পৃষ্ঠাসমূহ

শনিবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

মাতৃভাষার আন্দোলন - আমার চোখে

আজ একুশে। অমর একুশে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ব্যাপারটা হাস্যকর কিংবা উৎকেন্দ্রিক মনে হতে পারে, কিন্তু তবুও বলব আমার কাছে এই দিনটার গুরুত্ব অন্যরকম। কতকটা ব্যঙ্গাত্মক। আবার অনেকখানিই ট্র্যাজিকও বটে। কিছু মানুষের প্রাণ গেছে এই আন্দোলনে, বাংলাভাষা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে তাতে। কিন্তু বাঙালী? তাদের অবস্থা তো কিছু বদলায় নি। সত্যি, বাঙালী এক দূর্ভাগ্য পীড়িত জাতি - এ কথা বলতে আজ আমার এতটুকু বাধে না। কি ভৌগোলিক ক্ষেত্রে, কি সংস্কৃতিগত চেতনায়, কি মূল্যবোধের নিরীখে, কি ঐতিহাসিক নিরীখে - সর্বক্ষেত্রেই এই জাতির মধ্যে এক ঐকান্তিক মিল লক্ষ্যণীয়। তবুও, ভাগ্যের কি অমোঘ পরিণাম, আজ আমরা এক নই, দ্বিধাবিভক্ত। হিংসা-হানাহানি-মারামারিতে বাংলা 'মা' আজ দ্বিখণ্ডিত। চিরশত্রু ইংরেজ যখন আমাদের মধ্যে এ দ্বৈততার বীজ বপন করেছিল তখন বিংশ শতকের প্রথম দশক। মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠার (১৯০৬) মধ্যে দিয়ে এই দ্বিজাতিতত্ত্বের বীজ আরো সুপুষ্ট হতে পেরেছিল। যদিও বাংলার বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় বুঝেছিলেন, ইংরেজের শাসনকার্য চালানোর এ আরেক চাল। কিন্তু তা আর মানুষ বুঝল কই? তারা তো গা ভাসাল মনকাড়া সস্তার কথায়। ধর্মীয় কথায় উত্তেজিত হয়ে বাংলাভাগ হল বটে। কিন্তু তাতে কি কিছু সুরাহা হল? মনে তো হয় না।
      আজ ফিরে যাব স্বাধীনতার কিছুটা আগে। কি জানেন, বঙ্গভঙ্গ কিন্তু আদপেই হত না যদি না মুসলমানপন্থী মুসলিম লীগ আর হিন্দুপন্থী হিন্দু মহাসভা এ ব্যাপারে নাক না গলাতো। আসলে তখন যা পরিস্থিতি তাতে কি অর্থনৈতিক, কি রাজনৈতিক, কি সাংস্কৃতিক - সব দিক থেকেই তো পশ্চিমবঙ্গ পুর্ববঙ্গের তুলনায় অনেক বেশি এগিয়ে। ১৯১১ সাল পর্যন্ত কলকাতা ছিল ভারতের রাজধানী। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ভারতের সবথেকে বড় শহরও এই কলকাতাই। কি পাটকল, কি কয়লাখনি, অন্যান্য কলকারখানা - সবই যে ভারত ভূখণ্ডে পড়ে রয়েছে। তাই বঙ্গভঙ্গের ফলে পূর্ববঙ্গের বাঙালীর এগোনো তো দূরের কথা, আরো বেশি পিছিয়ে পড়বে। তাই না? মুসলিম লীগ গঠনই বলো, কি পৃথক রাষ্ট্রের দাবি - সবকিছুর মূলেই কিন্তু ছিল একটাই কথা - মুসলমানরা হিন্দুদের তুলনায় পিছিয়ে, তাই তাদের সুবিধার্থে আলাদা রাষ্ট্রের দরকার। তাই এই বিভাগে কি কোন লাভ হবে? এই ব্যাপারটা খুব ভাল করে বুঝতে পেরেছিলেন - মুসলিম লীগেরই আরেক নেতা - হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়াদী। তিনি উপরিউক্ত যুক্তি দেখিয়ে বললেন - বাংলা ভাগ করার দরকার নেই। বরং সমগ্র বাংলাকে নিয়ে সম্পূর্ণ আলাদা রাষ্ট্র হোক। বর্ধমানের নেতা আব্দুল হাসিম একে সমর্থন করলেন। সমর্থন করলেন কংগ্রেস নেতা শরৎচন্দ্র বোসও। কিন্তু ধর্মের ধ্বজাধারীরা কি আর এদের সহজে ছাড়ে। বিরোধীতায় সোচ্চার হয়ে উঠল নুরুল আলিম, মহম্মদ আক্রাম খান প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। কিন্তু এই পরিকল্পনার পেছনে প্রকৃত যুক্তি খুঁজে পেলেন যিনি তাঁর নাম - মহম্মদ আলি জিন্না। তিনি বাংলারসমন্বিতকরণের পক্ষে মত দিলেন। সোহ্‌ওয়াদী শুরু করলেন তাঁর পরিকল্পনামাফিক কাজ। 


    আবার এল বাধা। এবার বাধা দিল, জওহরলাল-প্যাটেলের মত কংগ্রেসের হেভিওয়েট নেতারা। তাদের বক্তব্য ছিল, বাংলাকে ভাগ না করার 'চক্রান্ত' করছে নাকি মুসলিম লীগ। কারণ বাংলাভাগ না হলে মুসলিমরা হবে সংখ্যাগরিষ্ঠ আর হিন্দুরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হয়ে তাদের অধীনস্থ হয়ে যাবে। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে হিন্দু মহাসভা চূড়ান্ত বিরোধীতার ঝড় তুলল। এরপর সোহ্‌ওয়াদীর মন্ত্রণালয়ে হিন্দুদের সংখ্যা ক্রমশ কমে আসা আর ১৯৪৬ এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা - এই দুটি ঘটনাতে মুসলিম লীগের ওপর থেকে বাংলার হিন্দুদের বিশ্বাস সম্পূর্ণরূপে অবলুপ্ত হল। সোহ্‌ওয়াদী বললেন, অবিভক্ত বাংলায় মুসলমান ও অমুসলমানদের জন্য সম্পূর্ণ আলাদা নির্বাচনমণ্ডল তৈরী করা হবে। কিন্তু এই মত মানতে রাজী হলেন না শরৎচন্দ্র বোস। তাঁর মত, বাংলা যদি অবিভক্তই থাকে তবে নির্বাচন আলাদা হবে কেন? দুজনের মধ্যে বিতর্ক তুমুলে উঠল। বাংলা অবিভক্ত হওয়ার স্বপ্ন বিলীন হল এখানেই। 


    সেই দিনগুলো পেরিয়ে এসেছি নয় নয় করে তাও ৬৮ বছর হয়ে গেল। তবু প্রশ্ন কিছু থেকেই যায়। সত্যি কি লাভ হল বাঙালীর? আদৌ কি কিছু লাভ হল এ জাতির। যারা ধর্মের ভিত্তিতে নিজেদের পৃথক করে নিল তাদের তো আবারও ছেড়ে আসতে হল একদা বন্ধুদেশ পাকিস্তানের সঙ্গ। শুধু ভাষার জন্য। যে ভাষায় ওদের আর পশ্চিমবঙ্গের পার্থক্য নেই কিছু। বাংলাদেশ এটা প্রমাণ করল - একটা জাতির প্রধান পরিচয় তার ধর্মে নয়। বরং অনেক বেশি তার ভাষায়। আর এখানেই ধর্মের কৃত্রিম চেহারাটা নগ্ন হয়ে এল।  ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের যুক্তিকে খণ্ডন করে দিল ইতিহাস নিজেই। ধর্মীয় বিভেদের উস্কানিদাতারা (সে ইংরেজ থেকে আধুনিক শাসক পর্যন্ত) শেষমেশ পরাজিত হলই। সময়ই বলে দিল, ধর্ম নয়, আসল বিজিত কিন্তু আমাদের সংস্কৃতির মূলস্রোত। যা আজও বহমান, বাঙালীর অন্তরে অন্তরে। আর আমাদের দূর্ভাগ্য এখানেই, সবকিছু বুঝে শুনেও কিছু স্বার্থকামী মানুষের লোভের ফল আজও আমাদের ভোগ করতে হচ্ছে দ্বিখণ্ডিত হয়ে। দ্বিখণ্ডনের এই ক্ষোভ আরো গা-চাড়া দিয়ে ওঠে যখন দেখি আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী বক্তৃতা দিচ্ছেন হিন্দিতে, সরকারী চাকরির পরীক্ষা হচ্ছে হিন্দিতে আর আমরা পড়ছি পিছিয়ে, আমাদের যাবতীয় সব সরকারি কাজকর্ম চলছে হিন্দিতে, কলকাতায় তো বাংলায় লেখা সাইনবোর্ড খুঁজে পাওয়াও দুষ্কর। সরকারি চাকরি করতে গেলে হিন্দি শেখা হচ্ছে বাধ্যতামূলক। বুঝতে পারছি, হিন্দি বলয় এখানে ক্রমশ ঘিরে ফেলছে বাংলাকে। বাংলায় কাজ করলে তার কোন স্বীকৃতি মেলে না। এই যখন ভারতের অবস্থা, তখন দেখছি বাংলাদেশের সরকারী ওয়েবসাইট বাংলায় লেখা, সেদেশের মন্ত্রীরাও কথা বলছেন বাংলায়, আইন-আদালতেও কাজ চলছে বাংলাতে। নিজের মাতৃভাষায় কাজ করবার অধিকারই আমরা খোয়াতে বসেছি। অথচ দেশটা যদি বাংলার হত - তবে তো সবটাই পারতাম। 


    আবার যখন দেখি বাংলাদেশের উত্তাল রাজনৈতিক পরিবেশ, ধর্মের উস্কানি, ভারতবিরোধী মনোভাব - তখন মনে হয় এরা কারা? চিনতে পারি না এদের সহজে। মনে হয় না এরাই অদূর ভবিষ্যতে আমাদের সাথে থাকতে পারবে। ঘৃণা এবং তার চেয়েও বেশি হিন্দুবিদ্বেষ (অপরদিকে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানবিদ্বেষও) আমাদের আলাদা করে রাখছে এখনও। তবু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ আছে। বিশ্বাস রাখি তাদের ওপরে। বাংলাদেশে (ও সাথে পশ্চিমবঙ্গেও) আজ উদার শিক্ষা প্রসারের দরকার। যে শিক্ষা তাদের বুঝিয়ে দেবে কে আপন আর কে পর। আশা রাখি এমন এক দিনের যেদিন ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি বুঝতে পারবে বাংলা ভাষার স্বরূপ, চিনতে পারবে নিজেকে। সেইদিনই সম্পূর্ণরূপে সফল হবে বাংলার মুক্তিযুদ্ধ।
   

কোন মন্তব্য নেই: