পৃষ্ঠাসমূহ

শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর, ২০১৩

আত্মসমর্পণ

সকাল ন’টার জানান দিয়ে ঘড়িতে ঘণ্টা পড়ে ঢং ঢং ঢং। বিছানায় বসে খবরের কাগজের পাতা ওলটাচ্ছিল প্রিয়তোষ। অন্যমনস্কভাবে জিজ্ঞাসা করে, ছেলে জামাকাপড় পড়ছে? পাশে বিরাট বড় একটা আয়নার সামনে ড্রেসিং টেবিল সাজাতে সাজাতে প্রিয়তোষের স্ত্রী ইন্দ্রাণী মাথা নাড়ায়, না:, ও বোধহয় এখনও বই নিয়েই ব্যস্ত। সামনেই ছেলেটার পরীক্ষা। মূহুর্তে মুখের ভাব পাল্টে যায় প্রিয়তোষের, সে কি? রাগে চীৎকার করে ওঠে প্রিয়তোষ। হাতের কাগজখানা ছুঁড়ে ফেলে বিছানার এক কোণায়। তারপর চশমাটা বিছানায় নামিয়ে রেখেই দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সে। তার এই উত্তেজনায় উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে ইন্দ্রাণী। তুমি ওকে কিছু বোলো না। ও যা করতে চায় করুক। ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়া স্বামীর দিকে কথাগুলো ব্যর্থভাবে ছুঁড়ে দেয় স্ত্রী।
পাশের ঘরে একটা সরু তক্তার ওপর বসেছিল হিতেন, গভীর মনোযোগ নিয়ে বইয়ের দিকে তাকিয়ে। দরজার উল্টোদিকে মুখ করে বসেছিল সে। বাবার ঘরে ঢোকা তাই জানতে পারেনি। তবে অচেনা এক অনুভূতি দিয়ে সে আন্দাজ করেছিল। বাবা ঘরে ঢুকেই ফেটে পড়ে, এখনো রেডি হস নি কেন? কি ভেবেছিস কি তুই? বইয়ে মুখ গুঁজে হিতেন জবাব দেয়, সামনের মাসেই টেস্ট পরীক্ষা। পড়তে হবে অনেক। বাবা সেসবের তোয়াক্কা করে না। কেটে কেটে উচ্চারণ করে, তুই যাবি, কি যাবি না? ধৈর্য্যের একেবারে শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে বাবা। সেটা বেশ টের পায় হিতেন। তার মনে পড়ে, প্রায় দশ বছর আগে এমনই এক দিনে সে একবার বাবার কথার অবাধ্য হয়েছিল। ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙতেই বাবা তার গালে সপাটে মারল এক চড়। কিন্তু আঘাতটা বেকায়দায় লেগেছিল তার কানে। অসুস্থ বোধ করেছিল সে সেদিন। কান থেকে রক্ত পড়ছিল টপটপ। তারপর ডাক্তারবাড়ি, নার্সিংহোম ছোটাছুটি করে আজ এই দশ বছর বাদেও যন্ত্রণাটা তার কাটেনি। মাঝেমাঝেই কানের ভেতরটায় এখনও কটকটিয়ে ওঠে। সেই থেকেই বাবার অস্বাভাবিক রাগের ওপর দারুণ ভয় ছেলের। তাই এ দিন আর দেরী না করে দ্রুত সে সম্মতি জানায়। মাথা নেড়ে বলে, হ্যাঁ, বেরোচ্ছি। স্কুল ড্রেস হাতে নিয়ে বাধ্য ছেলের মত সে চেঞ্জ করতে যায়।
হিতেন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। সামনের মাসেই ওর টেস্ট পরীক্ষা। তাই পড়াশুনোর চাপ যে তার এখন তুঙ্গে, সেকথা অস্বীকার করা যায় না। তবু তাকে এখনই বেরোতে হবে। নইলে বাবা শুনবে না। তবে বাবার এই আচরণের পেছনে কারণ আছে, যদিও হিতেন তা মানে না। হিতেনের মনে কেন জানি না ভেসে আসে ক্লাস এইটের দিনগুলো। হিতেন চট্টোপাধ্যায় – এই নামটা ক্লাসে বেশ জনপ্রিয় ছিল। আর হবে নাই বা কেন? ফাইভ থেকে সেভেন অব্দি সে যে কোনদিনও থার্ড পজিশনের নিচে নামেনি। ওপরেও ওঠেনি যদিও কোনদিন। তিন বছর ধরেই সে থার্ড হয়ে এসেছিল। সবাই এতে বেশ আশ্চর্য্য হয়েছিল। কিন্তু সবাইকে আরো আশ্চর্য্য করে এইটের অ্যানুয়াল পরীক্ষায় সে সর্বপ্রথম ক্লাসের মধ্যে সর্বসেরা হল। রেজাল্ট বেরোনোর দিনটায় আনন্দে বিহ্বল হয়ে পড়েছিল সে। মনে পড়ে তার, সেদিন মা-বাবা-আত্মীয়-স্বজন-বন্ধু-বান্ধব সবাই তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। কত জনে কত উৎসাহ দিয়েছিল। কত কেউ বলেছিল, আরো এগিয়ে চল, কেউ বা, বাঃ, এই তো চাই। কেউ আবার, তুমি আমাদের মুখ উজ্জ্বল করবে – এই বলে শুভেচ্ছা জানিয়েছিল। তাদের অনেকেই যদিও আড়ালে অন্যরকম বলেছিল। হিতেন স্পষ্ট শুনতে পেয়েছিল, গার্জিয়ানদের মিটিং এ একজন বলছে, সুযোগ পেলে আমার ছেলেও ফার্স্ট হত। মাস্টারদের হাত করতে পারলে কি না হয়।
স্কুল ড্রেসে বাথরুম থেকে বেরিয়ে হিতেনের চোখে পড়ে খাওয়ার টেবিল। খাবার ঢাকা দেওয়া আছে। মনটা বিষিয়ে ওঠে হঠাৎ। একদম খেতে ইচ্ছে করছে না। খাবার টেবিলের দিকে এগোতে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে সে। বাবা পাশের ঘর থেকে চেঁচায়, তাড়াতাড়ি খেতে বস। আর আধঘণ্টার মধ্যে স্কুলে পৌছতে হবে।
ক্লাস নাইনের অ্যানুয়াল পরীক্ষা। পরীক্ষার হলে তার সামনে বসেছিল অনিরুদ্ধ। হিতেনের আগে ক্লাস সেভেন পর্য্যন্ত সেই ফার্স্ট হয়ে আসত। ‘এই অনি, দুইয়ের উত্তরটা চার হবে তো?’ – হিতেনের তর্জনীর খোঁচা খেতেই অনিরুদ্ধ ‘উফ’ করে শব্দ করে। ব্যাপারটা ইনভিজিলেটরের নজর এড়ায় না। ‘অ্যাই আস্তে। কি হচ্ছে কি? – বিরক্তির সুরে ধমকে ওঠে ইনভিজিলেটর পার্থ স্যার।  হিতেন জানতো অনিরুদ্ধ ঐ দুইয়ের অঙ্কটা পেরেছে। তার সংশয় ছিল। সে তারপর আর কিছু বলেনি। কারুর কাছ থেকে আর সাহায্যও চায়নি। একটা ব্যাপার তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। ক্লাসের কেউ কেউ তাকে হিংসা করছে। প্রথম প্রথম খারাপ লাগত তার। তারপর যখন নাইনের রেজাল্ট বেরোল ফার্স্ট বয়ের নাম আবার হল – হিতেন চট্টোপাধ্যায়।
অহঙ্কারসূচক একটা হাসি হেসে ভাতের গ্রাস মুখে তুলতে থাকে সে। এগিয়ে চলে সময়। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে নয় ছুঁতেই বাবা বেরিয়ে আসে পাশের ঘর থেকে। ‘আমিও যাব তোর সাথে’ – বলে চেঞ্জ করতে বাবা বাথরুমে ঢোকে। ভাতের গ্রাস তুলতে গিয়ে থমকে যায় হিতেন। বাবা কি তাকে সন্দেহ করছে? সে স্কুলে ঠিকমত যাবে কিনা সে নিয়ে বাবার সংশয় কি এখনো কাটেনি? কে জানে। কাটতে নাও পারে। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে।
মাধ্যমিক পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোনোর আগে সে একটু চিন্তিত ছিল। বন্ধুবান্ধব, পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন – সবাই তারই দিকে মুখিয়ে। ফার্স্ট বয় হিতেন এবার কেমন রেজাল্ট করবে? চেনা-পরিচিতের মধ্যে এটাই ছিল সবথেকে হট টপিক। তবে হিতেনের উদ্বেগের আরো কারণ ছিল। সে মাধ্যমিকের টেস্টে সেকেন্ড হয়েছে। চার নম্বরের জন্য ফার্স্ট পজিশনটা তার ফসকে গেছে। অনিরুদ্ধ পেয়েছে সেই পজিশন। কিন্তু এই পরীক্ষাতেও কি সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে? চিন্তাটা হিতেনকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছিল। মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোনোর দিন। স্কুলে যাওয়ার আগে সামান্য দুমুঠো ভাত মুখে তুলেছিল সে। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সবটা বমি হয়ে গেল। পেট তার খাবার চায় না, হয়ত সেও এখন শুধু রেজাল্টই চায়। স্কুলে পৌছতেই সে টের পেল, হাত-পা তার অবশ হয়ে আসছে। নোটিশ বোর্ডের পাশে নোংরা দেওয়ালটায় বিরাট গেজেট পেপার সাঁটা। রোল নম্বর আর তার পাশে প্রাপ্ত নম্বর। নম্বরগুলোর ওপর আঙুল বুলিয়ে নিজের রোল নম্বরটা দ্রুত খুঁজতে থাকে সে। পাশ থেকে অভিষেক এসে তার পিঠে একটা টোকা মারে, কি রে, কত পেলি? কিন্তু হিতেনের সেসবে কোন খেয়াল নেই। সে একমনে খুঁজে চলেছে তার নম্বর। খুঁজতে খুঁজতে এক জায়গায় থমকে যায় সে। ঘুরে দাঁড়িয়ে অভিষেককে বলে, স্কুলে হায়েস্ট কত রে? অভিষেক একটু চিন্তা করে জানায়, সাতশো চল্লিশ। হিতেন আবার নিজের রোল মেলায়। তার পাশে নম্বর দেখে, সাতশো চল্লিশ।
সাড়ে ন’টা বাজতেই সে রেডি। গোমড়ামুখে মা কে একবার ‘যাই’ বলে বেরোয় বাড়ি থেকে। মা বলে ওঠে, যাই বলতে নেই, বলো আসি। হিতেন তাই জানায় মৃদুস্বরে। মা বলে, অত মন খারাপ করার কিছু নেই। কিন্তু সে আর কোন উত্তর না দিয়েই বেরিয়ে আসে। পেছন পেছন আসে বাবা। সে জোরে হাঁটতে থাকে। পিছিয়ে পড়ে বাবা। মোড়ের মাথায় বাস। ফাঁকাই ছিল। জানালার ধারে সিট নিয়ে বসে হিতেন। মাথাটাকে নিস্পৃহভাবে এলিয়ে দেয়। মাধ্যমিকের পরে কি সুন্দর ছিল দিনগুলো। স্কুলে তার ফার্স্ট হওয়ার কথা মা পাড়ায় বলে বেড়াত, বাবা অফিসে। সবাই তখন দেখতে চায় হিতেনকে। মা ছেলেকে চুমু খেয়ে বলে, হিতু আমার। তুই আমার সোনার ছেলে। বাবা তার পিঠ চাপড়ে বলতো, আমাদের বংশে এরকম ছেলে এই প্রথম। সত্যি, ও আমাদের গর্ব। হিতেন জানত, তাদের বংশে কোন অনার্স গ্র্যাজুয়েটও নেই। ওর মা মাধ্যমিক আর বাবা উচ্চমাধ্যমিকটা পর্য্যন্ত গড়িয়েছে। আর যারা জ্যাঠা-কাকা-মামা-পিসি-মাসি তারাও তথৈবচ। কাজেই এ বংশে তার মত ছেলে যে একেবারেই অপ্রত্যাশিত তা তো বলাই বাহুল্য। তাই, আত্মীয়-স্বজন যারা কোনোদিন সম্পর্ক রাখতে চাইত না, তারাও যেচে যেচে তার সাথে কথা বলতে শুরু করল। প্রাইভেট স্যারেরা বলত, ওর মত ছেলে পেয়েছি আর চিন্তা কি? অন্যান্য ছেলেদের স্যারেরা  বলত, ওর মত ট্যালেন্টেড ছেলে খুবই দুর্লভ। স্বভাবতই, হিতেনের উৎসাহ এতে আরো বেড়ে যায়। তাকে আর পায় কে! সে শুধু একটাই কথা তখন ভাবত, এবার সে উচ্চমাধ্যমিকে স্ট্যান্ড করবে। এই স্কুলে তাকে কেউ হারাতে পারবে না। সেই স্কুলের একমাত্র ফার্স্ট বয়। আর দুর্ভাগ্যের কথা, মনে মনে এই কথাটাকেই সে প্রশ্রয় দিয়ে চলত।
তবু সবকিছুই হয়ত ঠিকই চলত। কিন্তু মাঝখানে কোত্থেকে এসে জুটল এক অপরাজিত। ক্লাস ইলেভেনে এই স্কুলে নতুন ভর্তি হয়ে এল সে। যেমনি স্মার্ট, তেমনি ভাল পড়াশুনোতেও। একটু অদ্ভুত টাইপেরও এ ছেলে। আর পাঁচটা ছেলের চাইতে বেশ আলাদা। অন্যান্য ছেলেদের পড়া বোঝাতে স্যারেদের যতটা সময় লাগত, একে তার সিকিভাগেরও কম লাগে। ফিজিক্স কিংবা ম্যাথমেটিক্স, কেমিস্ট্রি কিংবা স্ট্যাটিসটিক্স – যেকোনো বিষয় কিভাবে যে এত তাড়াতাড়ি ও ধরতে পারে তা সাধারণ ছেলেরা তো দূরস্থ, স্যারেরাও বুঝতে পারে না। অনেকে বলতে থাকে, ওর ব্রেনের গঠনটাই বোধহয় আলাদা। তাই হয়তো ওর বুদ্ধি এত বেশী। অথচ আরো আশ্চর্য্যের ব্যাপার, পড়া নিয়ে এ ছেলে একেবারেই উদাসীন। বন্ধুরা কোনোদিনও ওকে ওর বাড়িতে খুঁজে পায়নি। হয় রামুদার চায়ের দোকানে বসে আড্ডা মারছে, নয়তো কোন চুল্লু ঠেকে গেছে। আর তা না হলে মাঠে ব্যাডমিন্টন কিংবা ফুটবল খেলছে। ফার্স্ট বয় কি লাস্ট কারুর সাথে মিশতেই কোন দ্বিধা করে না সে। তাই এবার ধীরে ধীরে সকলেরই দৃষ্টি ঘুরতে থাকে এই অদ্ভুত টাইপের নতুন অতিথিটির দিকে। পড়াশুনোয় ফাঁকি মারছে দেখে অতীন স্যার একবার অপরাজিতকে বলেছিল, এত ফাঁকি মারিস কেন? ভাল করে পড়লে তুই যে কত বড় হতে পারিস তা আমাদের ধারণারও অতীত। অপরাজিত এর উত্তরে ক্যাজুয়ালি বলেছিল, আমার পড়াশুনো করতে ভাল লাগে না স্যার।
এ হেন ছেলে একদিকে যেমন সকলের নজর কাড়ল, তেমনি স্বাভাবিকভাবেই সে হিতেনের গলার কাঁটাও হয়ে উঠলো ধীরে ধীরে। হিতেন ক্লাসের ফার্স্ট বয়। তবু তাকে বাদ দিয়ে অন্য ছেলেকে নিয়ে সবাই বাড়াবাড়ি করে কেন? অনুপম স্যারও সেদিন বলছিল, তোমাদের ফার্স্ট, সেকেন্ড আর থার্ড বয়ের পাশে আরো একজন প্রতিযোগী এসেছে। এই আমাদের অপরাজিত। ও কিন্তু এবারে স্ট্যান্ড করতেই পারে। সত্যি বলতে কি, এ সব কথা একেবারেই ভাল লাগত না হিতেনের। আরো অসহ্য লাগত যখন স্যারেরা বলতে লাগল, অপরাজিত কিন্তু একেবারেই এক্সট্রাঅর্ডিনারি। কিন্তু হিতেনও যে সবার থেকে আলাদা? সে কথা তো কেউ বলে না। সে তাই নিজেকে বাকীদের থেকে আলাদা করে রাখত। তার জন্য সেকেন্ড বেঞ্চির ধারের সিটটা ঠিক হয়েই ছিল। সেকেন্ড বা থার্ড বয় ছাড়া তার পাশে কেউই বসত না। বা বলা ভাল অন্য সাধারণ ছেলে তার পাশে বসুক এটা সে-ই চাইত না। অন্য ছেলেরা টিফিন টাইমে যখন হৈ-হুল্লোড় করত, হিতেন তখন ফাঁকা ক্লাসরুমে শেলীর কবিতা পড়ে চলত একমনে। তাই দেখে একদিন অপরাজিত ওকে বলেছিল, কি রে সবাই খেলছে, তুই খেলবি না? হিতেন মুখ তুলে ওকে একবার জরিপ করার ভঙ্গীতে দেখে নিল। তারপর গম্ভীর গলায় বলল, আমি বাজে কারণে সময় নষ্ট করি না। অপরাজিত এরপর আর কিছু বলেনি। একটু অবাক হয়েছিল। তারপর হয়ত মনে মনে বলেছিল, এই কারণেই তোকে কেউ ঘাঁটায় না। তুই সবার থেকেই আলাদা।
বাস চলছে বেশ জোর। হাওয়ায় হিতেনের চুলগুলো উড়ে ওলটপালট হয়ে যায়। সুন্দর করে আঁচড়ানো ঘন চুল কাকের বাসার মতো এলোমেলো লাগে। ইলেভেনের অ্যানুয়াল পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোনোর আগে সে মনে মনে এ কথা বিশ্বাস করত যে ফার্স্ট সে ই হবে। এ বিশ্বাস তার আজকের নয়। অনেক দিন আগেকার। কবে থেকে যে সে এ ধারণাকে মনে ঠাঁই দিল আর কবেই যে তাকে বিশ্বাস করতে শুরু করল, তা সে নিজেই ঠিকমত জানে না। কিন্তু এটা বেশ বোঝে যে এই স্কুলে ফার্স্ট একমাত্র সেই হতে পারে। আর কেউ তার ধারেকাছে আসার যোগ্য নয়। হ্যাঁ, এটাই সত্যি। এভাবে নিজের মনে অনেক জোর পায় হিতেন। তার এই বিশ্বাস তাকে স্কুল পর্য্যন্ত পৌঁছে দেয় নিরাপদে। কিন্তু স্কুলে গিয়েই সে খবর পেল তার ফার্স্ট হওয়ার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। তাকে টপকে অপরাজিত হয়েছে ফার্স্ট। এমনকি সেকেন্ড পজিশনটাও কেড়ে নিয়েছে অনিরুদ্ধ। আর হিতেন হয়েছে থার্ড। রাগে দুঃখে চোখ ফেটে জল আসতে থাকে হিতেনের। তার এতদিনের লালিত বিশ্বাস কি করে ভুল হতে পারে? তার স্বপ্ন, আশা যাকে সে এতদিন ধরে প্রশ্রয় দিয়েছে, তা কি করে এত সহজে মিথ্যা হতে পার? তার ফার্স্ট হওয়ার চিন্তাই তো তাকে অনুক্ষণ বাঁচিয়ে রেখেছিল। তার লেখাপড়া, তার সাধনা সমস্ত কিছুতেই তো তার একটাই চিন্তা ছিল যে সে স্কুলের ফার্স্ট বয়। কিন্তু তা তো এত সহজে মিথ্যা হবার নয়। এ নিশ্চয়ই স্যারেদের কাজ। হিতেনের মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। তার মনের আজন্মলালিত বিশ্বাস নয়, বাস্তবেই কোথাও ভুল আছে। আর সেই ভুল স্যারেরাই করেছে। অপরাজিত আর অনিরুদ্ধ স্যারেদের হাত করেছে। তাই স্যারেরা ওদের অত প্রশংসা করে। নইলে হিতেন চট্টোপাধ্যায় কখনো থার্ড হতে পারে না। তার এই রাগে আরো ইন্ধন যোগ হয়, যখন সে শোনে পাশে তারই ক্লাসমেটেরা বলাবলি করছে, এবার হিতেন ফার্স্ট হতে পারল না। কি অবস্থা! সে স্পষ্ট বোঝে তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে সবাই একথা বলছে। তার ইচ্ছা হয় চেঁচিয়ে বলে, এসব কারচুপির ফল। অপরাজিত আর অনিরুদ্ধ দুজনেই স্যারেদের সাথে হাত মিলিয়েছে। তবে তারা তার আগে আসতে পেরেছে। হিতেন চট্টোপাধ্যায়কে হারানো অত সহজ ব্যাপার নয়। কিন্তু সে হয়ত ভুলে গেছিল, সে যখন ফার্স্ট হত, আশেপাশের লোকেরাও তার নামে এই একই অপবাদ রটাত।
বাস কন্ডাক্টর চেঁচাতে থাকে, লিচুবাগান, লিচুবাগান। বড় বিরক্তি লাগে হিতেনের। মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে তার। পাশে বাবা গম্ভীর মুখে বলে, চ, ওঠ। এরপরের স্টপেজেই তো নামতে হবে। এক পাও আর এগোতে ইচ্ছা করে না হিতেনের। মস্তিষ্কের প্রতিটা কোষ যেন তার বিরোধিতা করে চলছে। এই সবকিছুর জন্য দায়ী তার বাবা, নিজের মনে গর্জে ওঠে সে। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করতেই পরের স্টপেজ স্কুল। ভাটপাড়া অমরকৃষ্ণ পাঠশালা। আজ এখানে বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। হিতেন আগে থেকে ঠিকই করে রেখেছিল যে সে এখানে আজ আসবে না। কারণ হিতেন চট্টোপাধ্যায় কখনো থার্ড প্রাইজ নিতে পারে না। স্যারেদের কারচুপিতে সে থার্ড হয়েছে, সেও মানা যায়। কিন্তু প্রাইজ নেওয়া? ছিঃ! নিজেকে ফার্স্ট ছাড়া অন্য কোন প্রাইজ নেওয়ার যোগ্য বলে সে মনে করেনি। এখনও করে না। মাকে সেকথা জানাতেই মা বলে, ঠিকই বলেছিস, স্যারেদেরই কাজ এসব। নয়তো তোর মত ছেলে কি করে থার্ড হয়? না না। তোকে আর প্রাইজ নিতে যেতে হবে না। মায়ের কথায় অনেকখানি নিশ্চিন্ত হয় হিতেন। আর বাবাকে এ সম্পর্কে কিছু জানাবে না বলেই ঠিক করেছিল সে। কারণ বাবাকে সোজা-সাপ্টা লোক বলে তার মনে হয় না। সবকিছু সে আগে খোলাখুলি জানবে, তারপর নিজের যা মনে হয় তাই বলবে। আর তাছাড়া বাবা তার স্কুল-পড়াশুনো সম্বন্ধে বিশেষ একটা খোঁজও রাখে না। তাই বাবার থেকে ব্যাপারটা এড়িয়ে যাওয়া খুব একটা অসুবিধাজনক হবে না বলেই মনে হয়েছিল তার। কিন্তু যা ভাবা হয় তা হয় না। বাবা তার পড়াশুনোর খেয়াল ঠিকই যে রাখত, তার পরিচয় পেল সে সেদিন। বাবা ওর পড়ার ঘরে এসে কথাপ্রসঙ্গে জানতে চাইল, তোদের স্কুলে প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশন কবে আছে? হিতেন প্রথমে ভেবেছিল সে বলে দেবে, আনি না। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল, নাঃ, বাবা ঠিকই জেনে যাবে। অগত্যা সে বলতে বাধ্য হল, সামনের শুক্রবার। কথাটা বলেই সে বইয়ের পাতায় মুখ গোঁজে। তারপর প্রকৃত কারণ এড়িয়ে গিয়ে আড়ষ্টভাবে বলে, এবার যাব না ঠিক করেছি। পড়াশুনোর চাপ অনেক। তাছাড়া সামনে টেস্ট। বাবা ঘরটায় চুপ করে পায়চারী করতে থাকে। হিতেন মাথা নিচু করে পড়ার ভান করে। মনে দোলাচল। খানিকক্ষণ বাদে বাবা গম্ভীরমুখে বলে, না। এতে এমন কিছু সময় নষ্ট হবে না। প্রাইজ আনতে কোন অসুবিধা নেই। হিতেন সরাসরি বাবার বিরুদ্ধে যেতে সাহস করে না। বাবা আবার অর্ডারি ভঙ্গীতে বলে, প্রাইজ আনতে যেতেই হবে, সে ফার্স্ট প্রাইজই হোক কি থার্ড প্রাইজ। বাবা দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। বাবার শেষ কথাটায় একটা ইঙ্গিত ছিল। সেটা হিতেনের কানে বাজে। এরপরে বাবাকে সে অনেক অনুরোধ করেছে, বাবার ওপর রাগ করেছে। এ নিয়ে অভিমানও করেছে সে অনেক। তবু তাতে কোন ফল হয়নি। কিন্তু হিতেন তাতেও দমেনি। সে পাড়ায় বলে বেরিয়েছে সে ফার্স্ট হয়েছে। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবাই জানে হিতেন অন্যবারের মত এবারেও ফার্স্ট হয়েছে। আর হিতেনের কাছেও সত্য এটাই। সে ফার্স্ট। এখানে কোন কম্প্রোমাইজ চলে না।
স্কুলের সামনে বেশ বড় একটা মাঠ। সেই মাঠেই স্টেজ তুলে অনুষ্ঠান চলছে। অনুষ্ঠানে বক্তৃতা রাখছেন নন্দন স্যার। স্টেজের সামনে দুটো বিরাট বড় বক্স। বক্তৃতার পরেই শুরু হবে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। হিতেনের তখনও ইচ্ছা করে সে সেখান থেকে চলে যায়। পরক্ষণেই তার চোখে পড়ে বটগাছটার গোড়ায় স্বামী বিবেকানন্দের মত বুকের কাছে হাত গুটিয়ে তার বাবা দাঁড়িয়ে আছে। স্টেজের সামনে বিরাট অঞ্চল জুড়ে লাল রঙয়ের সারি সারি চেয়ার পাতা। ধারের দিকে একটা ফাঁকা জায়গা বেছে নিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ে হিতেন।
পুরস্কার বিতরণ শুরু হয় খানিক বাদেই। হৈ-হট্টগোলে অ্যানাউন্সমেন্টের আওয়াজও চাপা পড়ে যায়। গার্জিয়ানরা কিছু পাশে এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে বা বসে আছে। ক্লাস ফাইভ, সিক্স, সেভেন ... এমনিভাবে এগোতে এগোতে ক্লাস ইলেভেনের পুরস্কার নেওয়ার পালা আসে একসময়। অপরাজিত, অনিরুদ্ধ আর হিতেনকে মঞ্চে উঠে আসতে বলা হয়। পা দুটো টেনে টেনে মঞ্চের দিকে এগোয় হিতেন। কিন্তু পরিস্থিতিটাকে সে এড়াবে কিভাবে? যে করে হোক তাকে এ পরিস্থিতি মেনে নিলে চলবে না, নিজের মনে কঠোর হয়ে ওঠে হিতেন। মঞ্চের ওপর উঠে তিনজন পাশাপাশি লাইন দিয়ে দাঁড়ায়। অপরাজিতকে প্রথমে ডাকা হল ফার্স্ট প্রাইজ নেওয়ার জন্য। অপরাজিত এগিয়ে যায়। হেডস্যার রত্নদীপ ব্যানার্জি পুরস্কার তুলে দিতে যায় তার হাতে। আর ঠিক এই সময়েই হিতেন মাথা নীচু করে। চোখদুটো বুজে ফেলে সে মূহুর্তে। দর্শকরা কেউ কি টের পেল? অবশ্য টের পেলেও কিছু আসে যায় না হিতেনের। এই পরিস্থিতিটাকে এড়ানোই তার এখন একমাত্র লক্ষ্য। পুরস্কার দেওয়া হলে মাথাটা আবার তুলে চোখ খোলে সে। ‘এরপর দ্বিতীয় স্থানাধিকারী ছাত্র অনিরুদ্ধ পাল’ ঘোষিত হয় বক্সে। অনিরুদ্ধর পুরস্কার নেওয়ার সময়েও ঠিক একইভাবে আবার নিজের চোখদুটো বন্ধ করে হিতেন। এবার তার পুরস্কার নেওয়ার পালা। ঘোষণা হবার পর হেডস্যারের হাত থেকে পুরস্কার নিয়ে মাথাটাকে সামান্য নিচু করে মঞ্চ থেকে নেমে এল সে। এই প্রথম সে পুরস্কার নেওয়ার পর স্যারকে প্রণাম করল না। মঞ্চ থেকে নামতেই তার চোখে পড়ে সুবিনয় স্যার, স্কুলের অ্যাসিস্টেন্ট হেড। স্যার তাকে দেখে হাসলেন। বললেন, ভাল আছো হিতেন? ঈষৎ হেসে ছোট্ট করে জবাব আসে, হ্যাঁ। তারপরই স্যারের একটু কাছে এগিয়ে সে জিগ্যেস করে, আচ্ছা স্যার, ট্রান্সফার সার্টিফিকেটের জন্য কবে যোগাযোগ করব? স্যার তার এই কথাটায় একটু আশ্চর্য্য হলেন, খানিকটা অপ্রতিভও। তারপর বললেন, মঙ্গলবার দেখা করতে পারিস। মৃদু হেসে হিতেন মাথা নাড়ায়। তারপর পাশ ফিরতেই দেখে তার পাশে দাঁড়িয়ে তার বাবা। চমকে ওঠে সে।
মঙ্গলবার সুবিনয় স্যার যদিও ভেবেছিলেন হিতেন ট্রান্সফার সার্টিফিকেট নিতে ঠিকই আসবে। কিন্তু সেদিন সে আসেনি। পরেও কোনদিন স্যারকে এ ব্যাপারে আর কোন প্রশ্ন করেনি সে। ট্যুয়েলভের বাকি দিনগুলো সে এই স্কুলেই কাটিয়েছিল।
প্রকাশিত - গল্পকবিতা ডট কম। 
                                                                                      লেখা – ঐশিকা বসু।