কভি আলবিদা না
ক্যাহেনা – মিষ্টি গানটার সুরে বেজে
ওঠে টেবিলে
রাখা মোবাইলটা। পাশেই
পড়ছিলো নিশা। সামনেই
ওর উচ্চমাধ্যমিকের
টেস্ট।
তাই পড়ায়
এখন প্রচুর
চাপ।
এই অসময়ের
ফোনে স্বভাবতই
বিরক্ত হয়
ও।
অন্য কেউ
হলে কি
হত জানি
না।
তবে নিশা
ক্লাসের ফার্স্ট
গার্ল।
তাই পড়ার
ব্যাপারে তার
সিনসিয়রিটি অন্যদের থেকে একেবারেই আলাদা। ফোনটাকে
সাইলেন্ট করে
দেয় ও। কে
করেছে তাও
দেখে না। এখন
ওর পড়ার
সময়...শুধুই
পড়ার।
এবারও যে
ওকে ফার্স্ট
হতেই হবে। উচ্চমাধ্যমিকে
স্ট্যাণ্ড করারও একটা আশা রয়েছে
তার মনে। আসলে
মাত্র দুটো
নম্বরের জন্য
মাধ্যমিকে স্ট্যাণ্ড করতে পারেনি কিনা!
তাই এবারে
আর কোনো
ভুল করতে
রাজী নয়
সে।
উচ্চমাধ্যমিকে সেই আক্ষেপ যেন মিটে
যায়।
সেই চেষ্টাই
সে এখন
একান্ত মনে
করছে।
ফোনটা বাজতে
বাজতে থেমে
যায় একসময়।
কভি আলবিদা না
ক্যাহেনা – কিছুক্ষণ পরেই আবার বেজে
ওঠে ফোনটা। পড়ায়
ডিস্টার্ব হয় আবার। একটু
উষ্ণ মেজাজে
ফোনটা তুলে
নিশা দেখে
স্ক্রিনে নামটা
ঝলকাচ্ছে – সবুজ। ‘ওফ! জ্বালাতন
আর ভালো
লাগে না। এই
এক ছেলে
আছে।
দিনরাত ফোন
আর মেসেজ। মেসেজ
আর ফোন। সারাদিন
শুধু এই
করে যায়। কোনো
কাজ নেই,
কাম নেই। ডিসগাস্টিং। ঝট
করে মেজাজটা
গরম হয়ে
যায় নিশার। আর
হবে নাই
বা কেন?
এমন ইম্পরট্যান্ট
মুহূর্তে ফোন
এলে কার
না বিরক্তি
ধরে! সেদিনের
সেই ছোট্ট
ভুলের খেসারৎ
আজও যে
তাকে দিয়ে
যেতে হচ্ছে। আর
ভাল লাগে
না।
তবু ভুলও
তার পিছু
ছাড়ে না। আসলে
ভুলটা যখন
হয়েছিলো, নিশা
তখন আরেকটু
ছোট, আরেকটু
অপরিণত।
সবে তখন
ইলেভেনে ভর্তি
হয়েছে সে। আশিস
স্যারের ব্যাচে
পড়া ছিল
সেদিন।
বাইরের টুপটাপ
বৃষ্টি দেখে
মন চাইল
না পড়তে
যেতে।
তবুও ‘পড়াটা
কামাই হবে!’
– এই ভেবেই
গেল পড়তে। যেই
না
ঢুকেছে স্যারের বাড়ি, নামলো তুমুল
বৃষ্টি।
সে বৃষ্টির
কোনো কমতি
নেই! একনাগাড়ে
হয়ে চলেছে
তো চলেছেই। থামাথামির
কোনো লক্ষণ
না দেখে
স্যারও সেদিন
বললেন, ‘আজ
আর বেশি
পড়ালাম না। বাইরে
যা চলছে
তাতে আর
কিছুক্ষণ বাদে
বাড়ি ফিরতে
নৌকা লাগবে। সাবধানে
যেও সবাই।‘ স্যার
এই বলে
দোতলায় চলে
গেলেন।
‘সাবধানে যেও’
তো বললেন
স্যার।
এদিকে নিশা
ব্যাগ থেকে
তার ছাতা
বের করতে
গিয়ে দেখে
ছাতার হ্যাণ্ডেলটা
কি করে
ভেঙ্গে গেছে। আসলে
ওটা আগে
থেকেই একটু
নড়বড়ে ছিল। ব্যাগের
মধ্যে চাপেই
বোধহয় একেবারে
ভেঙ্গে গেলো। ওটা
আজকের দিনে
নিয়ে আসাটাই
বোকামি হয়েছে। নিজের
ওপর রাগ
হতে থাকে
নিশার।
এখন স্যারকেও
দোতলা ডাকতে
কেমন বাধো
বাধো লাগে
তার।
আসলে সে
ত এই
স্যারের কাছে
একেবারে নতুন। আজকে
নিয়ে তার
মাত্র দুদিন
হল এই
ব্যাচে।
বেশী ছাত্রছাত্রীও
আসেনি সেদিন
যে কাউকে
বলবে একটু
এগিয়ে দেওয়ার
জন্যে।
যারা এসেছে
তারা কেউই
এদিকে থাকে
না।
আর বলবার মতো
আছে শুধু
সবুজ।
ওর বাড়ি
যদিও অনেক
দূরে, কিন্তু
নিশাদের বাড়ি
ওদের বাড়ির
রাস্তাতেই পড়ে। আর তাছাড়া
সবুজকে অনেকদিন
ধরে চেনেও
নিশা।
দুজনে নাইন,
টেনের অনেক
ব্যাচে একইসাথে
পড়েছে।
নিশা তাই
ওকে ডেকে
বলে, এই
সবুজ।
দেখ না,
আমার ছাতার
হ্যাণ্ডেলটা একবারে ভেঙ্গে গেছে।
তোর ছাতা
আছে তো!
তাহলে আমায়
একটু এগিয়ে
দিতে পারবি
রে? একটু
বোকা বোকা
ভাব নিয়ে
সবুজের দিকে
চেয়ে থাকে
নিশা।
তাই দেখে
একচোট জোর
হেসে নেয়
সবুজ।
বলে,’কেমন
ছাতা রে
তোর? প্লাস্টিকের
নাকি? হাঃ
হাঃ।
ওর হাসি
দেখে নিশা
একটু রাগের
ভঙ্গীতে বলে,
হাসিস না। কোনোরকমে
এখন বাড়ি
পৌছলে হয়। সবুজ
বলে,’আরে,
চিন্তা করছিস
কেন? হাম
হ্যায় না!
এই বলে
ও ওর
দাদুর বিশাল
বড় ছাতাটা
ব্যাগ থেকে
বের করে। তাই
দেখে নিশা
হেসে ফেলে,
‘এ কবেকার
ছাতা? এ
কি তোর
দাদুর ছাতা
নাকি! হি
হি।
সবুজ বলে
ওঠে, হুঁ
হুঁ, বাবা!
