কোনদিন ভাবিনি এরকম একটা চিঠি আমার হাতে
এসে পড়বে। আর হাতে এলও কি অদ্ভুতভাবে! যেন বাতাসে ভর করে উড়ে আসা একটা পায়রার পায়ে
বেঁধে আমার কাছে এসে হাজির হল। চিঠিটা আমি খুললাম। আর খুলতেই একরাশ বিস্ময়, যারা
বহুদিন ধরে আমার জন্য ওৎ পেতে ছিল, তারা এবার আমাকে একেবারে ঘিরে ফেলল। হাতের
লেখাটা আমার খুব চেনা চেনা লাগছিল। যেন খুব কাছের কেউ লিখেছে এটা। কিছু না ভেবেই সেটা পড়তে শুরু করে দিলাম।
"বাবা,
এই
চিঠিটা তুমি যখন পাবে, তখন হয়ত আমি তোমাদের ছেড়ে চলে যাবো। কিন্তু বাবা, আমি
বাঁচতে চেয়েছিলাম। তোমাদের মধ্যেই থাকতে চেয়েছিলাম আমি। তুমিই আমাকে বাঁচতে দাওনি। এমন কাজ কিভাবে করতে পারলে
বাবা? শারীরিকভাবে আমি এখন খুব দ্রুত দূর্বল হয়ে পড়ছি। ক্ষমতা নেই, তাই নবীন আমার
হয়ে সব কথা লিখে দিচ্ছে। যদিও এই চিঠিটা আমার লেখার কোনো প্রয়োজনীয়তাই ছিল না।
মুখে সব কথা বললেই হতো। কিন্তু আমি চাই, এটা তুমি আমার মৃত্যুর পরে পাও।
তুমি
জানো যে আমি ছোটবেলা থেকেই খেলতে খুব ভালবাসতাম। ক্রিকেট। পাড়ার টুর্নামেন্টে আমি
অনেকবার খেলেছি। তুমি হয়ত এটাও ভুলে যাওনি যে দুবার ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হয়েছিলাম
আমি। ভাল ব্যাট করতাম।
তাই আমার খেলা দেখে সঞ্জয়দা আমাকে একবার ক্রিকেট খেলাটা ভাল জায়গায় শিখতে বলেছিল।
সঞ্জয়দা ছিল আমাদের পাড়ার ক্রিকেট ক্লাবের কোচ। সে তার একটা চেনা ক্রিকেট ক্লাবের
ঠিকানাও দিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল সেখানে যোগাযোগ করতে। তোমাকে সে কথা বলায় তুমি
বলেছিলে, আমার পেছনে তুমি অত খরচ করতে পারবে না। তাছাড়া এই মাজ্ঞিগণ্ডার বাজারে
আমাকে আর ক’দিন বাদেই রোজগারের রাস্তায় নামতে হবে। আমার আশাভঙ্গ হল ক্লাস নাইনে
উঠে। নাঃ, পড়াশুনার কারণে নয়। দোকানে বসতে শুরু করলাম রোজ দুপুর-বিকেল-সন্ধ্যে। আমার
খেলাটা গেল বন্ধ হয়ে। দুঃখে বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। কিন্তু বিশ্বাস করো, তবুও আমি
কিছু মনে করিনি। কারণ আমার কাছে খোলা ছিল পশ্চিমের জানালাটা।
তুমি ঐ পশ্চিমের জানালাটা খুলতে মানা
করেছিলে। বলেছিলে, ‘সোনাই, মনে রাখিস পশ্চিম কিন্তু পিছন দিক। ওদিকের জানালা খোলা
অশুভ।’ কিন্তু আমার বড্ড মন কেমন করত। মন্টু, চিনু, দীপু – ওরা প্রতিদিন সাড়ে
চারটে – পাঁচটা নাগাদ গরিফা মাঠে খেলতে যেত। আমি ওদের দেখতে পাই ঐ জানালা খোলা
থাকলে। ওরা সকলেই ছিল আমার সমবয়সী খেলার সঙ্গী। সবাই ক্লাস নাইনে পড়তো। শুধু ওর
মধ্যে দীপু বোধহয় আমাদের চেয়ে একটু বড়। কারণ ও ক্লাস সেভেন একবার ফেল করে আমাদের
সাথে পড়ত। আর আমাদের সাথে খেলত রামু, তোজো, বাবাই – এরা কিছুটা বড়। ওরা এখনও খেলতে
যায়। আর আমি দোকানে ঠায় বসে থাকি। তাই পশ্চিমের ঐ জানালাটা আমাকে টানে। ওখান দিয়ে
যে মাঠটাকে দেখা যায়। তুমি প্রথম প্রথম আমার সাথে দোকানে থাকতে, তাই আমার সাহস হত
না তোমার কথা অগ্রাহ্য করে তোমার সামনে ঐ জানালা খুলি। ক’টাদিন পরে তুমি যখন আর
এসময় আসতে না, তখন আমি ধীরে ধীরে সাহস পেলাম। একদিন ফাঁকা দুপুর দেখে জানালাটা
খুলতে গেলাম। আর তখনই বিপত্তি, বিস্কুটের জারটা ছিল পাশে, খেয়াল পড়েনি। জানালার একটা
পাল্লার ধাক্কায় সেটা পড়ে গিয়ে ভেঙে চৌচির হয়ে গেল।
সেদিন খুব মেরেছিলে তুমি আমাকে। ঘাড়ে, মাথায়
বেশ চোট লেগেছিল আমার। বোনের সামনে মেরেছিলে তুমি আমায়। আমার মানসম্মানের কথা তো
দূরস্থ, আমার শারীরিক দিকটাও তুমি ভাবোনি। বেশ মনে আছে সে রাতে আমার জ্বর চলে
এসেছিল। তখন মা আমাকে শুশ্রূষা করত। বুনুকে ঘুম পাড়িয়ে মা আমার মাথার কাছে বসে
থাকত। সারারাত জেগে থাকত মা। কখন আমার জ্বর ওঠে, খেয়াল রাখত। জ্বর বেড়ে গেলে মাথায়
জলপট্টি দিত। তুমি দেখতাম আমার প্রতি খুব একটা সহানুভূতি দেখাতে না। কেমন একটা
উদাসীন ভাব তোমার আমার প্রতি। শুয়ে শুয়ে আপন মনে কিসব চিন্তা করতে, আর বকবক করতে
একা একা। আর রাত নেই, দিন নেই হঠাৎ হঠাৎ উঠে বসে হিসাব কষতে। মাও দেখতাম তোমাকে
এড়িয়ে চলত। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে তোমার সাথে সেও কথা বলত না। যদিও তুমি আগে
কিন্তু এইরকম ছিলে না।
ছোটবেলায় তুমি আমাদের সাথে খুব ভালভাবে
মিশতে। কথা বলতে প্রাণখুলে। কত গল্প শুনেছি তোমার মুখে। আমার যখন পাঁচ-ছয় বছর বয়স,
বোনের আড়াই কি তিন হবে, তুমি কাজ সেরে বাড়িতে ফিরলেই হল, আমরা তোমার কাছে গল্প
শোনার বায়না করতাম। আর মা ওদিকে রান্নাঘরে বসে কুটনো কাটতে কাটতে বলত, ‘বাবা এসে
গেছে, অমনি ছেলের পড়াশুনো ডকে উঠল।’ বেশ মনে আছে, তুমি সেসময় আমাদের একবার কলকাতায়
জাদুঘরে নিয়ে গেছিলে, আর দেখেছিলাম চিড়িয়াখানা। কিন্তু গত কয়েকবছর ধরেই দেখছি
তোমার মধ্যে একটা পরিবর্তন আসছে। তুমি চুপচাপ হয়ে যেতে থাকলে ধীরে ধীরে। কারুর কোন
সমস্যার কথা শুনলেই তুমি অধৈর্য্য হয়ে পড়তে শুরু করলে। আমরা বেশি আওয়াজ করলেও তুমি
খুব বিরক্ত হতে। বকা দিতে আমাদের। তোমার রাগটা যেন বেশি ছিল আমার ওপর। বড় হয়ে
যাওয়ার পরেও তুমি আমার গায়ে কথায় কথায় হাত তুলতে। তাই আমাদের সাথেও আর তোমার
সম্পর্কটা সহজ রইল না।
আরেকটা পরিবর্তনও আমার চোখে পড়েছে। সেটা হল
আমাদের দোকানে ইদানীং লোক আসা খুব কমে গেছে। কেনবার কেউ নেই। তেল, নুন, বিস্কুট
পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে। সত্যি বাবা, আগে আমাদের দোকানে কত লোক আসত! পাড়ার কত কেউ
নিয়মিত আমাদের দোকান থেকে কিনে যেত আকছার। অনেকে পয়সা দিতে পারত না। তুমি লিখে
রাখতে খাতায়। বলতে, ‘এখন দিতে হবে না’ কিংবা খুব পরিচিত লোক হলে ‘আমি কি আপনার কাছ
থেকে পয়সা চেয়েছি?’ অনেক সময়ই তোমার এই ভালমানুষির সুযোগ নিয়ে অনেকে জিনিস কিনে
তোমাকে পয়সা দিত না। তাদের ঠকানোটা তুমি বুঝতে, কিন্তু তাদেরকে মুখে কিছু বলতে না।
সব এসে বলতে মা’কে। অনেক রাত্তিরে, সবাই যখন ঘুমিয়ে পরেছে। আমি কিন্তু জেগে থাকতাম
বাবা। আর মনে মনে ভাবতাম, যারা তোমাকে টাকা না দিয়ে ঠকালো আমি তাদের আচ্ছা করে
শিক্ষা দিয়ে আসবো। আর আজ সেসব লোক কোথায় বাবা? হাবুলকাকা, চনুজেঠু, পুলককাকু – এরা
সবাই তোমার দোকানে রোজ ভিড় করত। আর নির্মলজেঠুর তো কথাই নেই। সন্ধ্যে হলেই কেউ না
আসুক সে ঠিক চলে আসত আমাদের দোকানে। আড্ডা মারা হত, জিনিস কেনা হত। ওনাকে দেখে মনে
হত আমাদের কত কাছের লোক। মা’কে ‘বৌমা’ বলে ডাকত, মাঝে মাঝে আমার পড়াশুনার খোঁজ
নিত। সেদিন ওর ছেলে প্রীতমকে দেখলাম লাল রঙের হোন্ডা বাইক চালিয়ে কোথায় যাচ্ছে,
পিছনের সিটে জিন্স পরে বসে আছে তনিমা। তনিমা আমার থেকে তিন বছরের বড়। যদিও এখনও
মাধ্যমিক পাশ করেনি। প্রীতমও দুবার এইচ.এস দিয়েছে। তবুও সবাই ওদের কত খাতির করে।
ওদের বাড়িটা এখন তিনতলা হচ্ছে। আর দোতলার মেঝে খুঁড়ে মার্বেল বসছে। শুনছি নাকি, নির্মলজেঠুর
ঠিকেদারীর ব্যবসাটা ভালই বেড়েছে। কারখানাটাও আরো বড় হয়েছে। আমাদের দেখলে আর যেন
চিনতেই পারে না, মুখ ফিরিয়ে নিয়ে যায়।
রেলের ওপারে কত ভাল ভাল দোকান। কত
হরেকরকমের বিস্কুট, তেল ইত্যাদি। আমাদের দোকানে তো একটা ফ্রিজও নেই। আমাদের কি আর
অত পুঁজি আছে? তাই অনেক জিনিসই রাখা যায় না। আমাদের দোকানে লোক হয় না। তোমার মুখেই
শুনেছি এসব কথা। পুঁজি থাকলে দোকানটা আরো বড় করা যেত। আমিও তো দেখতাম দুপুর বিকেলে
মোটে লোক হত না। শুধুই গালে হাত দিয়ে বসে থাকতাম। মাঝে মাঝে ফাঁক পেলে পড়াশুনোও
করেছি।
সেদিনের কথা মনে পড়ে এখনও। চেয়ারে বসেছিলে
দিব্যি। হঠাৎ চীৎকার করে উঠলে যন্ত্রণায়। আমি পাশের ঘরেই ছিলাম তখন। ছুটে এলাম।
মাও ছুটে এল রান্নাঘর থেকে। দেখলাম চেয়ারের একদিকে তুমি হেলে পড়েছো। মুখের একদিকটা
কেমন বেঁকে যাচ্ছে, আর ডানহাতটা তুমি তুলতে চেষ্টা করছো আর বলছো, ‘হাতে আর জোর
পাচ্ছি না কেন?’ আমি সঙ্গে সঙ্গে পাশের বাড়ি থেকে সিধুকাকাকে ডেকে আনলাম। তারপর
সিধুকাকার পরামর্শমাফিক তক্ষুনি তোমায় নিয়ে ছুটলাম হাসপাতালে। যেতে যেতে রিক্সার
