পৃষ্ঠাসমূহ

বৃহস্পতিবার, ১ আগস্ট, ২০১৯

কেবলমাত্র প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য


শোনা গেল, নৈহাটির ঐকতান মঞ্চে নাকি ছোটুলাল আসবেন তাঁর নাটক সেখানে মঞ্চস্থ হবেআর শুধু তাই নয়, সেখানে তিনি এবং তাঁর স্ত্রী সবিতা দুজনেই অভিনয় করবেন খবরটা প্রথমে কেউ বিশ্বাস করতে চায়নি। কোথায় ছোটুলাল আর কোথায় এই নৈহাটি শহর। তাঁর মত শিল্পী এই ছোট্ট একটা শহরে আসবেন এ তো অবিশ্বাস্য ঘটনা। তিনি তো দেশে বিদেশে নামী দামী মঞ্চে অগণিত দর্শকের সামনে অভিনয় করে থাকেন। যদিও নৈহাটি শহরে নাটকপিপাসু লোকের সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। গত বছরগুলোতে এখানে যত নাটক অনুষ্ঠিত হয়েছে আর এখানকার সাধারণ মানুষ যেভাবে সাড়া ফেলেছে তাতে ছোটবড় বিভিন্ন নাট্যদলগুলোর উৎসাহ দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। কিন্তু হাজার হোক, ছোটুলালের মত মানুষের নৈহাটিতে আসাটা মিথের মতই শোনায়। 

যাই হোক, কিছুদিন বাদেই বোঝা গেল খবরটা গুজব নয়, সত্যি। সত্যিই ছোটুলাল সস্ত্রীক নৈহাটির ঐকতান মঞ্চে আসছেন তাঁদের নবতম প্রযোজনা নিয়ে। নাটকের নাম কৃষ্ণা নাটকটা লেখা তাঁর, নির্দেশনাও তাঁরই। নৈহাটির দিকে দিকে বড় বড় ফ্লেক্সে বসানো হতে লাগল কৃষ্ণার আগমন বার্তা। দোকানে দোকানে টিকিট বিক্রি হতে লাগল মুড়ি মুড়কির মত। এই সুযোগে ব্ল্যাকে অনেকে টিকিট বিক্রি করে টুপাইস কামিয়ে নিল। দিন দশেক পরেই শোনা গেল টিকিট শেষ। হাউসফুল হয়ে গেছে ঐকতান। যারা টিকিট কাটতে পারল তারা ছোটুলালকে দেখবএই আনন্দে নাচতে লাগল আর যারা তা পারল না তাদের আক্ষেপটা রয়েই গেল ছোটুলালকে দেখা হল না। 

এই হুজুগে অনেকেই একটা ব্যাপার খেয়াল করেনি। নাটকের বিজ্ঞাপনের নীচের দিকে ছোট ছোট অক্ষরে কয়েকটা কথা লেখা ছিল। বিরাট বিজ্ঞাপনের নীচে হয়ত সে লেখাগুলো আবছা হয়ে হারিয়ে গেছিল অথবা ছোটুলালএই নামটুকুর খ্যাতির কারণে হয়ত তা কেউ পাত্তা দেয়নি। কিংবা এও হতে পারে এই ছোট্ট ছোট্ট অক্ষরগুলোর ক্ষমতাকে কেউ অনুধাবন করবারই অবকাশ পায়নি। কিন্তু সুধীর খেয়াল করেছিকেবলমাত্র প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যএই লেখাটা নিয়ে প্রথমে তার সংশয়ও হয়েছিল। কিন্তু পরে সে আর এ নিয়ে বিশেষ ভাবেনি। বিশেষ করে ছোটুলালের মত মানুষকে দেখবার সুযোগ হাতছাড়া করতে ঐ কটা শব্দ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে তারও মনে হয়নি। আর তার পরিবারেরও মনে হয়নি। 

এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলে রাখা ভাল। নাট্যকার ছোটুলাল কিন্তু এ বাংলার লোক নন। ননীপুরের এক ছোট্ট শহরে তাঁর জন্ম। পরে দেশের বড় বড় শহরে তিনি পড়াশুনো করেছেন, দেশের নানা প্রদেশে থেকেছেন, কাজ করেছেন। কিন্তু তিনি নাটক রচনা করলে, তা করেন ননীপুরি ভাষায় আর নির্দেশনাও তিনি তাতেই দেন। ননীপুর, এ দেশের উপান্তে পাহাড়ঘেরা একটা অঞ্চল। সেখানকার মানুষজনের সাথে দেশের মূল ভূখণ্ডের মানুষের কৃষ্টিগত ও ভাষাগত মিলের চাইতে অমিলই বেশি। তাই নিজের মাতৃভাষায় নাটক করতে গিয়ে নাট্যকারের সাথে সাধারণ দর্শকদের  গরমিলই বেশি হয় এ কারণে তিনি আশ্রয় করেন এক নতুন ভাষারসে ভাষা মুখের ভাষা নয়, সে ভাষা দেহের ভাষা, অঙ্গের অঙ্গভঙ্গির ভাষা। না, মূক নাটক এ নয়, কথা আছে, শব্দ আছে। কিন্তু কথা সেখানে গৌণ, শরীরী বিভঙ্গটাই মুখ্যবাকীটুকু দর্শকের...

()

দিনটা ছিল রবিবার। আর টিকিট ছিল ফার্স্ট কাম ফার্স্ট সার্ভ বেসিসকাজেই একটু তাড়াতাড়িই রওনা দিতে চেয়েছিল সুধীর। সঙ্গে যাবে কমলিকাতুতুলকে রেখে দিতে চেয়েছিল পাশের বাড়িতে। বড়দের নাটক বলে বারো বছরের ছেলেটাকে নিয়ে যেতে চায়নি তারাকিন্তু তুতুলের তীব্র জেদ। বাবা পাঞ্জাবির বোতাম লাগাতে লাগাতে বোঝাল, ‘বড়দের নাটক দেখে কিছু বুঝবি না। ফালতু ফালতু যাওয়া আর আসা হবেমা নতুন পাড়ভাঙা শাড়ির কুঁচি ঠিক করতে করতে বলল, ‘তুই আবার নাটকের কি বুঝবি? তার চেয়ে ওদের বাড়িতে টুপুরের সাথে খেল, ভাল লাগবে কথাটা বলেই মা আয়নার সামনে ঠোঁটে হাল্কা লাল লিপস্টিক লাগাতে থাককিন্তু অভিমানী ছেলের তাতে রাগ চড়ে উঠল। রেগেমেগে সে ঘরের দরজা বন্ধ করে নিজেকে ঘরবন্দী করে ফেলল। বলে দিল, ‘তোমরা আমাকে না নিয়ে গেলে আমি ঘরের দরজা খুলব নাশেষে অনেক কষ্ট করে, অনেক পীড়াপীড়ি করে ছেলেকে মুক্ত করা গেল বন্দীদশা থেকে। তবুও সুধীরের আপত্তিই ছিল ওকে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে। কিন্তু তাতে বাধা রয়েছে আরোখোঁজ নিয়ে জানা গেল পাশের বাড়ির নিখিলবাবুরা সপরিবারে তখন কেনাকাটা করতে বেরোচ্ছে কাজেই সুধীরের পরিকল্পনা বিফলে গেল। বাধ্য হল সে তুতুলকে নিতে। কমলিকা বলল, ‘নাটকটায় কি আর এমন থাকবে? বড়জোর দু-একটা গালিগালাজ থাকতে পারে। তা আমরা তো আর ওদের ভাষা বুঝি না। গালাগালি দিলেও কি, না দিলেও বা কি।

সুধী বলল, ‘তা কথাটা মন্দ বলো নি। যাই হোক, আমি রেডি হয়ে গেছি। তুমি রেডি হলেই বেরিয়ে পড়ি। 

চুলের খোঁপাটাকে কিছুটা ঠিক করে নিয়ে কমলিকাও রেডি হয়ে গেল মিনিটখানেকের মধ্যে 
নাটক শুরু সন্ধ্যা ছটায়। পাঁচটার মধ্যেই পৌঁছে গেছিল ওরা। কিন্তু সেখানে ততক্ষণে জনা পঞ্চাশ-ষাটজনের লম্বা লাইন পড়ে গেছে। সাড়ে পাঁচটার আগে হলঘর খুলবে না। অগত্যা বাইরে লাইনেই সবাইকে দাঁড়াতে হচ্ছে। লাইনে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন রকম মন্তব্য শুনতে শুনতে বেশ সময় কাটতে লাগল। একজন কোথায় কবে ছোটুলালের একটা নাটক দেখেছে, সে নাটক কেমন ছিল সেই নিয়ে গর্ব প্রকাশ করে বলতে লাগল। তবে তার কথাবার্তা শুনে মনে হল নাটকটা কেমন লেগেছে তার চেয়ে লাইনে দাঁড়ানো অন্যান্যদের তুলনায় সে যে ছোটুলালকে আগে দেখেছে সেই গর্ব প্রকাশ করতেই সে বেশি আগ্রহী। অন্যান্যরাও তাদের দেখা সেরা নাটকটার কথা বলে তাদের খেদ মেটাতে লাগল। তবে আজ আমরা সবাই তাঁকে দেখতে পাব। ওঃ আমার কতদিনের ইচ্ছে ছিল, ওনাকে দেখববছর ষাটেকের এক ব্যক্তি পরম শান্তির সুরে বলে উঠল। 

