে। পাড়ায় ছিঁচকে চোর যখন চুরি করে তখন তাদের
গায়ে হাত তুলতে তথাকথিত ভদ্দরনোকেদের এতটুকু বাধে না, অথচ মোদি যখন বিহারে ভাষণ
দিতে দিতে উদার হস্তে কোটি কোটি টাকা বিলি করবার (যেন ওর বাপের টাকা!) তথাকথিত
প্রতিশ্রুতি দিয়ে যায়, তখন সেই সাধু লোকগুলোই কিন্তু তাকে ভোট দিয়ে জেতায়। প্রচারের
ফলে নেতামন্ত্রীরা আজ গদিতে, আর চোর বেচারি শুধু ‘চোর’ হওয়ার কারণে, আমাদের
ভদ্রজনোচিত ধারণার আয়ত্তের বাইরে যাওয়ার কারণে, দরিদ্র আর তার ফলে অসহায় হওয়ার
কারণে মাটিতে পড়ে মার খায়। পরে জেনেছিলাম, ঐ চোরটার কাছে কিন্তু কোন চৌর্য দ্রব্যই
পাওয়া যায়নি। এটাই হল আমাদের সভ্যতার মজা!
শুনছি, টিটাগড়ের লোকগুলোই নাকি এইসব অপরাধ
প্রবৃত্তির সাথে যুক্ত, আর তাই এই অঞ্চলটাই চোরের জন্ম দেয়। আর দেখুন কি আশ্চর্য,
সেই টিটাগড়ে যখন একের পর এক মিল বন্ধ হতে থাকে, তখন কিন্তু কেউ ফিরেও দেখে না।
শোরগোল ফেরা তো দূরস্থ। এমনকী খবরের কাগজে এ নিয়ে দু-একটা ছোটখাট প্রতিবেদন
বেরোনোর সম্ভাবনাও খুব কম। আবার, মিল বন্ধের জেরে তারা বনধ করলে ভদ্রলোকেদের
অসুবিধা হয় – তাই পুলিশ তাদের প্রতিবাদের এই ন্যুনতম পথটুকুও বন্ধ করে দেয়। আরো
অবাক হয়ে ভাবি, এইসব ছিঁচকে চোরের গল্প, পকেটমারের গল্প আমি ট্রেনেবাসে অনেক
শুনেছি। কিন্তু কোথাও শুনিনি এদের তৈরি হওয়ার গল্প। কোন এক রূপকথায় পড়েছিলাম, এদের
নাকি কোন স্কুলে পড়ানো হয়, সেখান থেকেই এরা চুরিবিদ্যা শেখে। হাঃ হাঃ। সে কথা
রূপকথার বইতেই বন্দী থাক। কোথায় কোন বিহারে বাস্তবেও বোধহয় পাওয়া গেছিল এমনিই একটা
স্কুল।
সংখ্যাগরিষ্ঠ চোরদের তৈরি হওয়ার কথা তা
সত্ত্বেও কিন্তু আমাদের অনজরেই থেকে যায়। হয়ত আমরা তা ভেবেও দেখি না। এই তো গতকাল
শুনছিলাম নৈহাটির হুকুমচাঁদ জুটমিল বন্ধ হয়ে গেল। দুহাজার কর্মী এতে বেকার হয়ে
পড়ল। আপনারা সে খবর পাননি হয়ত। পাওয়ার কথাও নয়। দু-একটা খবরের কাগজে এ খবরটা ঠাঁই
পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে। তাও কোণেখাঁজে কোথায় যে লুকিয়ে আছে, তা খুঁজে পাওয়াও
অনেক কষ্টের কথা। মাত্র দুহাজার সাধারণ মানুষের জীবন তো। তা নিয়ে আর কে ভাবে? দেশে একশো কুড়ি কোটি লোক। তাই ওদের কথা আমাদের মনে না করলেও চলবে।
ফ্লিপকার্ট পুজোয় কোটি টাকা লাভ করবে, সে খবর আপনারা নিশ্চয়ই পড়েছেন। পড়ারই কথা,
ফ্লিপকার্টে, অ্যামাজনে কেনাকাটিও শুরু করে দিয়েছেন নিশ্চয়ই। পুজোতে ছেলেমেয়েকে,
আত্মীয়স্বজনকে গিফট দিতে হবে যে!
দুঃখ তো তাদের, পুজোর ঠিক আগে যাদের কপালে
এই মারণকোপ জুটল। অনিশ্চয়তা তাদের এখন নিত্যসঙ্গী। আমি ভাবি, তাদেরও তো পরিবার
আছে, আত্মীয়স্বজন আছে। তাদের ওরা কি উপহার দেবে? আমি জানি আপনারা আমার কথা শুনে
হাসছেন। ভাবছেন, আমি পাগলের মত এইসব কথা লিখছি কেন? কি আসে যায় আমার ওদের নিয়ে? এই
এখন এই পুজোর মরসুমে এইসব বাজে না ভেবে পুজোর আনন্দটাকে নিয়েই বাঁচা ভাল নয় কি? ঠিকই
বলেছেন, আর সত্যি কথা বলতে কি এইসব নিয়ে ভাবতাম না আমিও এতদিন। কিন্তু কি জানেন তো, গতকাল কাগজে খবরটা পড়েই আমি কিরকম চমকে উঠেছিলাম। আসলে আমার একটা
বন্ধু ওখানে কাজ করত তো। তাই হঠাৎ করে মনে
পড়ে গেল ওর কথা। ও বেচারি ওখানে ঠিকে শ্রমিকের কাজ পেয়েছিল। ওর সাথে ক্লাস ইলেভেনে, ট্যুয়েলভে অনেকদিন পড়েছি। তারপর কি করে একদিন
যোগাযোগটা হারিয়ে গেছে। অনেক দিন দেখা হয় না ওর সাথে। কথাও হয় না আর। তাই জানি না এখন
ও কেমন আছে? কেমন আছে ওর বৌ আর ছেলে? ওরা কি করবে? জুটমিল বন্ধ হয়ে গেল বলে
আন্দোলন করবে? নাঃ, তাহলেই তো রাস্তায় জ্যাম হবে, আমাদের যেতে অসুবিধা হবে। তাহলে
বনধ? নাঃ, বনধ কালচারও উঠে গেছে। আমাদের এখানে এখন কর্মসংস্কৃতি উন্নত হচ্ছে যে। তাহলে আর কি উপায় আছে? এক অভাবে সংসার চালানো ছাড়া? আর এই অভাবের তাড়নায় ও-ও যদি একদিন এই
চুরির রাস্তা বেছে নেয়? ধরা যাক, নিতান্তই দায়ে পড়েই নিল? আর সে যদি আমার বাড়িতেই
একদিন আসে চুরি করতে? তখন আমি কি করব? কোন পক্ষে যাব? বন্ধু বলে বিলিয়ে দেব আমার
সম্পত্তি? নাকি, ভদ্রলোকের মত রাস্তায় বের করে ওকে মাটিতে ফেলে পেটাব? ঠিক বুঝতে
পারছি না। একটা সমাধান চাই।