এ দাদুর
ছাতা হলে
কি হবে,
এর জোর
একেবারে নাতির
মতো।
যাই হোক,
দুজনে এবার
হাঁটা লাগালো
জলভরা পথে,
ছলাৎ ছলাৎ। সবুজ
নিশাকে আলতো
করে জড়িয়ে
ধরে। আর কিসব যেন
ওকে বলতে
থাকে নিচু
স্বরে।
তাতে নিশা
হেসে ওঠে
মাঝেমাঝেই।
ওদের হাসি
আর কথাগুলো
বৃষ্টির ঝিরিঝিরি
কলতানের সাথে
মিশে তৈরী
করে এক
নতুন আবেশ।
তবু এটাই ভুলের
শুরু।
ভুলেও ভাবতে
পারেনি ওরা,
যে এখানে
কোন ভুল
লুকিয়ে থাকতে
পারে।
তাই ওরা
এগোল যৌবনের
ছন্দে তালে। আর
দুজনের দুই
চোখের ডাকে
আনকোরা এক
সাড়া দিয়ে
ফেলল একসময়। এই
সাড়াই ওদের
সামান্য বন্ধুত্বটাকে
করে তুললো
আরোও নিবিড়। নিজেদের
অজান্তেই তা
আরো রঙিন
হয়ে ফুটে
উঠল ভালোবাসার
প্রথম কুঁড়ি
হিসেবে।
তারপর টুকরোটাকরা
দুষ্টুমিষ্টি ভেজ-নন-ভেজ মেসেজ
আর তাছাড়া
মাঝেমাঝে দুজনের
মধ্যে কথাবার্তা
চলতো পড়ার
ব্যাচে কিংবা
অন্য কোন
অচেনা অজানা
জায়গায়।
যেখানে ওদের
কেউ চেনে
না, কেউ
জানে না। কথা
যেন আর
শেষ হতেই
চাইত না,
বাকী থেকে
যেত রোজই। বাকী
থাকা কথাগুলো
ফোনে চলতো...কিন্তু তবু
তা শেষ
হত না। বেশিরভাগ
দিনই সবুজ
ফোন করত। নিশাও
করত মাঝে
মাঝে।
কিন্তু ব্যস!
ওই পর্যন্তই। তারপরই
পড়ার চাপ
বেড়েছে।
নিশা এসব
ব্যাপারে তাই
আর নিজেকে
জড়াতে চায়নি। মূহুর্তের
ভুল হয়ে
সে দিনগুলো
কেটে গেছে
ক্লাস ইলেভেনের
প্রথম দিকেই। বয়সটা
কম ছিলও
কিনা ওর!
তাই ওরকম
ভুলভ্রান্তি একটু-আধটু হয়েই থাকে। নিশা
হয়ত থেমেছিল
এরপর।
কিন্তু থামেনি
সবুজ।
নিশার কোয়ালিটির
পাশে সবুজ
যদিও পাত্তা
পাওয়ারও যোগ্য
নয়।
তবু নিশাকে
একবার দেখবার,
তার সাথে
কথা বলবার,
তার কথা
শোনবার, হাসি-ঠাট্টা করবার
ষোলো আনা
ইচ্ছেই তার
ছিল।
এদিকে ইলেভেনে
দ্বিতীয়বার ফেল করলে যে তাকে
স্কুল থেকে
বের করে
দিতেও পারে,
সে খেয়াল
হয়ত তার
ছিল না। তাই
সবুজ এগিয়েছিল
তার খুশিমতো। বারবার
ফোন করে
গেছে সে
নিশাকে।
মেসেজের পর
মেসেজ পাঠিয়ে
গেছে তাকে। কিন্তু
নিশার তখন
অন্য জীবন। তার
পড়াশুনোর জীবন। নিজের
কেরিয়ারই তার
কাছে আগে। তাই
সবুজের ফোনে
সে বিরক্ত
হয়েছে।
তবুও অনেকদিনই
এভাবে চলেছে। কিন্তু
আর পারেনি
নিশা।
কয়েকদিন আগে
বাধ্য হয়েই
সে সবুজকে
জানিয়ে দিয়েছে,
‘দেখ সবুজ,
তোর সাথে
সম্পর্ক রাখার
কোন ইচ্ছে
যেমন আমার
নেই, তেমনি
এখন আমার
পড়ার সময়। তাই,
প্লিজ বিরক্ত
করিস না
এখন।
এরপর ফোনটা
সেদিন নিজেই
কেটে দিয়েছিল
সে।
তবু এই
ভুল কি
এত সহজে
মুছে ফেলা
যায়? হয়ত
না।
তাই সবুজ
আবারও ফোন
করেছিলো নিশাকে। নিশা
আর কোন
দ্বিধা না
করে মাকে
সব জানিয়ে
ফোনটা মায়ের
হাতে তুলে
দিয়েছিলো।
একটা উটকো
ছেলে তার
মেয়েকে জ্বালাচ্ছে!