মধ্যে তুমি একবার বমি করেছিলে। সব দেখেশুনে ডাক্তার বলল, ‘তোমার সেরিব্রাল স্ট্রোক
হয়েছে’। পরে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলে যখন তখনও তোমার হাতের জোর ফেরেনি। ডাক্তার এ
ব্যাপারে কোন আশা দেখাতে পারল না। শুধু বলে দিল তোমার ভারী কাজ করা বারণ। আর
নিয়মিত ওষুধ খেয়ে যেতে হবে।
তারপর দিনই তুমি আমাকে ডেকে বললে আমাকে
পরের দিন থেকে দোকানে বসতে হবে। এর জন্য দু-একদিন স্কুল কামাইও দিতে বলেছিলে তুমি।
তোমার কথা শুনে মনটা বড় বিষণ্ণ হয়ে পড়েছিল। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি তোমার এই কথায়
একটুও রাগ করিনি। মাঠটা আমার প্রাণের থেকেও প্রিয় ছিল। খেলা আমার জীবনসঙ্গী। ওদের
হারালাম। অনেকেই তো হারায়। সবাই কি আর শচীন, সৌরভ হয়?
দোকানে যখন কোন খদ্দের আসত না, আমি
পশ্চিমের ঐ জানালাটা খুলে তাকিয়ে থাকতাম। সারাটা দুপুর মাঠটা একলা পড়ে কাঁদত।
তারপর বিকেল হলেই দেখতাম ওরা, মানে মন্টু, চিনু, দীপুরা খেলতে যাচ্ছে। আমাকে দেখে
ওরা হাত নাড়াত। আমিও প্রত্যুত্তরে হাত নাড়াতাম। ওরা নিজেদের মধ্যে আমার দিকে
তাকিয়ে কিসব বলাবলি করত। তারপর গম্ভীর হয়ে মাঠের দিকে হাঁটা লাগাত। আমার বুকের
মাঝখানটাতে তখন কেমন হু হু করে উঠত। তারপর সন্ধ্যে নামলে ওরা যখন বাড়ি ফিরত, ওদের
ডেকে আমি জানতে চাইতাম – কে জিতলো রে আজ? কে বেশি রান পেয়েছে? দীপু আজ ক’টা উইকেট
পেল? আরো নানান প্রশ্ন। তারপর আরো কিছু কথা হতো ওদের সাথে। বন্ধুদের সাথে তো আর
প্রায় দেখাই হত না। এই সময়টুকুই যা অবসর। আর এই সময়টুকুর জন্যেই আমি অপেক্ষা করে
থাকতাম সারাটা দিন।
এই ঘটনাটা ঘটবার ঠিক আগের দিন ওরা এসেছিল।
ওরা মনে হয় তোমার কাছ থেকে টাকা পেত। তাই তার জন্যে তাগাদা করতে এসেছিল। বছর দুয়েক
আগে তুমি নাকি পঞ্চাশ হাজার টাকা ধার করেছিলে ওদের থেকে। ওরা সময় বেঁধে দিয়ে
বলেছিল ঐ দিনের মধ্যে শোধ করতে না পারলে ওরা তোমাকে দেখে নেবে। এই বাড়িতে তোমাকে
ওরা টিকতে দেবে না। ওরা তোমাকে গাল দিচ্ছিল, বাড়ির উঠোনে নেমে খিস্তি করছিল।
রাস্তায় অনেক লোক জড়ো হচ্ছিল তার ফলে। এসব দেখে আমার খুব রাগ হল। আমি রেগে মেগে
ওদের কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, তুমি আমাকে ইশারায় চুপ করে যেতে বলেছিলে। তুমিও ওদের
কিছু বললে না। চুপ করে শুনে গেলে ওদের কথা। সেদিন রাতে ভাত খেলে না তুমি। কারুর
সাথে একটাও কথা বললে না। তারপর বিছানায় গিয়ে ওপাশ ফিরে শুয়ে রইলে।
পরেরদিন দোকানে গিয়ে আমি সত্যিই একটু
অন্যমনস্ক ছিলাম। বিশেষ করে তোমার সাথে ওরা যে ওরকম ব্যবহার করেছে আর সেটা পাঁচকান
হয়েছে এ নিয়ে আমার মন ভীষণভাবে সেদিন বিমর্ষ ছিল। পশ্চিমের জানালাটা আমার
অক্সিজেন। তাই ওটা খুলে দাঁড়িয়ে রইলাম বেশ কিছুক্ষণ। সামনে একটা সরু রাস্তা, তার
ওপাশে একটা বিশাল বড় খেলার মাঠ। এই দুপুরে বিশেষ কেউ একটা নেই মাঠে। শুধু একটু
দূরে খো-খো খেলা হচ্ছে। এখানে এখন দুপুরে মাঝে মাঝে খো-খো খেলা হয়। খেলাও যে বিশেষ
দেখছিলাম তাও নয়। ভারাক্রান্ত মনটাকে হয়ত শান্ত করছিলাম তখন। পেছনদিকে যে দোকানটা
পড়ে আছে সে খেয়ালই ছিল না। কিসের একটা শব্দ হতেই পেছন ফিরে তাকালাম আর অবাক হয়ে
দেখলাম ২৫-৩০ বছরের একটা ছেলে এক জার চিনি, দু-তিনটে নুনের প্যাকেট, বেশ কিছু
বিস্কুট লজেন্স নিয়ে তার ব্যাগে ভ’রে ফেলেছে। ওদিকে আরেকটা ছেলে তার জন্য
মোটরসাইকেল নিয়ে অপেক্ষা করছিল। আমি ‘চোর চোর’ বলে দৌড়তেই সে ছুটল মোটরসাইকেলটার
দিকে। ইতিমধ্যে পাশের দোকানে শ্যামলকাকু আর বুড়োজেঠুও দৌড়ে এসেছে ওকে ধরবার জন্য।
কিন্তু আমরা এসে ওকে ধরবার আগেই ছেলেটা মোটরসাইকেলে উঠে বসল। ওদিকে ওর বাইকটা
স্টার্ট দেওয়াই ছিল। ও উঠে বসতেই ওরা হুস করে আমাদের সামনে দিয়ে দৃষ্টিপথের বাইরে
চলে গেল।
সেদিন সন্ধ্যেবেলা। তুমি আমার মুখ থেকে
পুরো ঘটনাটা শুনলে। তারপর কেমন যেন হয়ে গেলে। কথা বলতে পারছিলে না তুমি। আমি
অপরাধীর মত তোমার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। মা রান্নাঘরে উবু হয়ে বসে আলু কুটছিল। তুমি
আমাকে গালে সজোরে একটা থাপ্পড় কষালে। তারপর ‘গর্দভ’ ‘গবেট’ এসব বলতে বলতে চড় কিল
যা পারলে চালাতে লাগলে। বেশিক্ষণ চালাতে হয়নি তোমায়। মাথায় বার বার আঘাত পাওয়ায়
আমার কেমন যেন সব গুলিয়ে যেতে লাগল। তারপর যখন চোখ খুললাম, মাথায় বেশ যন্ত্রণা
হচ্ছে। মুখ থেকে গ্যাঁজলা বেরোচ্ছিল। হাসপাতালের ডাক্তার বলে দিল, মাথার ভেতরে
রক্তক্ষরণ হচ্ছে। মাথায় অপারেশন করাতে হবে, নইলে বাঁচানো মুশকিল। আর অপারেশনের খরচ
প্রায় চার লাখ টাকা।
তারপর থেকে আজ অব্দি বাড়িতেই বসে আছি।
মাথায় যন্ত্রণায় ছটফট করি। তুমি এখন দেখি মাথায় মাঝে মাঝে হাত বুলিয়ে দাও, খুব
আরাম লাগে আমার। এর আগে কবে এভাবে আমার পাশে বসেছিলে তুমি, আমার মাথায় কবে হাত
বুলিয়ে দিয়েছিলে – আমার মনে পড়ে না। কেবল চোখের সামনে ভাসে তোমার চোখরাঙানি
মূর্তি। মা তো প্রায় চব্বিশ ঘণ্টাই আমার সেবা করে যাচ্ছে। বোনও এখন কেমন চুপচাপ
হয়ে গেছে। ও তো আগে এমন ছিল না। আমারও ধীরে ধীরে কথা বলবার শক্তি হারিয়ে যাচ্ছে।
কোন কাজও আর নিজে থেকে করতে পারি না। শুধু একটা দুঃখ আমার থেকে গেল বাবা। তোমার
কাছ থেকে ..."
চিঠিটার এর পরের অংশটা ছিঁড়ে গেছে। আমি
যেখানে এখন দাঁড়িয়ে আছি, ঠিক তার সামনে একটা ছোট দোকানঘর ছিল। আজ সেখানে দাঁড়িয়ে
একটা বিরাট বড় শপিং মল। গোটা অঞ্চলের একমাত্র আকর্ষণ এই শপিং মল। অঞ্চলের
অধিবাসীবৃন্দের প্রায় ৮০% এই শপিং মলের খদ্দের। দেড়-দু কোটির টার্নওভার প্রতি
বছরে। পঁচিশ জন লেবার নিয়মিত কাজ করে এখানে। এই শপিং মলের মালিকের অনুদানেই
সম্প্রতি তৈরি হয়েছে সুস্নাত মেমোরিয়াল ক্রিকেট কোচিং সেন্টার। কলকাতা থেকে একজন
নামী কোচ আসেন প্রতি রবিবার এখানে ক্রিকেট শেখাতে। গরিফা মাঠে এখন রোজ প্র্যাক্টিস
হয়। ভাবা হচ্ছে, এই মাঠটাকে এবার ক্রিকেটের উপযোগী করে তৈরি করা হবে। কত লোক তার
ছেলেকে ক্রিকেট শেখাচ্ছে এই হুজুগে।
হঠাৎ দেখলাম মৈনাক একটা পাঁচ-ছ বছরের
ছেলেকে নিয়ে এদিকে আসছে। আমার সামনে ছেলেটাকে দাঁড় করিয়ে বলল, ‘আপনার একটু
রেকমেণ্ডেশান দরকার দেবেশদার কাছে। দেবেশদা বলে দিয়েছে আর বেশি ছেলে না নিতে।
এমনিতেই সব হাউসফুল। তবু আপনি একটু বলে দিলেই আমার এই ভাইপোটার জন্য একটা ব্যবস্থা
হয়ে যাবে। ক্রিকেটের শখ খুব।’ আমি দেখলাম ফুটফুটে ছেলেটা, মুখটা অনেকটা সুস্নাতর
মতোই। মুহুর্তে মনে পড়ল বছর দশেক আগের একটা ছেলের মুখ। পশ্চিমের জানালাটা দিয়ে ছেলেটা
তাকিয়ে থাকত ঐ মাঠটার দিকে। ক্রিকেট বড্ড প্রিয় ছিল তার। মৈনাককে আমি কথা দিলাম,
‘আমি নিজে দেবেশকে বলবো’। মৈনাক গদগদ ভঙ্গীতে বলতে শুরু করল, ‘তা আর বলবেন না।
আপনার মত মানুষ’।
তারপর ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এই জেঠুটাকে দেখে রাখো, ইনি কত বড় মানুষ জানো? কত
কিছু করেছেন উনি। এই শপিং মল, নিজের ছেলের নামে ক্রিকেট কোচিং সেন্টার ....’ ওর
কথাগুলো শুনতে আমার মোটেই ভাল লাগছিল না। কেবলই মনে হচ্ছিল, ছেলেটা বড় অভিমান নিয়ে
চলে গেল। চিঠিটা পর্যন্ত এতদিন আমার হাতে পড়েনি। সব জানতে জানতে বড্ড দেরী
হয়ে গেল আমার। বহু পুরোনো
আঘাতে আবার কেউ আঘাত দিয়ে গেল।
ঠিক এমন সময়েই একটা দমকা হাওয়া। আর সেই
হাওয়ায় চিঠিটা আমার হাত থেকে ছিটকে গেল। আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম বাতাসে ভেসে
ভেসে চিঠিটা উড়ে চলেছে ঐ মাঠটার দিকে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন