বাসস্ট্যাণ্ডে দাঁড়িয়ে আছি বাসের অপেক্ষায়। নামেই বাসস্ট্যাণ্ড।
কবেকার কোন বটগাছের গায়ে সাঁটা ‘বাস থামিবে’। তবু এখানেই বাস থামে। এখান থেকেই আমি
রোজ অফিস থেকে ফেরার বাস ধরি। এই যেমন আজ। তবে আজ শরীরটা খারাপ লাগছিল বলে অফিস
থেকে একটু আগেই বেরিয়ে পড়েছি। আর অফিসে কাজের যা চাপ তা যারা এ ব্যাঙ্কে কাজ করে
তারাই জানে। সর্দিটা এমনিতেই ছিল। কাজের চাপে শুরু হয়ে গেল মাথা যন্ত্রণা। তবে এখন
মনে হচ্ছে এই সময় বেরিয়ে ভুলই করলাম। এই প্যাচপেচে অসহ্য গরমের দুপুরে শালোয়ারটা
জ্যাবজেবে হয়ে ভিজে গেছে ঘামে। একটা বন্ধ দোকানের শেডের তলায় দাঁড়িয়ে ওড়নাটাকে
মুখের ওপর নাড়াতে লাগলাম। ঠিক এমন সময় দেখি একটা ছেলে আমার পাশেই এসে দাঁড়াল।
আমারই মত বয়স। বেশভূষায় মনে হল না কোন ভাল ঘরের ছেলে। হাড়গিলে চেহারা। কোটরে ঢোকান
দুটো চোখ। আমি ভেবেছি, হয়ত বাস ধরবে। তাই প্রথমটায় ততটা খেয়াল করিনি। খানিকক্ষণ
বাদে যেন মনে হল, ছেলেটা আমার দিকেই বারবার তাকাচ্ছে। কেমন একটা অস্বস্তি বোধ
করলাম। ভরদুপুর। তাই রাস্তায় লোকজন প্রায় নেই। দোকানপাটও সব বন্ধ। মেন রোডটা দিয়ে
মাঝেমাঝে হুশ-হাশ করে দু-একটা গাড়ি ছুটে যাচ্ছে। আমি ওড়নাটাকে ঠিক করে গুছিয়ে
নিলাম। সবুজ শালোয়ারটা ঘামে গায়ের সাথে একেবারে লেপ্টে আছে। সেটাকেও একটু ঠিক করে
নিলাম। বলা যায় না কিছু, কার মনে যে কি আছে। আর যা দিনকাল পড়েছে। এইসব ভেবেই একটু
পাশে সরে এসে দাঁড়ালাম। এমন সময় সামনে
বিকট ঘরঘর আওয়াজে একটা দশচাকার গাড়ি যেতে লাগল। ভাঙা রাস্তায় যেতেও পারছে
না জোরে। আর এদিকে আওয়াজে কানে তালা পড়ার জোগাড়। ঠিক তক্ষুনি আবারও মনে হল, ছেলেটা
আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমি নিশ্চিত সেটা আমার মনের ভুল নয়। একটা ভয় কাজ করতে লাগল
আমার মধ্যে। অন্য দিকে ঘুরে দাঁড়ালাম। কিন্তু স্পষ্ট বুঝলাম ছেলেটা আমার দিকে আরও
এগিয়ে আসছে। আরও। আরও। আর ফিরে তাকাবারও সাহস ছিল না আমার। দৌড়ে পালাব কি চীৎকার
করব ভাবছি। এমন সময় ছেলেটা মুখ থেকে একটা অদ্ভুত শব্দ করে আমায় এক ধাক্কা মেরে
ফেলে দিল। বেশ কিছুটা দূরে ছিটকে পড়লাম আমি। ইতিমধ্যে ছেলেটাও মারল এক লাফ। আর ঠিক
সেইসময়েই কি একটা ভেঙে পড়ার তীব্র আওয়াজ। সমস্ত ঘটনাটা কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঘটে
গেল। রাস্তায় পড়ে আমার সারাটা শরীর তখন অবসন্ন। ব্যথায় কুঁকড়ে আসা চোখদুটো তুলে
দেখি, একটা লরি সামনের ঐ দোকানটায় ধাক্কা মেরেছে। বোধহয় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিল
ওটা। আর আমি যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম সে জায়গাটা ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে। চারিদিকে কাঁচের
টুকরো, ইঁটের টুকরো ছড়িয়ে রয়েছে। দৃশ্যটা দেখে আমি শিউরে উঠলাম। দেখি সামনে ঐ
ছেলেটা। আমাকে তোলার জন্য হাত বাড়িয়েছে। পরে বুঝেছি, যে ছেলেটা বোবা। তাই আমাকে
লরিটার ব্যাপারে কিছুই জানাতে পারেনি। মুখে শব্দ করেছিল, কিন্তু ঐ দশচাকার গাড়ির
আওয়াজে আমি কিছুই টের পাইনি। আসলে আমার মনটাও যে তখন অন্যদিকে ছিল। যাই হোক, আমার
হাতে পায়ে বেশ কতক জায়গায় কেটে ছড়ে গিয়েছিল। হাজার বারণ সত্ত্বেও ও নিজেই সেগুলো
ধুয়ে পরিষ্কার করে দিল। তারপর আর কোনদিকে না তাকিয়ে ঐ ভেঙে পড়া লরিটার দিকে ছুটল।
কিন্তু যাবার আগে ও একটা অদ্ভুত হাসি হেসে গেল। হয়ত এভাবেই ও বলে গেল... কি জানি কি বলে গেল?
1 টি মন্তব্য:
ভালো লাগলো ।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন