পৃষ্ঠাসমূহ

শনিবার, ২৯ আগস্ট, ২০১৫

আশঙ্কায় আছি



একটা ভয়াবহ সত্যকে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু কিছু করতে পারছি না। এ এক বিষম জ্বালা। বন্ধুদের কাছে অনুরোধ, তাঁরা যদি কেউ এ লেখা পড়েন। তাহলে যেন আমাকে এ থেকে পরিত্রাণের উপায় বাৎলে দেন। যে ঘটনাটা থেকে এ সবের সূত্রপাত সেটাই আগেই বলি।
অফিসে যাওয়ার সময় রোজ লালগোলা ফাস্ট প্যাসেঞ্জার আমার বাঁধা থাকে। দরজার থেকে কিছুটা দূরে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ানোটা আমার বরাবরের অভ্যাস হয়ে গেছে। আসলে আমি উঠি নৈহাটি থেকে। আর নৈহাটির পর থেকে আমার গন্তব্য স্টেশন শিয়ালদা পর্যন্ত এ ট্রেন কোথাও দাঁড়ায় না। তাই লোকেদের নামাওঠার ভিড়টাও থাকে না। শুধু লোকে এখানে দুটো কাজ করতে আসে। সে দুটো হল এক, বিড়ি খাওয়া আর দুই, বাথরুমে যাওয়াশুক্রবার, মানে গতকাল ট্রেনে চড়েছি। প্রায় শিয়ালদার কাছে পৌছে গেছি তখন। একটা পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের ছেলে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরাল। যদিও ট্রেনে বাসে সিগারেট খাওয়াটা আইনত অপরাধ। কিন্তু আমাদের দেশের নিয়মানু্যায়ী, বেআইনি কাজকে আইন বলে চালিয়ে দেওয়াটা অসম্ভব কিছু না। অহরহ ঘটছে এসব। তাই ছেলেটাকে বলব বলব করেও কিছু বললাম না।
সিগারেট শেষ হলে টান মেরে দরজা দিয়ে বাকিটুকু ফেলে ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে একবার হাসল। আমি চিনি না ওকে। হাসল কেন তাও জানি না। তবু প্রতি হাস্যে আমিও জবাব দিলাম। ছেলেটা বলল, ‘আপনি কি সরকারি জায়গায় আছেন?’ আমি উত্তরে হ্যাঁ বললাম,। ও ফট্‌ করে বলে ফেলল, ‘আচ্ছা, আপনার কাছে অ্যাকাউন্টসের কোন কাজ আছে?’ আমি ‘না’ বলি।  
দেখলাম ছেলেটার চেহারা ভাল। সুন্দর স্বাস্থ্য। দেখতেও মন্দ নয়। কিন্তু এই বয়সের একটা ছেলের চাকরি করবার জন্যে অচেনা একজনকে অনুরোধ করতে লজ্জা করছে না দেখে খুব অবাক হলাম। ঠিক ততটাই হলাম অসন্তুষ্টওকিন্তু সে অসন্তোষ না প্রকাশ করে ওর কথা আমি শুনে যেতে লাগলাম। ও বলে যাচ্ছে, ও কোন এক কোম্পানীর অ্যাকাউন্টসে আছে। কিন্তু সেখানে কাজের খুব চাপ। মাইনেও খুব কম। তাই ও সেকাজে ইস্তফা দিয়ে নতুন কাজ খুঁজছে।
আমি ওকে বললাম, প্রাইভেট কোম্পানী যে ঝেড়ে নিংড়ে তবে দুপয়সা দেবে সেটাই স্বাভাবিক। আপনি যদি সরকারি চাকরি করতে চান, তাহলে সরকারি চাকরির পরীক্ষাগুলো দিন। আমার কথা শোনার পর ছেলেটা একটানা বকে যেতে লাগল। ওর চাকরিতে কি কি সমস্যা আছে, কি করলে সে ভাল কাজ পেতে পারে তার জন্যও সে কি ভাবছে ইত্যাদি ইত্যাদি। ওর কথাগুলো শোনার পর আমার ভুল ভাঙল। ছেলেটা সাধ করে আমার কাছে থেকে চাকরির খোঁজ চাইছে না। সে চূড়ান্ত টেনশনের মধ্যে আছে। আর ওর মধ্যে চলতে থাকা এই উদ্বেগই ওকে আমার মতো একজন অচেনা অজানা লোকের থেকে চাকরির খোঁজ করাতে বাধ্য করছে। পরে আমার মনে হচ্ছিল, ও কিছুটা মানসিকভাবেও অথর্ব হয়ে পড়ছে। একটা সাহারা খুঁজছে ও। ভারি খারাপ লাগল আমার। আজকের এই যুবসমাজ যারা কিনা ভবিষ্যত ভারতবর্ষ তৈরি করবে, তারাই আজ কেমন পঙ্গু হয়ে গেছে। সামাজিক ব্যধি, অর্থনৈতিক নিষ্পেষণ আজ এমন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছেছে যে ভবিষ্যত প্রজন্ম আজ মানসিক ব্যধির শিকার। কি করে ভাল হবে আমাদের ভবিষ্যত পৃথিবী। যে ছেলেটার কথা আমি এতক্ষণ বললাম, মধ্যবিত্ত ঘরে এরকম শিক্ষিত ‘বেকার’ যুবকের সংখ্যা কিন্তু নেহাৎ কম নয়। আমার বন্ধুবান্ধবদের বেশিরভাগকে দেখেই আমি একথা বলছি। আর এও সত্যি যে দেশের পরবর্তী দিনগুলো গড়ে তুলতে এই সকল ছেলেমেয়েদের ভূমিকা হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কেমন হবে সেই দিন? কি করে এই চরম নিষ্পেষণের মধ্যে এরা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে? শক্তি পাবে কোথায় এরা? আশঙ্কায় আছি, ভবিষ্যতটা না আরো দীন হয়ে পড়ে। শক্তি জোগাতে হবে এদের। আমার পাঠক, তোমরা সবাই এসো। আজকের যুবসমাজকে শক্তি দাও তোমরা। মহাভারতে পড়েছিলাম, শ্রীকৃষ্ণ বলে গেছেন, এ পৃথিবী যখনই অধর্মের শিকার হবে তখনই যুগে যুগে তাঁর আবির্ভাব ঘটবে। সমস্ত পৃথিবীকে তিনি অপশক্তির হাত থেকে রক্ষা করবেন। আজ হাজারো দূর্যোধনে পৃথিবী ভরে গেছে। কিন্তু তাঁর দেখা মেলে কই? হয়ত এ কথার কথা। তাই তার জন্যে অপেক্ষা করে আমাদের লাভ নেই। আমাদের মধ্যে থেকেই কেউ একজন উঠে আসবেন। আসুন না এমন কেউ, যিনি সারাটা যুবসমাজকে নেতৃত্ব দেবেন – একে এর গভীর অসুখ থেকে মুক্ত করে সুন্দর এক ভবিষ্যতের জন্ম দিয়ে যাবেন।