ছ’টা বাজবার ঠিক দশ মিনিট আগে প্রথম বেল পড়ল আর কাঁটায় কাঁটায় ছটায় শুরু হল নাটক। নেপথ্যের ভূমিকাটা প্রথমে করা হল একবার ননীপুরি ভাষায় আর তারপর ইংরেজিতে। পেছন থেকে একজন বলে উঠল, ‘কি দেখবি বল তো, বুঝব না তো কিছুইসত্যিই, নাটক শুরু হওয়ার পর কিছুক্ষণ কিচ্ছু বুঝতে পারা যাচ্ছিল না। একটু অন্যদিকে তাকাতেই সুধীরের খেয়াল পড়ল, পাশের লোকটা তাঁর মোবাইলে সার্চ করছে, ‘‘রানিং টাইম অফ কৃষ্ণাপ্লে’। 

কিন্তু তারপর ধীরে ধীরে বোঝা যেতে লাগল। সময় যত এগোতে লাগল নাটকের সমস্ত ব্যাপারটাই বেশ জমাটি হয়ে উঠতে লাগল। নাটকটার ঘটনাটা ছিল এরকম পাহাড়ঘেরা এক ছোট্ট দেশ। সেখানে চলছে সেনাবাহিনীর শাসন। কিন্তু সেই সেনাবাহিনীর হাতেই চরম দুর্ভোগ পোয়াতে হচ্ছে সেখানকার অধিবাসীদের। সন্দেহজনক দেখলেই যাকে তাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে সেনারা, গারদে পুরে রাখা হচ্ছে অনির্দিষ্টকালের জন্য। সন্ত্রাস দমনের নাম করে সাধারণ মানুষের ওপর নেমে আসছে নিপীড়ন। মহিলাদের ওপর চলছে অত্যাচার, ধর্ষণ। আর এর প্রতিবাদ করতে গেলেই গুম করে দেওয়া হচ্ছে চুপিসারে। 

ব্যাপারটাকে গোপন রাখবার জন্য অনেক চেষ্টা করেছিল সে দেশের সেনাবাহিনী ও সরকারকিন্তু শেষরক্ষা হল না। ঠিক নজর পড়ে গেল এক সাংবাদিকের। মনোরমা নামে এক তরুণ সাংবাদিক এই বিষয় নিয়ে বিস্তারিত জানতে গেলেন সেখানে। তাঁর উদ্দেশ্য তিনি সেটা নিয়ে কাগজে রিপোর্ট পেশ করবেন। এখানকার মানুষের ওপর চলতে থাকা দুর্বিষহ অত্যাচারের কথা সারা দেশকে এভাবে জানানো হবে। কিন্তু সত্যিটা জানানো যাবে না। তাই তাঁর ওপরও নেমে আসে অত্যাচার। সেনারা তাঁকে প্রথমে ধর্ষণ করেতারপর তাঁর গোপনাঙ্গে গুলি করে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়আর এরই প্রতিবাদে রাস্তায় নগ্ন হয়ে প্রতিবাদে নামেন মায়েরা। সেখানে শুধু মনোরমার মা নন, আছেন সেইসব তরুণীর মায়েরা যাঁরা ধর্ষিতা হয়েছেন, লাঞ্ছিতা হয়েছেন সেনাদের হাতে। ছোটুলালের বর্তমান নাটকটা ছিল সেই লাঞ্ছনারই এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল। 

সবই ঠিক চলছিল। কিন্তু সমস্যা হল, নাটকটার শেষের একটি দৃশ্যে যেখানে সবিতা, যিনি মনোরমার মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করছিলেন, একজন সেনা অফিসারের সামনে তাঁর বলিষ্ঠ প্রতিবাদের চরমতম ভাষা যোগাবেন সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে। যদিও সে দৃশ্য ছিল দর্শকদের থেকে সম্পূর্ণরূপে আড়াল করা। কিন্তু সাধারণ দর্শক তাতেও সম্ভবত প্রস্তুত ছিল না। 

দু-একটা অস্পষ্ট গুঞ্জন। আর তারপর সমস্তটা নিস্তব্ধ। দু-একজনকে দেখা গেল দর্শকাসন ছেড়ে উঠে বেরিয়ে যেতে। সুধীর ভাবল তারাও উঠবেকিন্তু দেখল কমলিকা মুগ্ধ হয়ে দেখছে নাটকটা। সে আর কিছু বলল না। আর মিনিট দশেক বাদে নাটক যখন শেষ হল, বিশেষ একটা হাততালি পাওয়া গেল না। যেটুকু পাওয়া গেল, তাকে অন্তত প্রত্যাশিত বলা চলে না। বেরোবার সময় অত ভিড়ের মধ্যেও কারুর মুখে নাটকটার সমালোচনা শোনা গেল না। একজনকে খালি বলতে শোনা গেল, ‘নাটকটায় যে এইসব দেখানো হবে, সেটা আগে বললেই পারত

বাড়ি ফেরবার পথে তখন সন্ধ্যে রাত। প্রায় আটটা বাজে। কালীমন্দিরের বাজার এলাকা পেরোতেই জায়গাটা বেশ নির্জন হয়ে আসে। সুধীররা যে জায়গাটা দিয়ে হাঁটছিল তার পাশেই একটা আবর্জনার স্তুপ। সে আবর্জনা আসলে কোন বিয়েবাড়ির ফেলে দেওয়া উদ্বৃত্ত খাদ্য অবশেষ। জায়গাটা অন্ধকার। তবু বোঝা গেল, সেখানে উবু হয়ে বসে কিসব খুঁজে চলেছে একটা মানুষখালি গা। পরনের শতচ্ছিন্ন একটামাত্র কাপড় দেহের লজ্জা ঢাকতেও অসমর্থ। কমলিকা নাক চাপল দুর্গন্ধে, তুতুল প্রায় বমি করে ফেলবে বলে মনে হতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই জায়গাটা পেরিয়ে গেল তারা। তুতুল এইসময় হঠাৎ প্রশ্ন করে বসল, ‘আচ্ছা বাবা, নাটকটাকে বড়দের নাটক কেন বলছিলে?’

বাবা বলল, ‘ও তুই বুঝবি না

ছেলে বলল, ‘জানি, ওই সিনটার জন্যবলেই সে মুচকি হেসে উঠল।

কমলিকা বলল, ‘পাকা ছেলে কোথাকার!’

সুধীরবাবু বলল, ‘এই জন্যেই তো ওকে নিয়ে আসতে চাইনি

()

এই ঘটনার দুদিন পরে শোনা গেল কৃষ্ণানাটকটাকে এ রাজ্যে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এমনকি ছোটুলাল আর সবিতার কোন নাটকই আর এখানে করা যাবে না বলে হুলিয়াও জারি হয়ে গেছে। দেশের নানা প্রান্তের বিশিষ্ট নারীবাদীরা আর তাদের সংগঠন এ ব্যাপারে সোচ্চার হয়েছেন। নাটকটা তাই আপাতত অশ্লীলতার দায়ে আর মহিলাদের ইজ্জত ভূলুণ্ঠিত করবার জন্যে সাধারণ দর্শকদের থেকে বিচ্যুত হল। ধন্য ধন্য করে উঠল বেশিরভাগ জনসাধারণ, আর যারা এ ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করবার সাহস দেখাল, তাদের গলার আওয়াজ বিপক্ষ আওয়াজে ঢাকা পড়ে গেল। রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দল জাতীয়তাবাদী সংগঠন” ‘ভারতীয় মূল্যবোধের নিরিখে এই নাটকটা ভারতমাতার প্রতি চূড়ান্ত অবমাননাএই মর্মে রাজ্যের নানা প্রান্তে হিন্দিতে বক্তৃতা দিতে লাগল। 

সুধীর সেদিন সকালে খবরের কাগজের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বলছিল, ‘দেখো দেখো, ঠিক এটাই ভাবছিলাম আমি। এক্কেবারে ঠিক কাজ করেছে। নাটকটাকে ব্যান করে দিয়েছে। পড়ো পড়ো লেখাটা। 

কমলিকা দেখল, ভাল করে পড়ল, তারপর বলল, ‘সবই বুঝলাম। কিন্তু নাটকটার অশ্লীলতাটুকুকে নিয়েই তো শুধু লিখেছে এখানে। বাকীটুকুকে নিয়ে তো লেখেনি। নাটকটায় তো শুধু এটুকু ছাড়াও আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল। তাহলে ব্যান করার আগে সেগুলোকে ধরা হল না কেন?’

সুধীর অধীর হয়ে বলে উঠল, ‘আরে বাবা, আমাদের মত দেশে এইরকম একটা নাটক...তুমি ভাবতে পারছো? এ কখনো চলতে পারে? সে যতই ভাল হোক কি যাই হোক। আমাদের দেশ তো আর আমেরিকা ব্রিটেন নয় যে যা খুশি দেখাবে আর তাই পাব্লিক মেনে নেবে। যা হয়েছে তা হবারই ছিল
কমলিকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘হ্যাঁ তা তো ঠিকই। যে দেশে মেয়েরা নগ্ন হলে হয় বেশ্যা, আর ছেলেরা নগ্ন হলে হয় সাধু, সে দেশে আর এর থেকে বেশি কি-ই বা এক্সপেক্ট করা যায়?’ তারপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওরে বাবা, আটটা বেজে গেছে বাজারে যাবে না? অনেক কিছু আনার আছে কিন্তু। আর হ্যাঁ, তুতুলকেও নিয়ে যেও, ওরও বাজারঘাট করাটা শেখা দরকার। 

সুধীর বাজারের ব্যাগ নিয়ে আর ছেলেকে নিয়ে বেরোল বাজারে। সেই কালীমন্দিরের বাজার। আজও সেখানে আবর্জনা ডাঁই করা, আজও সেখানে নগ্নপ্রায় মানুষটা রয়েছে। তবে আগের দিনের মত সে আর খুঁটে খাচ্ছে না। নিথর হয়ে পড়ে রয়েছে। চোখ বন্ধ। হয় সে ঘুমিয়ে রয়েছে, নয়ত মরে গেছে। দেহ প্রায় বিবস্ত্র। কেউই সেদিকে তাকাচ্ছে না। যে যার মত নাক চেপে যত দ্রুত সম্ভব কেটে পড়ছে। আর জায়গাটা দুর্গন্ধে ভরে উঠছে দ্রুত। সুধীর বুঝতে পারল, পচে আসছে ওর দেহটা। এটা তারই ফলশ্রুতি। কিন্তু কতক্ষণ লোকে নাক চেপে থাকবে? এরপর আরো যখন পচন ধরবে, তখন তো সারাটা পরিবেশে দূষণ আরো ছড়িয়ে পড়বে। সুধীর একবার ভাবল, পৌরসভায় খবর দেয়। কিন্তু তাতে তার অফিসের দেরী হয়ে যাবে। তাড়া, তার এখন বড্ড তাড়া। নগ্ন দেহ পচতে থাক। দূষণ ছড়াতে থাক গোটা সমাজ জুড়ে। তাকে দেরী করলে চলবে না। সেও সরে পড়ল জায়গাটা থেকে। এইসময় প্রশ্ন করে বসল বারো বছরের ছেলে, ‘আচ্ছা বাবা, ঐ নাটকটাকে ব্যানড্‌ করে দিল কেন? ওই বাজে সিনটার জন্যে?’

সুধীর ছেলের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকাল, তারপর গম্ভীরভাবে উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ
কিন্তু ছেলে তাতে থামল না। সে আবার প্রশ্ন করল, ‘তাহলে এই মানুষটা যে এখানে এভাবে পড়ে রয়েছে, একেও তো তাহলে এখনই ব্যানড্‌ করা উচিত। এও তো প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য, বাজে সিন, তাই না?’

সুধীর ছেলের কথার সরাসরি কোন উত্তর করল না। শুধু বলল, ‘এদের ব্যান করতে গেলে অনেক ঝামেলাএসব বড় হলে বুঝবি, এখন চ, বাজারে ঢুকিএই বলে ছেলেকে নিয়ে অন্য রাস্তায় ঢুকল
তুতুল কিছুক্ষণ ভাবল। বাবার কথাগুলো তার ঠিক বোধগম্য হল না। এগুলো সে হয়ত প্রাপ্তবয়স্ক হলে বুঝবে।
::সমাপ্ত::

কোন মন্তব্য নেই: