পৃষ্ঠাসমূহ

শুক্রবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

অভিজিত রায় মারা গেলেন কেন?

বাক স্বাধীনতা হরণ করাটা ধর্মের ধ্বজাধারীদের যুগযুগান্তরের নেশা বলতে পারেন। যদি আপনার মনে বিশ্বাস থেকেই থাকে তবে অন্যকে আঘাত করার কি কোন প্রয়োজন পড়ে? মনে তো হয় না। আসলে এ সমস্যাটা রয়েছে অন্য জায়গায়। বস্তুত, এই ধর্মীয় উগ্রবাদীরা (তা যে ধর্মেরই হোক না কেন) নিজেদের প্রভু হিসেবে দেখাতে চায়। তারা এটা প্রমাণ করতে চায় এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যা কিছু সম্ভব তার কোন কিছুই তাদের অজ্ঞাত নয়। কিন্তু বাস্তব তো আর তা নয়। তারা তো অনেক কিছুই ভুলভাল বকে। আর সেটাই তো স্বাভাবিক, কারণ তারাও যে মানুষ। কিন্তু তারা যে মানুষ, তারা নিজেরাই সে কথা মানে না, আর ভাবে তারাই বুঝি গড, ভগবান, আল্লার দূত বা প্রেরিত ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু সমস্যা হয় যখন বিজ্ঞান এসে সত্যটাকে দেখিয়ে দেয়। তারা যখন বলতে শুরু করে সূর্য আসলে ঘুরছে না, সে স্থির, বরং পৃথিবীর চারিদিকে ঘুরছে তখনই ধর্মবাদীদের যায় মাথা খারাপ হয়ে। তাদের যে এতদিনকার অচলায়তন খুলে গেছে সেটা তারা কি করে মানবে? প্রভুর কথাই যদি আজ মিথ্যে হয়ে যায়, তবে লোকে যে ছি ছি করবে। তখন তাদের ভগবান হওয়াই বা হবে কি করে, আর এতদিনকার বলতে থাকা চলতে থাকা ব্যবস্থাই বা টিকবে কি করে? প্রভুত্ব যে তবে যায় যায়। তা কি আর মেনে নেয় এরা?
না নেয় না। আর সেই কারণেই এই হত্যালীলার দরকার হয়ে পড়ে। খুন কর, গলা কেটে ফেল, ভেঙে ফেল, বন্ধ করে দাও সমস্ত বিরোধী আওয়াজ। রবীন্দ্রনাথ এক জায়গায় বলেছিলেন, 'দ্বার বন্ধ করে ভ্রমটারে রুখি, সত্য বলে আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি?' আর এ তো সত্যকে সরাসরি আটকানোরই অভিপ্রায়। কিন্তু এতে তো মানুষ খেপে যাবে। তারা যে বলবে যাদের এতদিন প্রভু বলে জেনেছিলাম, মহান বলে যাদের কথা মেনে চলতাম তারা কি করে অস্ত্র শস্ত্র বের করছে? তাহলে তারা কি ভণ্ড? তখন ধর্মের গোঁড়ামি কি করে রক্ষা হবে? একটা উপায় আছে। প্রচার কর এই বলে, তুমি ইসলাম, তাই তুমি মহান/ তুমি হিন্দু তাই তুমি মহান/ তুমি খ্রীষ্টান, তাই তুমি মহান। আর এই মহান ধর্মকে আজ আঘাত করা হচ্ছে। কে করছে, কিছু বিজ্ঞানবাদী, মিথ্যেবাদীর দল। তাই তোমার ধর্মকে রক্ষা করার জন্যই ওকে মারা হল। কত বড় মহান কাজ করা হল বল তো? এই না হলে ধর্মীয় উগ্রতা! আমিও তো আমার ধর্মকে ভালবাসি, কিন্তু কোন বিরোধীস্বরকে বন্ধ করে দেওয়ার প্রয়োজন তো হয়নি আমার। কারুর মতানৈক্য হলে তর্ক করুন। কিন্তু আবার দেখুন যেন তার সাথে বন্ধুত্বও থাকে অটুট। কিন্তু এমনটা ভাবলে তো এত কাণ্ড হতই না। উগ্র ধর্মীয় ধ্বজাধারীদের মূল উদ্দেশ্য যত না ধর্মকে রক্ষা করা তার চেয়ে অনেক বেশি সাধারণ মানুষের আবেগ কেড়ে তাদের ওপর প্রভুত্ব ফলিয়ে নিজেদের কর্তৃত্ব জাহির করা। আর এই থেকেই তো যত বাবা-মোল্লার উৎপত্তি। প্রকৃতপক্ষে ধর্মটা ব্যক্তিগত ব্যাপার, বিশ্বাসের ব্যাপার। তার প্রতি আস্থা রেখেও বিজ্ঞানচর্চা করা যায়। কিন্তু এই খুন যারা করে, তারা অন্য কাউকেই মানতে চায় না। কারণ তাদের অস্তিত্বরক্ষার তাগিদটা রয়েছে যে সেখানে। এদের রূপ যুগযুগান্তর ধরে একই। অপরদিকে, সত্যকে যারা প্রকাশ করতে চায়, তারা কিন্তু নিজেদের বদলে ফেলে। বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে তারা এগিয়ে চলে, মানিয়ে নেয় পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে। জিত কিন্তু হয় তাদেরই। দেখুন, অতীতে ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল বাইবেলের অভ্রান্ততাকে অস্বীকার করার জন্য। আজ মানুষ জানে, বাইবেল অভ্রান্ত নয়। ব্রুনোকে মারা গেছিলেন, কিন্তু সত্য মারা যায় নি। সেখান থেকে হাল আমলে নরেন্দ্র দাভালকারকেও মারা হল। কেন? না তিনি কুসংস্কারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। এর বিরুদ্ধে আইনও আনবার চেষ্টা তিনি করেছিলেন। তাই তাঁকে মারা হয়েছে। কিন্তু তাঁর আদর্শের কি মৃত্যু ঘটেছে? মুক্তমনা চেতনাকে জাগ্রত করুন। ভেবে দেখুন, কি মানব? কেন মানব? প্রশ্ন করতে শিখুন, তারপর উত্তর খুঁজুন। ধর্ম জানুন, অধর্মও জানুন। কোরান পড়ুন, রামায়ণ-- মহাভারত-গীতা পড়ুন, পড়ুন বাইবেলও। আবার জানুন দ্বান্দ্বিক যুক্তিবাদ। তারপর নিজেই বিচার করতে পারবেন কোনটা ঠিক আর কোনটা নয়। লেখা আর বাড়িয়ে ভারাক্রান্ত করব না (ইতিমধ্যেই যদি না তা করে থাকি)। অভিজিত রায়ের ঘটনা নতুন কিছু নয়। সব ধর্মেই অভিজিত রায়েরা তৈরী হয়। তাদের হত্যা করা হয়, আবার জন্মও নেয় তারা। ধর্মের নামে অধর্ম যারা করে তারাই শেষমেষ পরাস্ত হয়। আজ দিকে দিকে যুদ্ধের দামামা বেজেছে। যারা অভিজিত রায়কে হত্যা করল তাদেরই বড়সড় রূপ আইএস, আলকায়দা, তালিবান, লস্কর - ই -তৈবা। বলা বাহুল্য, এরাও টিকবে না বেশিদিন। নতুন যুগ আসছে, নতুন চেতনা তৈরি হচ্ছে যেখানে হত্যা নয়, ধ্বংস নয়, বৈচিত্র্যের মাঝে মিলনই হবে সম্ভব।