শুনে মায়ের
মেজাজ গরম
হয়ে গেছিল
সেদিন।
কিন্তু হায়রে,
মা বা
মেয়ের কেউই
জানত না
যে সেদিন
সবুজ নিশার
কোন ক্ষতি
চায়নি।
সে শুধু
এটুকু বলতে
চেয়েছিল,’ সরি কাকিমা, আমার ফোনে
যদি ওর
পড়ার ক্ষতি
হয়ে থাকে
তাহলে আর
ফোন করব
না’।
মা সেসব
না শুনে
বলতে শুরু
করলো, ‘তোমার
তো সাহস
কম নয়। কি
ভেবেছ কি
তুমি? ......’বলতে বলতে ভেতরের ঘরে
চলে গেছিল
মা।
মায়ের কথা
আর শোনা
যায়নি।
তবে একটা
ব্যাপার ঠিক। সেদিনের
পর থেকে
সবুজ আর
কোন ফোন
করেনি।
তাই নিশ্চিন্তই
ছিল নিশা। কিন্তু
কোথায় কি!
এ তো
দেখছি আবার
সেই একই
ঝামেলা।
এবার কি
করা যায়?
সাতপাঁচ ভাবতে
ভাবতে ফোনটা
ধরল নিশা,
হ্যালো।
এরপর প্রায় আধঘণ্টা
কেটে গেছে। চায়ের
কাপ হাতে
নিয়ে মা
এসে ঢোকে
নিশার পড়ার
ঘরে।
নিশা তখন
ফিজিক্স বইয়ের
একটা পাতা
ওল্টাচ্ছিল। চায়ের কাপটা টেবিলে
রেখে মা
বলে, তাড়াতাড়ি
খেয়ে নিস
চা টা। রোজই
তো জুড়িয়ে
ঠাণ্ডা জল
হয়ে যায়। মা
ঘর থেকে
বেরোতে যাবে
এমন সময়
নিশা ডাকে,’মা’।
মা ঘুরে
দাঁড়িয়ে বলে,
‘কি হল?’
কোমল গলায়
নিশা বলে,
সবুজকে সেদিন
তুমি কি
বলেছিলে মা?’
মা মুখে
একটু বিরক্তির
ভাব এনে
বলে, ‘কি
আবার বলবো?
একটা ফালতু
ছেলে আমার
মেয়েকে জ্বালাবে
এ তো
হতে দেওয়া
যায় না। তাই
আচ্ছ্বাসে দিয়েছি সেদিন’, মায়ের স্বরটা
কঠিন হয়ে
ওঠে, ‘যাতে
ও কোনদিনও
তোকে আর
জ্বালানোর সাহস না পায়।
......আবার বলে কিনা ‘সরি বলতেই
তো ফোন
করেছিলাম’।
ভেঙিয়ে ওঠে
মা।
নিশা চীৎকার
করে ওঠে,
‘চুপ করো,
কেন তুমি
ওকে ওভাবে
শাসাতে গেলে?
মা স্তম্ভিত
হয়ে যায়
নিশার চীৎকারে। নিশা
এবার মৃদু
কণ্ঠে বলে,
‘জানো, কাল
রাতে ও
রেললাইনে গলা
দিয়ে সুইসাইড
করেছে।
সুইসাইড নোটে
লিখেছে যে
ওর এই
মৃত্যুর জন্য
কেউ দায়ী
নয়।
আর এই
খবরটা শুধু
আমাকে জানাতে
বলে গেছে। কারণ
আমিই নাকি
ওর একমাত্র
বন্ধু ছিলাম। ওর
দাদা এইমাত্র
ফোন করে
জানালো।
কথাটা শুনে
মায়ের ভেতরটায়
একটা শক
খেলে গেল। কান্নাভেজা
গলায় নিশা
বলে, ‘আমি
তো কারুর
ক্ষতি চাইনি। তাই
না মা?’
বুজে আসে
ওর গলা। মা
দেখে নিশার
চোখদুটো জলে
ভরে গেছে
একটা চাপা
কষ্টে।
ওকে জড়িয়ে
ধরে মা
বলে, ‘না,
মা।
আমরা কেউই
তা চাইনি’।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন